ডোনাল্ড ট্রাম্প: বিশ্বে দেখা দুর্বলতম শক্তিশালী ব্যক্তি!
-
-
|

ছবি: সংগৃহীত
ইউক্রেনের জন্য পুতিনের কাছে ডোনাল্ড ট্রাম্পের আত্মসমর্পণ একটি নমুনাই প্রকাশ করে। যা থেকে তাকে চিত্রিত করা যায় সবচেয়ে লোভী হিসাবে, যিনি সবকিছু ত্যাগ করে বিনিময়ে খুব সামান্যই অর্জন করেন! তিনি একজন শক্তিশালী ব্যক্তি হিসেবে নিজেকে প্রচার করেন বটে, কিন্তু বাস্তবে তিনি দুর্বল, দুর্বল এবং দুর্বল। আমেরিকার প্রতিপক্ষদের সামনে ডোনাল্ড ট্রাম্প নেহায়েৎই লোভী ও বিবেচনাহীন বাতিকগ্রস্ত। বলা যায়, তিনি কেবল একজন মানুষের দরজার সামনে পরাজিত।
এই সপ্তাহে ভ্লাদিমির পুতিনকে তিনি যে উপহার দিয়েছেন তা একবার বিবেচনা করা যেতে পারে। ২০২২ সালে মস্কোর ইউক্রেন আক্রমণের পর তিন বছরে একঘরে থাকার পর যুদ্ধের বর্ষপূর্তির প্রাক্কালে তিনি রাশিয়াকে কূটনৈতিক শীতলতা থেকে বের করে এনেছেন। পুতিনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভকে অবাঞ্ছিত ব্যক্তি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল; তিনি আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞার আওতায় রয়েছেন। তবুও, এই সপ্তাহে রিয়াদে তিনি তথাকথিত শান্তি আলোচনায় ট্রাম্পের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিওর সাথে দেখা করেছেন।
এই বৈঠকের ঘটনা পুতিনের দীর্ঘদিনের আকাঙ্খাকে পূর্ণতা দিয়েছে, তা হচ্ছে আমেরিকার সাথে সমতা। এটি ইঙ্গিত দেয় যে ওয়াশিংটন মস্কোকে তার সমান বলে মনে করে। এটি এও প্রমাণ করে যে রাশিয়া একটি বিবেকহীন আগ্রাসী রাষ্ট্র নয়, বরং একটি সহযোগী বৃহৎ পরাশক্তি যা তার মর্যাদাকে সমুন্নত রাখে। সৌদি আরবে যাই হোক না কেন, পুতিন এটিকে জয় হিসাবেই গ্রহণ করবেন।
কিন্তু ট্রাম্পের উদারতা এখানেই শেষ হয়নি। রিয়াদের বৈঠকে কে ছিল না? উত্তর: ইউক্রেনীয়রা। মনে রাখবেন, এই আলোচনাগুলি ইউক্রেনের ভবিষ্যত নিয়ে আলোচনার জন্য ছিল; ইউক্রেন আক্রমণের পর দেশটিতে যুদ্ধের অবসান ঘটানোর জন্য। তাদের নিজস্ব ভবিষ্যত নির্ধারণের জন্য আলোচনা থেকে ইউক্রেনীয়দের বাদ দেওয়া স্পষ্টতই পুতিনের জন্য একটি বিশাল ছাড়: এটি নিশ্চিত করে যে তিনি তার শর্তে যুদ্ধ শেষ করেন। তবে এটি তাদের আরও বড় অর্জন হিসাবেই বিবেচিত হতে পারে। এটি পুতিনের দাবিকে পরোক্ষভাবে সমর্থন করে যে, ইউক্রেন একটি বাস্তবসম্মত দেশ নয়; এটি কেবল মহান রাশিয়ান মাতৃভূমির একটি প্রদেশ ছিল, যার নিজস্ব কোনও সার্বভৌমত্ব নেই।
সৌদি আরবে অন্য অংশীজনদের অগ্রাহ্য করা হয়েছিল এবং তাদের বাদ দেওয়া রাশিয়ান স্বৈরশাসকের প্রতি আরেকটি ঔদার্য হিসাবেই বিবেচিত হতে পারে। ইউরোপের দেশগুলোকে এই গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকের অংশ করা হয়নি যদিও তাদের পূর্ব সীমান্তে যা ঘটে তাতে তাদের সরাসরি ভূমিকা রয়েছে। নিশ্চিতভাবেই তারা কিয়েভের মিত্র ছিল এবং ইউক্রেনের প্রতিরক্ষায় সহায়তাও দিয়েছিল এবং তাদের উপস্থিতি রাশিয়ানদের কাছে খুব অপ্রীতিকর বলে মনে করা হতো হয়ত-তাই তাদের আমন্ত্রণ জানানো হয়নি।
