মাহে রমজানে মূল্যছাড় ও অতি মুনাফা প্রসঙ্গ
-
-
|

ছবি: বার্তা২৪.কম
আমাদের দেশে পবিত্র রমজান এলে নিত্যপণ্যের কোন মূল্যছাড় লক্ষ্য করা যায় না। বরং কে কত লাভ করবেন সেটা নিয়ে ব্যবসায়ীদের মধ্যে অস্থির প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায়। প্রতিবছর রমজান মাস সমাগত হবার আগেই এক শ্রেণির লোভী ব্যবসায়ী কোমর বেঁধে অধিক লাভের আশায়ায় অংকের নতন হিসেব মেলাতে ব্যস্ত হয়ে উঠেন। পবিত্র রমজানে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে ব্যবসায়ীরা লাভের কথা ভুলে গিয়ে রোজাদারকে স্বল্পমূল্যে পণ্য সরবরাহ করার প্রতিযোগিতা শুরু করলেও আমাদের দেশে এর উল্টোচিত্র দেখা যায়। এবং অধিক মুনাফা লাভের কুৎসিত প্রবণতা আমাদের দেশের ব্যবসায়ীদের একটা মজ্জাগত বিষয় হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে।
সৌদি আরবের ব্যবসায়ীগণ পবিত্র রমজান মাসে লাভ করতে চান না। তাদের খাদ্যপণ্যের দোকানগুলোতে ৫০% মূল্যছাড় দেয়া হয়ে থাকে। সেখানে ৬৫ রিয়ালের একটি ট্যাং জুসের মূল্য ৪০ রিয়ালে বিক্রি করার মানসিকতা দেখা যায়। এইভাবে কাতার, ওমান, সংযুক্ত আরব আমীরাত, বাহরাইন, ব্রুনাই, মালয়েশিয়া প্রভৃতি দেশেও বিশাল মূল্যছাড়ের কথা জানা যায়। এমনকি যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও অনেক অমুসলিম দেশেও পবিত্র রমজান ও ঈদ উপলক্ষ্যে খাদ্য ও পোশাকের উপর বিশেষ মূল্যছাড় দেয়া হয়ে থাকে। কিন্তু বাংলাদেশে রমজান বা ঈদে দ্রব্যমূল্যছাড়ের রীতি বা কৃষ্টিই গড়ে উঠেনি। বরং এখানে আড়ৎদারী, মজুতদারী ও একাই আয়-লাভ করব, একাই খাব নীতিতে মানুষ অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে। এভাবেই দেশে আশিভাগ সম্পদ মাত্র ২০ ভাগ মানুষের হাতে কুক্ষিগত হয়ে পড়েছে। তারা সুনির্দিষ্ট নিজসম্পদের হিসেব করে জাকাত প্রদানেও কার্পণ্য করে থাকেন। তাহলে দারিদ্র বিমোচন ও মানবিক বাংলাদেশ গড়ে উঠবে কীভাবে?
