পার্বত্য শান্তিচুক্তির ২৭ বছরে পাহাড়ি-বাঙালির প্রত্যাশা পূর্ণ হোক

  • ড. মাহফুজ পারভেজ, অ্যাসোসিয়েটএডিটর, বার্তা২৪.কম
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

পাহাড়ি-বাঙালির প্রত্যাশা পূর্ণ হোক/ছবি: সংগৃহীত

পাহাড়ি-বাঙালির প্রত্যাশা পূর্ণ হোক/ছবি: সংগৃহীত

১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর সশস্ত্র সংঘাতময় পার্বত্য চট্টগ্রামে সম্পাদিত শান্তিচুক্তির ২৭ বছর পূর্ণ হচ্ছে এই ডিসেম্বরে। বাংলাদেশ সরকার ও জনসংহতি সমিতির মধ্যে স্বাক্ষরিত ঐতিহাসিক চুক্তির মাধ্যমে পাহাড়ে অবসান ঘটে রক্তাক্ত অধ্যায়ের। ভ্রাতৃঘাতী লড়াই থেমে শান্তি, সম্প্রীতি ও উন্নয়নের নতুন পর্যায় সূচিত হয় পার্বত্য চট্টগ্রামে।

সন্দেহ নেই, পাহাড়ের বঞ্চনার ইতিহাসে শান্তিচুক্তি পরবর্তী ২৭ বছর এক উজ্জ্বল সংযোজন। রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানে অংশগ্রহণ, চাকরি ও উচ্চশিক্ষার সুযোগ প্রাপ্তি ও আর্থিক সমৃদ্ধির ফলে পাহাড়ে বসবাসকারী বিভিন্ন ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষের ভাগ্যে আলোর দেখা মিলেছে। অবকাঠামোগত নির্মাণ ও মানবসম্পদ উন্নয়নের বিষয়গুলোও দৃশ্যমান হয়েছে। ফলে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ২৭ বছরে এসে এক নতুন পাহাড়ের দেখা পেয়েছি আমরা।

বিজ্ঞাপন

তবে, এখনও পাহাড়ে সুপ্ত আকারে কিছু ক্ষোভ, বঞ্চনা ও হতাশা বিরাজমান। যেজন্য তিন পার্বত্য জেলার নানা অংশে প্রায়ই উত্তেজনা ও অস্থিরতা দেখা যায়। বিভিন্ন ক্ষুদ্র গোষ্ঠীর মধ্যে টানাপোড়েনও লক্ষ্য করা যায়। পাহাড়িদের তুলনায় পার্বত্য-বাঙালিদের পিছিয়ে থাকার অভিযোগও কখনও কখনও উত্থাপিত হয়।

ফলে শান্তিচুক্তি পার্বত্য জনপদকে শান্তির পথে পরিচালিত করেছে বটে, তবে পূর্ণ বা স্থায়ী শান্তি এখনও সুনিশ্চিত করতে পারে নি। এই ব্যর্থতার দায় প্রধানত রাজনৈতিক দলগুলোর, যারা বিগত ২৭ বছর ক্ষমতায় থেকেও শান্তিচুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়ন করতে পারে নি। এবং পাহাড়ের নতুন নতুন দ্বন্দ্ব ও সংঘাতকে শান্তিপূর্ণ আলোচনার মাধ্যমে রাজনৈতিক সমাধানের পথে নিয়ে যেতে পারেন নি। অতএব, শান্তিচুক্তির ২৭ বছরের পরিক্রমায় পাহাড়ি ও বাঙালি নেতৃত্বকে তাদের সাফল্য-ব্যর্থতার আলোকে আত্মসমালোচনার প্রয়োজন আছে। জাতীয় রাজনৈতিক নেতৃত্বকেও পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ে তাদের কার্যক্রমের ত্রুটিগুলো খতিয়ে দেখার দরকার রয়েছে।

বিজ্ঞাপন

এরই মাঝে বাংলাদেশে নতুন রাজনৈতিক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। ২০২৪ সালের জুলাই গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে শান্তিতে নোবেলজয়ী অধ্যাপক ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নিয়েছে, যারা সংস্কার, পরিবর্তন ও অন্তর্ভুক্তিমূলক বাংলাদেশ বিনির্মাণের কথা বলছে। এরই ভিত্তিতে নানা ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সংস্কার নিয়ে কাজ চলছে। যদিও এই সংস্কার ধারায় পার্বত্য চট্টগ্রাম অন্তর্ভুক্ত নয়। অনেকেই বিশ্বাস করে, পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রকৃত শান্তি, সম্প্রীতি ও উন্নয়ন নিশ্চিত করতে নানা ক্ষেত্রে সংস্কার, পরিবর্তন ও পুনর্গঠনের আবশ্যকতা রয়েছে।

