অপতথ্যের তাণ্ডব!
-
-
|

ছবি: বার্তা২৪.কম
সঠিক তথ্যের চেয়ে ভুল তথ্য মারাত্মক বিপদের কারণ। অপতথ্য আরও বিপদজনক ও ক্ষতিকর। জুলাই বিপ্লব-পরবর্তী বাংলাদেশে অপতথ্যের তাণ্ডব মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। এই আপদকে মোটেও অবহেলা করা ঠিক হবে না। বরং অপতথ্যের তাণ্ডবকে অবহেলা করা হলে তা অক্টোপাসের মতো প্রকৃত সত্যকে গলাটিপে হত্যা করবে।
বলার অপেক্ষা রাখে না যে, সাম্প্রতিক বাংলাদেশে চলমান যাবতীয় রাজনৈতিক কার্যক্রমের নেপথ্যে মূল প্রেরণা হল গণতান্ত্রিক উত্তরণ এবং স্বৈরতন্ত্র ও ফ্যাসিবাদের চির অবসান। এক্ষেত্রে অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষে নির্বাচিত সরকারের হাতে দায়িত্ব হস্তান্তরে পর আবার নিজেদের কাজে ফিরে যাওয়ার প্রত্যাশা ব্যক্ত করা হয়েছে। বর্তমান সরকারের ঘোষিত অভিপ্রায় হল, `পুরোনো বাংলাদেশ সম্পূর্ণভাবে দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়েছিল, তাই আমরা নতুন বাংলাদেশ নির্মাণ করতে চাই। সেক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সব পর্যায় থেকে আমরা অনেক বড় সহায়তা পাচ্ছি।‘ এই কাজে সফল হলে অন্তর্বর্তী সরকার ইতিহাস সৃষ্টি করবেন এবং নিজেরাও ইতিহাসের সম্মানজনক স্থানে অধিষ্ঠিত হবেন।
এ কথা সত্য যে, অন্তর্বর্তী সরকার গণতান্ত্রিক উত্তরণের পথে তথ্য ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার পূর্ণ মূল্য দিচ্ছেন। অতীতের যা কিছু স্বৈরতন্ত্রের ত্রাসে চাপা পড়েছিল এবং ফ্যাসিবাদের তাণ্ডবে রক্তাক্ত হয়েছিল, সেসব তথ্য ও সত্য ক্রমেই উন্মোচিত হচ্ছে। সংবাদমাধ্যমে প্রশ্ন উচ্চারিত হচ্ছে, `জুলাই বিপ্লবের খুনিরা কোথায়?‘ এমন প্রশ্ন সদ্য বিগত বাংলাদেশে অকল্পনীয় ছিল। অনেক ক্ষেত্রে ক্ষতিগ্রস্তরা প্রতিকার চাইছেন। মামলা করছেন। বিচার প্রক্রিয়া স্বাভাবিক গতিতে এগিয়ে চলেছে। গণতন্ত্রের আরেক গুরুত্বপূর্ণ পূর্বশর্ত ন্যায়বিচার বা আইনের শাসনের আবহ আবার ফিরে আসছে, যা অতীতে দল, ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর করায়ত্ত ছিল।
তবে জুলাই বিপ্লব-পরবর্তী পরিস্থিতি মোটেও শান্ত নয়, বহুলাংশেই সঙ্কুল। মতলববাজরা ন্যায়বিচার বা আইনের শাসনকে বিকৃত করছে। অর্থের লোভে বা প্রতিহিংসার কারণে শুরু হয়েছে মামলা বাণিজ্য। অতীতের মতোই বর্তমানেও এসব মামলা বাণিজ্যে সরকারি কর্মকর্তা ও অসাধু পুলিশ অফিসারদের যোগসাজশ রয়েছে। প্রবাসী বা পেশাজীবী বা নিরীহ সাধারণ মানুষকে মামলার আসামী করে হয়রানি করা হচ্ছে। হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে বিপুল পরিমাণ টাকা। এতে প্রকৃত অপরাধীদের বদলের সাধারণ মানুষ নাজেহাল হচ্ছে। ক্ষেত্র বিশেষে, প্রতিহিংসা চরিতার্থ হচ্ছে। বহুজনকে স্বৈরাচার ও ফ্যাসিবাদের দোসর আখ্যা দিয়ে অত্যাচার করার বিষয়টি গণতান্ত্রিক সমাজের ন্যায়বিচার ও আইনের শাসনের সম্পূর্ণ পরিপন্থী। আইন ও ন্যায়বিচারকে বিকৃত করে মানুষকে নিগৃহীত করার বিষয়টি গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির সঙ্গে মোটেও মানানসই নয়।