তবে এই উপেক্ষার মধ্যে আরও একটি বৃহত্তর লক্ষ্য ছিল। পুতিনের কৌশলগত লক্ষ্য কী, যা সাম্প্রতিক বছরগুলিতে তার কর্মকাণ্ডের অনেক ব্যাখ্যা দেয়, যার মধ্যে বিদেশী নির্বাচনে হস্তক্ষেপও অন্তর্ভুক্ত? এটি হল পশ্চিমা জোটের ভাঙন। তিনি ব্রেক্সিটকে ভালোবাসতেন, ইউরোপে অতি ডানপন্থীদের উত্থানে উল্লাস করেছিলেন এবং ট্রাম্পকে সমর্থন করেছিলেন কারণ তিনি তার বিরুদ্ধে দৃঢ়ভাবে দাঁড়িয়ে থাকা পশ্চিমা ব্লকের ভেঙে পড়া দেখতে চাইতেন। একজন মার্কিন রাষ্ট্রপতির জন্য এই স্ক্রিপ্ট অনুসরণ করা, আমেরিকার সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী মিত্রদের বিচ্ছিন্ন করা, ক্রেমলিনের জন্য একটি বিশাল জয়।
বিশেষ করে মার্কিন ভাইস-প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্সের মিউনিখ ভ্রমণের ঠিক পরেই - যে শহরটির নাম চিরকাল স্বৈরশাসকদের তোষণের সাথে যুক্ত থাকবে ইউরোপের গণতন্ত্রকে তিরস্কার করার জন্য। বাকস্বাধীনতা ও রাশিয়ার সমস্ত ভিন্নমত দমনের কোনও উল্লেখ না করে পুতিনের অভ্যন্তরীণ সমালোচকদের মৃত্যুর দুর্ভাগ্যজনক প্রবণতাকেও সচেতনভাবে তুলে ধরে এটি।
ট্রাম্পের অযোগ্য প্রতিরক্ষা সচিব পিট হেগসেথ এর আগে ইউক্রেনকে সতর্ক করেছিলেন যে রাশিয়া কর্তৃক অধিকৃত ভূমি তারা কখনই পুনরুদ্ধার করতে পারবে না এবং ন্যাটোতে যোগদানের সমস্ত স্বপ্ন ত্যাগ করা উচিত। কিন্তু তদুপরি ট্রাম্প সোশ্যাল মিডিয়ায় ক্ষোভ জানিয়ে যে পোস্ট করেছিলেন তা পুতিনের প্রিয় আলোচনার বিষয় হয়ে ওঠে। ট্রাম্প লিখেছেন, ভলোদিমির জেলেনস্কি হলেন ‘অনির্বাচিত একজন স্বৈরশাসক’, যিনি তার নিজের জনগণের কাছে ব্যাপকভাবে অজনপ্রিয়। যিনি দুর্নীতির মাধ্যমে ইউক্রেনের কোটি কোটি ডলার গ্রাস করেছেন। ট্রাম্প এও বলেন যে, ‘আপনার কখনই এ যুদ্ধ শুরু করা উচিত ছিল না।’ যেন তিন বছর আগে রাশিয়ায় আক্রমণকারী ইউক্রেনই ছিল!
গত সপ্তাহে ট্রাম্প পুতিনকে বিষয়ে যে অবস্থান তুলে ধরেছেন তা এই ধারণাই প্রকট করে। আর বিনিময়ে ট্রাম্প কী পেয়েছেন? তোষামোদ এবং মস্কোর সাথে লাভজনক জ্বালানি চুক্তির ঝুলন্ত প্রতিশ্রুতি ছাড়া কিছুই নয়। প্রকৃতপক্ষে, তিনি বিনিময়ে কিছুই চাননি। বলা বাহুল্য যে, কথিত শক্তিশালী এই ব্যক্তি হাঁটু গেড়ে রাশিয়ান স্বৈরশাসকের পায়ে চুম্বন করেছিলেন তারা আলোচনা কক্ষে প্রবেশ করার আগেই। অবাক হওয়ার কিছু নেই, ২০১৯ সালে ইউক্রেনের বিষয়ে ট্রাম্পের পয়েন্ট ম্যান হিসেবে পদত্যাগকারী কার্ট ভলকার, সর্বশেষ পলিটিক্স উইকলি আমেরিকা পডকাস্টে আমাকে বলেছিলেন যে প্রেসিডেন্টের ‘পুতিনের প্রতি অন্ধ সমর্থন’ রয়েছে।