কারণ, রাজনৈতিক নেতৃত্ব দলীয় বিবেচনায় পার্বত্য চট্টগ্রামকে দেখতে গিয়ে অনেক ক্ষেত্রেই সঙ্কীর্ণ পন্থা অবলম্বন করেছে। সাধারণ মানুষের কল্যাণের বদলে দলীয় নেতা-কর্মীদের স্বার্থ দেখেছে। নিজেদের পক্ষের লোকজনকে বছরের পর বছর নানা পদে বসিয়ে রেখেছে। উন্নয়নের ক্ষেত্রেও দলীয় মনোভাব প্রাধান্য পাওয়ায় অঢেল দুর্নীতি, অনিয়ম ও স্বেচ্ছাচারিতা হয়েছে। পাহাড়ে বিদ্যমান অতীতের ভুলগুলোর অবশ্যই সংস্কার ও পরিবর্তন হওয়া দরকার।

গোষ্ঠীগত রাজনৈতিক হানাহানি ও সশস্ত্র তৎপরতার মধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি যখন ২৭ বছরে উপনীত, তখন নতুন অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের তিন মাস পেরিয়ে গেছে। গত তিন মাসের মধ্যে নতুন সরকার পাহাড়ের মানুষের জন্য সম্ভাবনার বেশ কিছু বার্তা দিয়েছে। যেমন, দেশী-বিদেশী ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে পাহাড়ে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ঘটানো অপচেষ্টা অত্যন্ত দক্ষতার সাথে সামাল দিয়েছে বর্তমান সরকার। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে কোনও বক্তব্য না দিলেও বিভিন্ন পদে নতুন ও উদীয়মান লোকজনকে কাজ করার সুযোগ দিয়েছে। এতে পাহাড়ে নেতৃত্বের গতিশীলতা এসেছে, যা জনস্বার্থে আরও বৃদ্ধি করা অপরিহার্য।

এমতাবস্থায়, শান্তিচুক্তি নিয়ে স্থবিরতা ও অচলাবস্থা দূরীকরণে বর্তমান সরকারকে উদ্যোগী ভূমিকা নিতে হবে। চুক্তি বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের সংশ্লিষ্টরা বিগত সরকারের মতো টালবাহানা ও দীর্ঘসূত্রিতার কবল থেকে বেরিয়ে আসবেন, এটাই প্রত্যাশিত। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন প্রক্রিয়াকে অন্তর্বর্তী সরকারের অগ্রাধিকার তালিকায় রাখার দাবিও জানিয়েছে বহু সংগঠন। পাহাড়ি ও বাঙালিরা নিজ নিজ দাবি ও বঞ্চনার বিষয়গুলো তুলে ধরছেন বিভিন্ন ফোরামে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে চুক্তি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে জনমতের প্রতিটি দিক, দাবি ও প্রত্যাশাকে অন্তর্ভুক্তির মনোভাব নিয়ে দেখতে হবে, যাতে অতীতের মতো কোনও গোষ্ঠী ও জাতিসত্তা যেন বঞ্চনার ক্ষত সহ্য না করে এবং সকলেই যেন তাদের ন্যায়সঙ্গত বিষয়গুলো প্রাপ্ত হয়।

উল্লেখ্য যে, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া থমকে গিয়েছিল নানা কারণে। রাজনৈতিক অনীহা ও আমলাতান্ত্রিক শ্লথগতি এর জন্য দায়ী ছিল। ফলে পাহাড়ের মানুষকে চুক্তি বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি দিয়েও তা বাস্তবায়িত করা যায় নি। বদলে মানুষকে বারবার মিথ্যা আশ্বাস দেওয়া হয়েছে। মানুষ বঞ্চিত ও প্রতারিত হয়েছে। এবং ২৭ বছর ধরে চুক্তি অবাস্তবায়িত থাকায় পার্বত্য চট্টগ্রামসহ সারাদেশের নাগরিকদের মধ্যে অনিশ্চয়তা ও হতাশার সৃষ্টি হয়েছে। এই অচলতার সুযোগ নিয়ে বিভিন্ন স্বার্থান্বেষী গ্রুপ পার্বত্য চট্টগ্রামকে অস্থিতিশীল, উতপ্ত ও অগ্নিগর্ভ করার চক্রান্ত করেছে, যা জাতীয় নিরাপত্তা ও আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার ক্ষতি করে চলেছে।

