যোগাযোগের অনন্য শিক্ষক একজন আরেফিন সিদ্দিক

  • মাহমুদ মেনন খান
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

১৯৯১ সাল। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম দিন। কলা ভবনের নিচতলায় সাংবাদিকতা বিভাগের করিডোর ধরে হেঁটে আসছিলেন সটান দীঘল একজন মানুষ। স্যুটেড-ব্যুটেড। একটা গুঞ্জন উঠলো! আরেফিন স্যার, আরেফিন স্যার। আমার স্পষ্ট মনে আছে- স্যার হেঁটে আসছিলেন, হাতে একটি ফাইল জাতীয় কিছু। পাতলা গড়ণের মানুষটি দৃশ্যপটের আর কতটুকুই বা স্থান দখল করেছিলেন! কিন্তু মনে হচ্ছিলো যেনো পুরো দৃশ্যপট জুড়ে তিনিই আছেন। তিনি এগিয়ে যেতে থাকলেন! আমাদের অতিক্রম করে গেলেন। আর ছড়িয়ে দিয়ে গেলেন একটা মুচকি হাসি। এভাবেই স্বাগত জানিয়ে গেলেন নতুন শিক্ষার্থীদের।

মুখে কোনো কথা নয়, কিন্তু যেনো বলে গেলেন অনেক কথা। আরেফিন স্যারের এই মুচকি হাসিটার সাথেই আমরা পরিচিত। মানসপটে লেপ্টে থাকা স্মৃতিতে তার একটি মুচকি হাসির চেহারাই ভেসে ওঠে। আমার ধারণা এই মুচকি হাসির প্রতিক্রিয়াটি তিনি মৃত্যুদূতকেও ছুঁড়ে দিয়েছেন। সেই হাস্যময় মুখাবয়বই স্মৃতিজুড়ে থাকুক অটুট। পরপারে ভালো থাকবেন স্যার।

বিজ্ঞাপন

তো, বলছিলাম আরেফিন স‍্যারের কথা! সটান দীঘল কেতাদুরস্ত মানুষটা মুচকি হাসি দিয়ে জয় করে নিলেন হৃদয়। এরপর যেদিন ক্লাসরুমে এলেন, দিলেন যোগাযোগ বিদ্যার প্রথম পাঠ, আমি কিংবা আমরা মুগ্ধ হয়ে গ্রহণ করলাম সে পাঠ। আন্তঃব‍্যক্তিক যোগাযোগ, অন্তঃব‍্যক্তিক যোগাযোগ তথা গণযোগাযোগের সব ধরণ রকমফের উঠে এলো তার কোর্সের পর কোর্সে দেওয়া যোগাযোগের শিক্ষায়।

আমরা শিখলাম মিথস্ক্রিয়া, শিখলাম ছাঁচিকরণ, কিংবা গভীর থেকে শিখলাম কোহেসিভনেসের মর্মার্থ। আরও শিখলাম মেটা পারসপেক্টিভ, কিংবা মেটা মেটা পারসপেকটিভ! অর্থাৎ আপনার সম্পর্কে আমি কি ভাবি সে সম্পর্কে আপনি কি ভাবেন কিংবা কতটা বুঝতে পারেন সেটা আমি কতটা সঠিকতায় বুঝতে সক্ষম হই সেটাই। আরও শেখালেন যোগাযোগ বৈকল‍্যের সব সংজ্ঞায়ন বিশ্লেষণ, যা আজো মজ্জায় গেঁথে আছে আর ব‍্যবহার করি নিত্য কাজে ও চর্চায়।

বিজ্ঞাপন

তাইতো বুঝতে পারি, মনের গভীরে কোন অভিসন্ধি রেখে ঢাবি কর্তৃপক্ষ ‘পরিবার চায়নি বলে ক‍্যাম্পাসে জানাজা হয়নি’ এমন নাটক সাজিয়েছে! কিংবা কোন মনস্তত্বে এখন আবার বিশ্ববিদ্যালয়ে এক দিনের ছুটি ঘোষণা করছে।