তাই আমাদের অতি লোভী ব্যবসায়ীরা নিজেদের থেকে নিত্যপণ্যের কোন মূল্যছাড় দিতে আগ্রহী না হলে সরকারীভাবে রমজান মাসে মূল্যছাড়ের জন্য হস্তক্ষেপ করা প্রয়োজন। কারণ হিসেবে বলা যেতে পারে, বাংলাদেশ একটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ট দেশ। নামাজের ওয়াক্ত হলে এত বেশী আযানের সুর বিশ্বের অন্য কোন মুসলিম দেশেও শোনা যায় না। কিন্তু আদারেকে টিটকারী করে বলা হয়ে থাকে- ‘মুসলিম এই দেশে, ইসলাম ঐ দেশে।’ তাই পরিবর্তিত নতুন বাংলাদেশের এই সুন্দর সময়ে নিত্যপণ্যমূল্যবৃদ্ধির এই কুৎসিত প্রতিযোগিতার অবসান হওয়া জরুরী।
সারা বছর ঘুরে একমাসের জন্য পবিত্র রোজার সওগাত নিয়ে হাজির হয় মাহে রমজান। যে ব্যক্তি রোজা রাখে তার জন্যই কল্যাণের বার্তা রয়েছে। কারণ নিজেকে নিজের সাথে শপথ করার মাধ্যমে দেহ, মন ও চিন্তা চেতনার আসল শুদ্ধি শুধু রোজার মাধ্যমেই সম্ভব। অন্য কোন বাহ্যিক ইবাদতের সাথে রোজার এখানেই আসল পার্থক্য বিরাজমান। তাই একজন সৎ মানুষ তথা আসল মুমিন হবার বিকল্প নেই।
কিন্তু সৎ মানুষের সংকটে রোজার আসল উদ্দেশ্য থেকে মুসলমানগণ অনেক দুরে সরে গেছেন। অতি মুনাফালোভী, মজুতদার ও সৎ মানুষের সংকটে রমজান আসার আগেই প্রতিবছর বাজারে নিত্যপণ্যের দ্রব্যমূল্য বাড়িয়ে দেয়া হয়। প্রতি রমজানে দ্রব্যমূল্যবৃদ্ধি করা যেন একটা কুৎসিত নেশা।
বলা হয়ে থাকে রমজান মাস শুরু হলে শয়তানকে একমাসের জন্য শিকলবন্দী করে রাখা হয়। যাতে সে মানুষকে ইবাদত থেকে বিচ্যুত করতে না পারে। তা ঠিক। কারণ, রমজানের আগমনে মানুষের মনের মধ্যে বিরাট পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। রোজা রাখার জন্য প্রস্তুতি চলে বেশ জোরেশোরে। সারাদিন রোজা রাখার পর ইফতারী করা, তারাবীহ্ নামায আদায় করা, শেষরাতে সেহ্রী খাওয়া সবকিছুতেই একটা ধর্মীয় আমেজ চলে। মুমিনগণ তাঁদের সৎভাবে উপার্জিত আয়ের অর্থ দিয়ে এসকল ধর্মীয় কাজের খরচ বহন করে থাকেন। বাধ সাধে তাদের জন্য, যারা সৎ-অসৎ ও হারাম-হালাল আয় ও দ্রব্যের মধ্যে পার্থক্য সূচিত করতে ভুলে যান অথবা জেনেশুনে মোটেও পার্থক্য করেন না । অথবা, যারা হেঁয়ালী করে ভাল-মন্দ সবকিছুর মধ্যে মাখামাখি করে নিজের মূল্যবান জীবনটাকে অসততার মাঝে সঁপে দিয়ে দ্বিকুলে অর্থহীন করে ফেলেন।
সে জন্যই রমজানে শয়তান ইবলিস শিকলবন্দী থাকলেও মানুষরূপী শয়তানের তৎপরতা বেশ বেপরোয়া। যে সকল মানুষরূপী শয়তান তাদের কথা, কর্ম ও পরিবেশের মধ্যে ইবলিস শয়তানের আদর্শ চর্চা করে নিজেকে গড়ে তুলে পাপসঙ্কুল জীবন যাপনে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে- তাদেরকে তো আর শিকলবন্দী করে রাখা হয়নি। তাদের ক্ষমতা ও অন্যায় কাজের সীমাহীন