চুক্তির পূর্ণাঙ্গ ও যথাযথ বাস্তবায়ন শুধু পার্বত্য চট্টগ্রামের স্থায়ী শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্যই নয়, বরং সেখানকার সকল নাগরিকের মর্যাদা ও অধিকার সমুন্নত রাখা এবং জাতীয় ঐক্যের জন্য অপরিহার্য। বৈষম্যবিরোধী বাংলাদেশ বিনির্মাণে অভিযাত্রায় পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়নে অন্তর্বর্তী সরকার পাহাড়ের সকল শ্রেণি, পেশা ও মতাদর্শের মানুষের সঙ্গে খোলামনে সংলাপের উদ্যোগ নিতে পারে। এজন্য সরকারের উচিত যত দ্রুত সম্ভব পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ কমিটি পুনর্গঠন করা।

পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির আরেকটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে, পাহাড়ের ভূমিবিরোধ নিষ্পত্তি করা। এ-সংক্রান্ত একটি কমিশনও রয়েছে। বারবার দাবি জানানো সত্ত্বেও বিগত সরকার ভূমি কমিশনের বিধিমালা প্রণয়ন করেনি। ফলে ভূমি কমিশন অকার্যকর থেকে যায়। সকলের সঙ্গে আলোচনাসাপেক্ষে ভূমি কমিশনের কাজে নতুন গতি সঞ্চার করা যেতে পারে।

১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর স্বাক্ষরিত চুক্তিতে অনেক ধারা-উপধারা আছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ গঠন এবং আঞ্চলিক পরিষদ পাহাড়ের প্রশাসনিক কাঠামোর কেন্দ্রবিন্দু হওয়ার বিষয়ে চুক্তিতে সুনির্দিষ্ট ধারা উল্লেখ করা আছে। ২৭ বছরেও চুক্তি অনুযায়ী আঞ্চলিক পরিষদকে গণতান্ত্রিক নির্বাচনের মাধ্যমে গতিশীল করা হয়নি। পাহাড়ের বাসিন্দাদের নিয়ে ভোটার তালিকা প্রণয়ন করে তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ নির্বাচন করার বিষয়টিও ঝুলে আছে। তাই পার্বত্য তিন জেলা পরিষদ ২৭ বছর ধরে অনির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে পরিচালিত হয়ে আসছে, যা সুশাসনের পরিপন্থী।

পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি অনুযায়ী পাহাড়ের ভূমি ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব জেলা পরিষদের ওপর ন্যস্ত করা হয়নি। শরণার্থীদের মধ্যে একটি বড় অংশ ২৭ বছরের এই দীর্ঘ সময়েও নিজ নিজ বসতভিটা ফেরত পান নি। অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তুর বিষয়টিরও সুরাহা হয়নি। তিন জেলার জন্য পার্বত্য পুলিশ বাহিনী গঠন নিয়ে কোনও কাজই শুরু করা হয়নি। পাহাড়ের সকল গোষ্ঠীকে শাসন ও অংশগ্রহণের আওতায় আনার কাজটিও পূর্ণাঙ্গতা পায় নি।

জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের মধ্য গঠিত অন্তর্বর্তী সরকার পাহাড়ের মানুষের দীর্ঘদিনের আকাঙ্ক্ষা পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নে গতি আনতে সচেষ্ট হওয়ার কোনও বিকল্প নেই। তা না হলে পাহাড়ের মানুষ বঞ্চিতের মধ্যেও অধিকতর বঞ্চিত হতে থাকবে। তাদের মধ্যে ক্ষোভের বিস্তার ঘটবে, যা অশান্তির কারণ হয়ে সম্প্রদায়গত বিভেদ বাড়াতে পারে।

পাহাড়ের মানুষ রাষ্ট্রের সঙ্গে ন্যায্যতার ভিত্তিতে অংশীজন হওয়ার জন্যই সশস্ত্র সংঘাত পরিত্যাগ করে চুক্তিতে আবদ্ধ হয়েছিল। কিন্তু চুক্তিটিকে কার্যত অবাস্তবায়িত রেখে রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকরা পার্বত্য চট্টগ্রামের মানুষকে আশাহত করে রেখেছে। জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থান যে নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের কথা বলছে, তাতে পাহাড়ে বৈষম্য, বিভেদ ও বঞ্চনার অবসান ঘটুক। শান্তিচুক্তির ২৭ বছরে পাহাড়ি ও বাঙালি নাগরিকগণ এমন প্রত্যাশাই করছেন।

ড. মাহফুজ পারভেজ: অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম; প্রফেসর ও চেয়ারম্যান, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও নির্বাহী পরিচালক, চট্টগ্রাম সেন্টার ফর রিজিওনাল স্টাডিজ, বাংলাদেশ (সিসিআরএসবিডি)।