চিরঘুমের দেশে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়
বাংলার সংগীত জগতের এক স্বর্ণযুগের অবসান। না ফেরার দেশে পাড়ি জমালেন জনপ্রিয় সংগীতশিল্পী সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়।
মঙ্গলবার (১৫ ফেব্রুয়ারি) সন্ধ্যায় কলকাতার একটি বেসরকারি হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিলো ৯০ বছর।
কিংবদন্তি এই শিল্পীর প্রয়াণের খবর টুইট করে জানিয়েছেন তৃণমূল কংগ্রেসের সাংসদ শান্তনু সেন।
শিল্পীর প্রয়াণে শোকাহত অনুরাগীরা। শোক প্রকাশ করেছেন বিনোদন ও সংস্কৃতি জগতের বিশিষ্টরা।
দিন কয়েক আগেই করোনামুক্ত হয়েছিলেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। হয়েছিলো তার কোমরের হাড়ে অস্ত্রোপচারও। কেননা হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার আগে বাথরুমে পড়ে গিয়ে কোমরে প্রচণ্ড চোট পেয়েছিলেন।
অস্ত্রোপচারের পর সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের শারীরিক পরিস্থিতি স্থিতিশীল থাকলেও মঙ্গলবার ফের অসুস্থ হয়ে পড়েন। যার জেরে কোনওরকম ঝুঁকি না নিয়েই শিল্পীকে তড়িঘড়ি দেওয়া হয়েছিল আইসিইউতে।
এদিন হাসপাতালের তরফে জানানো হয়েছিল, গায়িকার শারীরিক পরিস্থিতি বেশ উদ্বেগজনক। প্রথমত, পেট ব্যথা। দ্বিতীয়ত, সকাল থেকেই হঠাৎ রক্তচ্চাপ কমা শুরু করে। যার জন্য সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়কে ভেসোপ্রেসার সাপোর্টে রাখা হয়েছে। এরপরই কোনওরকম ঝুঁকি না নিয়ে গীতশ্রীকে আইসিইউতে স্থানান্তরিত করা হয়ে। তবে ওষুধ দেওয়ার পর রক্তচ্চাপ নিয়ন্ত্রণে এসেছিলো। ৫ সদস্যে মেডিকেল টিমের কড়া পর্যবেক্ষণে ছিলেন তিনি। তবে শেষরক্ষা হলো না।
১৯৩১ সালের ৪ অক্টোবর কলকাতার ঢাকুরিয়াতে জন্মগ্রহণ করেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। বাবা নরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় রেলে চাকরি করতেন। ছয় বোনের কনিষ্ঠতম সন্ধ্যার শৈশব থেকেই গানের প্রতি আলাদা টান ছিল। পণ্ডিত সন্তোষ কুমার বসু, চিন্ময় লাহিড়ীর কাছে গানে হাতেখড়ি করেছেন। উস্তাদ বড়ে গুলাম আলি, এমনকি তার ছেলে উস্তাদ মুনাবর আলি খানের কাছেও শাস্ত্রীয় সংগীতের তালিম নিয়েছিলেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়।
১৯৪৮ সালে প্লে-ব্যাক গায়িকা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। ক্লাসিক্যাল সঙ্গীতের পাশাপাশি ফিল্মি দুনিয়াতেও সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের গাওয়া গানের সংখ্যা নেহাত কম নয়। এই পথ যদি না শেষ হয়, এ শুধু গানের দিন, এসো মা লক্ষ্মী বোসো ঘরে, চম্পা চামেলি গোলাপেরই বাগে, আমি স্বপ্নে তোমায় দেখেছি.. তার কণ্ঠে এমন অজস্র গান শ্রোতাদের কাছে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।
একসময়ে হিন্দি ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতেও চুটিয়ে গান গেয়েছেন তিনি। ১৭টি হিন্দি ছবিতে প্লে-ব্যাক করেছেন। পাশাপাশি নিজস্ব অ্যালবামও বের করেছেন। পঞ্চাশের দশকে মুম্বাইতে সন্ধ্য়া মুখোপাধ্যায়ের ক্যারিয়ার যখন মধ্যগগনে তখন বিয়ের জন্য কলকাতায় ফিরে আসেন। মনস্থ করেন এখানে থেকেই সংসার গুছিয়ে পাশাপাশি গানের ক্যারিয়ার চালিয়ে যাবেন। শচীন দেব বর্মন, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, সলিল চৌধুরি, অনিল বিশ্বাস, মদন মোহন, রোশন প্রমুখের মতো খ্যাতনামা সঙ্গীত পরিচালকের সঙ্গে কাজ করেছেন।
স্বর্ণযুগের এই কিংবদন্তি গায়িকা ভূষিত হয়েছেন গীতশ্রী সম্মানেও। পেয়েছেন বঙ্গবিভূষণ। এমনকি, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের হাতে উঠেছিল জাতীয় সম্মানও। কালের নিয়মে তিনিও শিরোনাম থেকে হারিয়েই গিয়েছিলেন। জন্মদিন ছাড়া তাঁকে নিয়ে কলমের আঁচড় সাধারণত আর পড়ত না। তবে সাধারণতন্ত্র দিবসের আগের বিকেলে পদ্ম সম্মান-এর ঘোষণাই ফের আলোড়ন ফেলে দিল। কেন্দ্রীয় সরকারের দেওয়া পদ্ম-প্রস্তাব পত্রপাঠ প্রত্যাখ্যান করে দিলেন বাঙালি কিংবদন্তি গায়িকা। দৃঢ় কণ্ঠে বলেছিলেন, “আমার দেশ আমাকে যেভাবে ভালোবাসে, সেখানে আমার পদ্মশ্রী কিংবা কোনও শ্রীর-ই প্রয়োজন নেই।”