যাক যোগাযোগের পাঠ বিশ্লেষণে বসিনি। কিংবা বসিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকাণ্ডের বিশ্লেষণেও। শুধু বলে রাখি, মনের ভেতর অভিসন্ধি রেখে কেউ কিছু করলে তা অন্তত আরেফিন সিদ্দিকের কাছ থেকে যোগাযোগের পাঠ নেয়া প্রতিটি শিক্ষার্থী অনায়াসে ধরে ফেলতে পারে, এটা মনে রাখবেন।

স্যারের কথায় ফিরি। মাস কয়েক আগে স্যার যখন যুক্তরাষ্ট্রে এসেছিলেন তখন ভার্জিনিয়ায় এসেছিলেন তার মেয়েকে দেখতে। মেয়ে ও জামাতা দুজনই এখানকার স্বনামধন্য জন হপকিনস বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কলারশিপে অধ্যায়নরত। তো সেই সুবাদে আমাদের জনাকয়েক যারা গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা- এমসিজে পরিবারের সদস্য তারা একত্রিত হয়েছিলাম বিভাগেরই অপর প্রাক্তন শিক্ষক ড. সুব্রত শংকর ধরের বাসায়। সে সময় স্যারের সাথে সময় কাটিয়ে ভীষণ আপ্লুত ছিলাম। সেদিনও স্যারের কথা শুনে ছিলাম মুগ্ধ। স্যার বলছিলেন- ‘তোমরা শিক্ষার্থীরা আছো বলেই আমরা শিক্ষক হতে পেরেছি…।’ পরে ফেসবুক পোস্টে লিখেছিলাম, শিক্ষকের বড়ত্বের কৃতিত্ব কিভাবে শিক্ষার্থীকে দিয়ে দেওয়া যায় তা আরেফিন স্যারের কাছ থেকেই শিখতে হবে…।

অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিকের সান্নিধ্যে মাহমুদ মেনন

স্যার তার প্রতিটি শিক্ষার্থীকে নামে চিনতেন। প্রতিটি শিক্ষার্থীর মনস্তত্ব আলাদা করে বুঝতেন। এর অন্যতম কারণ হচ্ছে তিনি শুনতেন। যতবার দেখা হয়েছে কথোপকথন শুরু হয়েছে একটি কথা দিয়ে, স্যার বলতেন- ‘বলো মেনন’। আমি একটি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিতে পারি, এমনটি কারো সাথে কখনোই ঘটেনি যে আরেফিন সিদ্দিক বলছেন, শোনো কিংবা শুনুন। শুধুই বলতেন- ‘বলো কিংবা বলুন’।

যুক্তরাষ্ট্রের সেই সফরের শেষের দিকে স্যার নিউইয়র্কে ছিলেন। তখন সেখানেও এমসিজে পরিবারের সদস্যের একটি সমাবেশ ঘটেছিলো বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী দম্পতি আশরাফুল আলম খোকন ও রিজওয়ানা নুপূরের বাসায়। সেখানেই পুনর্বার অভিজ্ঞতা নিলাম স্যারের ধৈর্য্য় ধরে সকলের কথা শোনার সেই বিরল মনের। পরে ফেসবুকে লিখেছিলাম- ‘পাঠদানে তিনি যেমন অনন্য… সবসময়ই তাকে দেখেছি মনযোগী শ্রোতা হতে… বড়দের কাছে গেলে আমরা কেবলই শুনি, বলতে খুব কমই পারি। কিন্তু স্যারকে মনের কথা বলতে পারিনি এমনটা কোনোদিনই ঘটেনি…।’

যাক স্যার শুনতেন। আর সে কারণেই শিক্ষার্থীরা তথা সকলেই তার কাছে তাদের সমস্যা, চাহিদা, প্রয়োজনে যেতেন। স্যার ধৈর্য্য ধরে শুনতেন। আর বলতেন। ‘দেখা যাক’। এই দেখা যাক উচ্চারণের মধ্যেই তিনি জানিয়ে দিতেন, তিনি চেষ্টা করবেন। এবং করতেন। যারা স্যারের কাছ থেকে উপকারভোগী (সুবিধাভোগীও বলা চলে) তারা জানবেন, তারা সেই সামান্য দেখা যাক- থেকেই তাদের আশানুরূপ ফলটি পেয়ে যেতেন।