একইভাবে, তথ্য ও মত প্রকাশের স্বাধীনতার ক্ষেত্রেও চলছে চরম বাড়াবাড়ি। অবাধে ছড়ানো হচ্ছে ভুল বা অপতথ্য। গুজবকে সত্য বা তথ্য হিসাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে। তথ্যপ্রযুক্তিকে এক্ষেত্রে কাজে লাগাচ্ছে মতলববাজ গোষ্ঠী। এমন কি, বিভিন্ন নামী-দামী সংবাদপত্র ও গণমাধ্যমের মাস্টহেড বা লগো ব্যবহার করে মিথ্যা তথ্য ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে ফটোকার্ডের মাধ্যমে। এহেন অপতৎপরতা তথ্য ও মত প্রকাশের শত্রু এবং সাইবার ক্রাইম। এমন অপরাধী চক্র বর্তমানে বেশ সক্রিয়। প্রায়শ তারা নানা ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের নাম ভাঙিয়ে অপতথ্য প্রচারের অপকর্ম করছে, যার মধ্যে জনপ্রিয় মাল্টিমিডিয়া নিউজপোর্টাল বার্তা২৪.কম'ও আক্রমণের শিকার হয়েছে। জনপ্রিয় পোর্টালগুলোকেই অপরাধীরা বেছে নেয়। বিবিসি, সিএনএন-সহ বাংলাদেশের পাঠকপ্রিয় সংবাদমাধ্যমগুলো বার বার এমন আঘাতের সম্মুখীন হচ্ছে। সন্দেহ নেই, এসব কুকাজ গণতান্ত্রিক উত্তরণকে বিঘ্নিত করবে এবং জনমনে বিভ্রান্তি ও হতাশার সৃষ্টি করে প্রকারান্তরে স্বৈরতন্ত্র ও ফ্যাসিবাদকেই শক্তিশালী করবে।
ফলে সরকার, রাজনৈতিক দল, গণমাধ্যম ও নাগরিক সমাজকে অত্যন্ত সতর্ক থাকতে হবে মহল বিশেষের অপকর্মের বিরুদ্ধে। 'চিলে কান নিয়েছে' শুনেই দৌঁড় দেওয়া যাবে না। পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে প্রকৃত সত্য উদ্ঘাটন করতে হবে। সবচেয়ে নিরাপদ হলো, মূল পোর্টালের ওয়েবপেজ ও ভেরিফাইড ফেসবুকে পেজে গিয়ে সন্দেহজনক সংবাদ বা তথ্য মিলিয়ে নেওয়া। অসঙ্গতি ধরা পড়লে কর্তৃপক্ষের নজরে আনা। প্রয়োজনে পুলিশের সাইবার ক্রাইম বিভাগকে অপতথ্যের বিষয়টি অবহিত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের সুযোগ দেওয়া।
পুলিশের সাইবার ক্রাইম বিভাগকেও তথ্য মন্ত্রণালয় ও গণমাধ্যমগুলোর সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক ও যোগাযোগ রাখা আবশ্যক। যাতে কোনও গুজব, মিথ্যা, ভুল বা অপতথ্যের উৎপত্তি হলে সঙ্গে সঙ্গে সেসবকে স্বপ্রণোদিত হয়ে আইনের আওতায় এনে দমন করা যায়। পুলিশের সাইবার ক্রাইম বিভাগের দক্ষতায় অপতথ্যের তাণ্ডব রোধ করা সম্ভব হবে বলে আশা করা যায়।
সর্বোপরি, একটি বিপ্লবাত্মক পরিস্থিতি পেরিয়ে গণতন্ত্রে উত্তরণের পথে বিরাজমান শত সঙ্কুলতায় মতলববাজদের দ্বারা উদ্ভূত অপতথ্যের তাণ্ডব নানামুখী বিপদ ও অস্থিরতা সৃষ্টি করতে পারে। আর্থসামাজিক, রাজনৈতিক ক্ষেত্রে আনতে পারে অস্থিতিশীলতার ঝুঁকি। অতএব, এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্টদের সজাগ থাকা অপরিহার্য।
ড. মাহফুজ পারভেজ: অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম; প্রফেসর ও চেয়ারম্যান, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও নির্বাহী পরিচালক, চট্টগ্রাম সেন্টার ফর রিজিওনাল স্টাডিজ, বাংলাদেশ (সিসিআরএসবিডি)।