প্রভাবে রমজান মসেও ঘরে ঘরে মানুষের মনে শয়তানী শুরু করার উপকরণ থেকে যায়। ঘরে-বাইরে চারদিকে শয়তানী কাজের উপকরণ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রেখে ইবলিস শয়তানকে আহব্বান করা হয় মাত্র। এভাবে শয়তান মুসলমানদের অন্তরে প্রবেশ করে সবসময় ধোঁকা দিচ্ছে এবং তাকে আরো বেশী অনুসরণ করার জন্য উস্কে দিচ্ছে। এভাবেই শুরু হয়েছে ন্যায়-অন্যায়ের সংকট। একজন ভাল মানুষের নৈতিকতাবোধ হরিত হয়ে পড়ে এই সংকটের সময়।
কিছু লোভী ও স্বার্থপর মানুষের মধ্যে এই ধরণের সংকট থেকে আমাদের দেশে শুরু হয়েছে বাজারে নিত্য পণ্যের সংকট। অতি মুনাফা লাভের আশায় মজুতদাররা সামান্য পিঁয়াজ-তেলের কৃত্রিম সংকট শুরু করেন। আমাদের দেশে কৃষি উৎপাদনের কমতি নেই। পাশাপাশি আমদানিও করা হয় প্রচুর। তাই বাজারে পণ্য যোগানের স্বল্পতা নেই। তবে কেন নিত্যপণ্যের কৃত্রিম সংকট? তবে কেন বাসি-পঁচা ইফতার পরদিন বিক্রি করার জন্য ডালায় সাজানো হয়? মানুষের সংগে ভেজাল দ্রব্য দিয়ে প্রতারণা করা ও অতি মুনাফা করাই এখানে সংকটের পিছনে বিশেষভাবে দায়ী। আরো রয়েছে- এক শ্রেণির কাঁচা পয়সাধারী উঠতি বিত্তশালী ভোগবাদী মানুষের অপরিনামদর্শী কেনাকাটার উন্মত্ত আচরণ। এরা দরিদ্র ও সীমিত সৎ আয়ের মানুষের ক্রয়ক্ষমতাকে সম্মান করে না। বরং বাহাদুরী করে কেনাকাটায় বেহুঁশ হয়ে বাজারে দ্রব্যমূল্য বাড়ানোকে উস্কে দেয়। ফলে বাজার হয়ে পড়ে অস্থিতিশীল। আমাদের দেশে ঘুষ-দুনীতিবাজরা কাঁচা পয়সা হাতে পেয়ে কোথাও দরিদ্রদেরকে পাত্তা দেয় না। স্বভাবতই: নি¤œ আয়ের মানুষ তাদের সাথে প্রতিযোগিতায় হেরে বাজারে ক্রয়ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। বর্তমানে বাজারে সাড়ে ছয়শত টাকায় দেশী মুরগী, সাড়ে আটশত টাকায় গরুর মাংস এবং বারশত টাকায় খাসীর মাংস কেনার সামর্থ্য কোন সীমিত আয়ের মানুষের আছে? অথচ, অবৈধভাবে হঠাৎ বনে যাওয়া বিত্তশালীদের বাড়িতে কয়েকটি ডিপ ফ্রীজে প্রয়োজনাতিরিক্ত আমিষ দীর্ঘদিন হিমে পড়ে থেকে নষ্ট হয়ে যায়। উন্নত দেশে বিশেষ করে সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের ধনী দেশগুলোতে খাদ্য অপচয়ের মাত্রা সীমাহীন। সারা বিশে^ বছরে একশ’ কোটি টন রান্না করা খাবার নষ্ট হয়ে যায়!
আমাদের দেশেও মানুষে-মানুষে আয়-ব্যায়ের বিস্তর ফাঁরাক। খাদ্যপণ্য ভোগের ক্ষেত্রেও চরম বৈষম্য লক্ষ্যনীয়। বাজারে সবকিছু থরে থরে সাজানো দ্রব্যের কমতি নেই। লাগামহীন মূল্যস্ফীতিতে সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা নেই। এজন্য ভোক্তা আইন-আন্দোলন ইত্যাদি থাকলেও বাজার মনিটরিং করার দায়িত্বে নিয়োজিত ক্উাকে অকুস্থলে খুঁজে পায়া যায় কি?