এমন বাস্তবতায় ট্রাম্পের পক্ষে ‘যুদ্ধের অবসানের জন্য সফলভাবে আলোচনা’ করার দাবি করা হাস্যকর বললেও অত্যুক্তি হবে না, যা কেবল তিনিই করতে পারেন। যদি আপনি এক পক্ষকে তারা যা চায় তা দেন, যা তারা স্বাভাবিকভাবেই গ্রহণ করে এবং অন্য পক্ষকে তাদের যা প্রয়োজন অস্বীকার ও প্রত্যাখ্যান করে। তবে এটি একটি শান্তি চুক্তি নয়, একে জোরপূর্বক আত্মসমর্পণ ছাড়া আর কিছুই বলা যায় না। এটি মোটেও কোনও অর্জন নয়।
এবং এই ক্ষেত্রে ট্রাম্পের ক্ষেত্রে বলাবাহুল্য যে, চুক্তির কথিত কর্তা বারবার সবকিছু ত্যাগ করে বিনিময়ে কিছুই অর্জন করতে পারেন না। ২০১৮ সালে কিম জং-উনের সাথে তার বৈঠকের কথা মনে করা যেতে পারে। উত্তর কোরিয়ার অত্যাচারী এবং দাস রাষ্ট্রের শাসক একজন মার্কিন রাষ্ট্রপতির সাথে শীর্ষ সম্মেলনের বৈধতা এবং তার প্রবল প্রশংসার পুরষ্কার পেয়েছিলেন। কিম কোরীয় উপদ্বীপে মার্কিন সামরিক মহড়া স্থগিত করার মাধ্যমেও জয়লাভ করেছিলেন। এগুলি মূল্যবান অর্জনই বটে! বিনিময়ে, কিম পারমাণবিক অস্ত্রবিহীন বিশ্বের জন্য কিছু অস্পষ্ট আকাঙ্ক্ষা ছাড়া আর কিছুই স্বীকার করেননি। তিনি ট্রাম্পকে একটি স্লট মেশিনের মতো খেলেছেন।
স্পষ্ট করে বলতে গেলে, রাষ্ট্রপতির দুর্বলতা এখানে সবচেয়ে গুরুতর পাপ নয়। আরও গুরুতর হল একজন স্বৈরশাসকের কাছে আত্মসমর্পণ, আক্রমণে সম্মতি এবং এর স্থায়ী নজির স্থাপন। জীবনের জন্য লড়াই করা একটি মিত্রকে পরিত্যাগ করা এবং আট দশক ধরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সহ পশ্চিমে আপেক্ষিক শান্তি ও সমৃদ্ধি এনে দেওয়া একটি জোট ভেঙে ফেলার স্পষ্ট সিদ্ধান্ত।
ট্রাম্প নিয়ে ব্যাখ্যাকারীরা বলছেন যে, তিনি এটি একটি কঠোর কারণে এসব করছেন। এমনকি তার নিজস্ব শর্তে বিচার করলেও, এই পদক্ষেপ ব্যর্থতার ইঙ্গিতবাহী। কারণ একটি ভঙ্গুর পশ্চিমের ভবিষ্যতে চীনের আধিপত্যকে আরও বেশি প্রবল করে তোলে।
ব্রিটেন সহ বাকি পশ্চিমাদের খুব দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এবং তা স্পষ্টতার সঙ্গে আবির্ভূত নতুন বিশ্বকে কীভাবে পরিচালনা করা যায়। যুদ্ধোত্তর যুগ শেষ হয়ে গেছে। ১৯৪৫ সালে নির্মিত বৈশ্বিক স্থাপত্য ট্রাম্পের দ্বারা পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে। ইউরোপীয়দের এমন একটি ভবিষ্যতের পরিকল্পনা করা এবং বিনিয়োগ করা দরকার যেখানে তাদের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ছাড়াই নিজেদের রক্ষা করা যাবে। সেই ভবিষ্যৎ খুব বেশি দূরে নয়। এটি ইতিমধ্যেই দৃশ্যমান।
আপাতত, একটি রাজনৈতিক কাজ করা যেতে পারে। এটি হল ট্রাম্প যে ভাবমূর্তি গড়ে তোলার জন্য অনেক কিছু করেছেন এবং যার উপর তিনি দেশে এবং বিদেশে অন্যদের ভয় দেখানোর চেষ্টা চালাচ্ছেন। ডেমোক্র্যাটিক সিনেটর রিচার্ড ব্লুমেন্থাল এই সপ্তাহে বলেছিলেন, ‘রাষ্ট্রপতির আত্মসমর্পণ করুণ এবং দুর্বল।’ এটিই সঠিক উপমা। ট্রাম্প সর্বশ্রেষ্ঠ প্রচারসর্বস্ব ব্যক্তিত্ব হতে পারেন, কিন্তু তিনি বিশ্বের দেখা সবচেয়ে দুর্বলতম শক্তিশালী ব্যক্তি।
জোনাথন ফ্রিডল্যান্ড দ্য গার্ডিয়ান’র কলামিস্ট। দ্য গার্ডিয়ান থেকে ভাষান্তর: আশরাফুল ইসলাম