আমার এক বন্ধু আক্ষেপ করে লিখেছেন- “সামনে রোজা আসছে। দেখবেন রোজার আগমনে অন্যান্য মুসলিম দুনিয়া শান্ত হয়ে আসছে। মানুষের মাঝে একটা ভাবগম্ভীর পরিবেশ তৈরি হচ্ছে। কিন্তু আমাদের দেশে শুরু হবে কেনা কাটার মচ্ছব। যার দুই কেজি পিঁয়াজ দরকার সে কিনবে বিশ কেজি। যার এক কেজি চিনি দরকার সে কিনবে- দশ কেজি। এমন করে খাবার মজুদ করা শুরু হবে - যেন সারা বছর না খেয়ে ছিলো। রোজার পরও আর কোনোদিন খাবার খাবোনা। দুনিয়ার সব খাবার এই ত্রিশ দিনেই খেয়ে শেষ করতে হবে। এই সুযোগে পবিত্র রমজানের ব্যানার টাঙ্গিয়ে দ্রব্য মূল্যের দাম বাড়িয়ে ব্যবসায়ীরাও অপবিত্র কাজ করা শুরু করে দিবে।
নকল ও ভেজাল খাদ্যদ্রব্য বিক্রি করা রমজানের সময় একটি ভয়ংকর সংকট। মেয়াদউত্তীর্ণ পণ্যের তারিখ পরিবর্তন করে বিক্রি করার প্রবণতা ব্যাপক বেড়ে গেছে। বিশেষ করে প্রাণঘাতি করোনার ভয়ে মানুষ যখন বাড়ি থেকে বের হবার সাহস হারিয়ে ঘরে বসে কেনাকাটা করতে চান তখন একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী অনলাইনে কেনাকাটার ফাঁদ পেতে বসেছেন।
অনলাইনে কেনাকাটার জন্য ফেসবুক, ইউটিউব, টুইটার ও টিভি-পত্রিকাও ব্যাপকভাবে ব্যবহার করে বিজ্ঞাপন দিয়ে নিরীহ মানুষের সংগে প্রতারণা করা হচ্ছে। গুদামের পচা খাদ্যশস্য, দোকানের ছেঁড়াফাটা কাপড়, ভেজাল তেল-ঘি, নকল জুস, হোটেল-রেঁস্তরার বাসি-পঁচা খাবার ইত্যাদি এখন অনলাইনে কেনাকাটার পণ্যদ্রব্য। তাই নিরুপায় মানুষ নিত্য প্রতারিত হতে হচ্ছে অনলাইন কেনাকাটায়।
নিম্ন আয়ের মানুষের কথা ভেবে টিসিবি-কে পাড়ায় পাড়ায় নিত্যপণ্য সরবরাহ বাড়াতে হবে। উপজেলা ও গ্রাম পর্যায়ে যেন নিত্যপণ্যের অভাবে হাহাকার সৃষ্টি না হয় সেদিকে খেয়াল রেখে সরবরাহ চেইন নিয়মিত ঠিক রাখতে তৎপর হতে হবে।
এক শ্রেণির অনৈতিক মানুষের কাজ হলো- শুধু নিজে খাব, কাউকে দেব না। এজন্য তারা অন্যের রিজিকের উপর হাত দিতে কার্পণ্য করে না। কেউ যেন অন্যায়ভাবে অপরের রিজিক কেড়ে না নেয় সেজন্য মানুষের মধ্যে সচেতনা বাড়াতে হবে। রমজানের রোজা রেখে মানুষের আত্মশুদ্ধি হোক ও আত্মপোলদ্ধি জাগ্রত হয়ে সকল পাপ-দুর্নীতির বিরুদ্ধে সবার আত্মা জেগে উঠুক।
প্রতিবছর পবিত্র রমজান ও দুই ঈদকেন্দ্রিক অতি মুনাফা করার প্রবণতা বন্ধ হোক। রোজার মহিমায় যাবতীয় অতি মুনাফালোভী, মজুতদার, শঠ ও দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিকারীদের ভন্ডামী নস্যাৎ হয়ে যাক। সরকারী করছাড় সুবিধা নিয়ে স্বল্পমূল্যে পণ্য আমদানী করে আনার পর গোপনে গুদামজাত করে রাখা এবং সমুদ্রে লইটার ভেসেলে ভাসমান গুদাম তৈরী করে দীর্ঘদিন পণ্য খালাস না করে দুর্নীতিচক্রের সাথে যোগসাজশ করে কৃত্রিম মুনাফা করার ঘৃণ্য প্রবণতা গুড়িয়ে দেবার সুবর্ণসময় এখন। এতসব শয়তানী প্রভাবে বিচ্যুত সকল মানুষ রোজার তাপে পুড়ে আত্মপোলব্ধি থেকে আত্মশুদ্ধি লাভ করে ঈমান মজবুত করুক এবং ফিরে ফিরে পাবার প্রেরণা পাক দুই জীবনের কল্যাণ ।
*লেখক রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডীন। E-mail: [email protected]