কিন্তু সকলেই কি প্রয়োজনে যেতো? না! অনেকেই যেতো অপ্রয়োজনে, স্রেফ স্যারের সাথে দেখা করতে। শিক্ষার্থীদের জন্য তার দরজা ছিলো অবাধ-উন্মুক্ত। তারই সুবিধা নিয়ে কখনো মধ্যরাতে, কখনো মধ্যরাত গড়িয়ে গভীর রাতেও আমরা স্যারের বাসায় গিয়েছি। বিশেষ করে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের সদস্যরা রাতে দীর্ঘ মিটিং শেষ করে স্যারের বাসায় যেতাম। কখনো স্রেফ স্যারের সাথে একটু দেখা করার জন্য। কী যে আন্তরিকতায় স্যার আমাদের সময় দিতেন।

ভাবছেন, ক্যাম্পাসে ভিসির বাড়িতে থাকতেন। সেই সুবাদে এটা সম্ভব হতো। তা নয়। তিনি যখন ভিসি ছিলেন না তার আগেও, পরেও আমাদের সুযোগ হয়েছে স্যারের বাড়িতে যাওয়ার। চা-কফি আর মিষ্টি খাওয়ার। সময় কাটানোর।

সেবার যখন জর্জ অরওয়েলের ‘১৯৮৪’ অনুবাদ প্রকাশিত হলো, স্যারকে দিয়ে এলাম একটি কপি। তার অনেক দিন পর আবার অন্য এক কাজে যখন গেলাম- স্যার বললেন, মেনন তুমি জর্জ অরওয়েলের সবগুলো কাজ অনুবাদ করে ফেলো। তোমার হাতে তার সাহিত্য কর্মের অনুবাদ খুব ভালো হয়। আমি রীতিমতো অবাক- এত ব্যস্ততায় তিনি আমার অনুদিত বইটি পড়েছেন এবং তার সকল কর্ম অনুবাদ করতে বলছেন। বললাম ‘জ্বি স্যার করবো।’ বললাম, ‘অ্যানিম্যাল ফার্ম’ তো আগেই অনুবাদ হয়ে গেছে। ৎ

স্যার বললেন, ‘তাতে কি, তুমি করবে তোমার অনুবাদ।’ আর সেদিনই তিনি আমাকে জানালেন, জর্জ অরওয়েলের আরেকটি বই ‘কিপ দ্য অ্যাস্পেডিস্ট্রা ফ্লাইং’ এর কথা। বললেন, ‘এটি যোগাড় করে অনুবাদ করো। অসাধারণ একটি উপন্যাস।’ ভাবুন তার পাঠের দৌড় কতটা। যাক আমি শুরু করেছিলাম ‘কিপ দ্য অ্যাস্পেডিস্ট্রা ফ্লাইং’ এর অনুবাদ ‘উড়াও শতাবতী’ নামে। এখনো শেষ হয়নি। দুর্ভাগ্য এই বইটি (যদি কখনো প্রকাশিত হয়) স্যারের হাতে তুলে দিতে পারবো না।

স্যারকে নিয়ে নানান কথা হয়, তার উপাচার্য্যের দায়িত্বকালকেই বড় করে দেখা হয়। কিন্তু আমি মনে করি, অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিকের শিক্ষকতার জায়গাটাই সবচেয়ে বড়। সেটাকে তিনি নিজেই বড় করে দেখতেন। যতবার কথা হয়েছে, বলতেন, ‘আমি আসলে ক্লাসরুমেই বেশি সাচ্ছন্দ্য বোধ করি।’ ভিসির দায়িত্ব পাওয়ার পর- এটাই বলতেন, ‘আমি ক্লাসরুমে ফিরতে চাই’। আর সে কারণেই ভিসির দায়িত্বে থাকা কালেও নিয়মিত ক্লাস নিতেন।

আরেফিন সিদ্দিক মনে করতেন, ভিসি হিসেবে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়কে তেমন কিছুই দিতে পারবেন না। তার কারণও তিনি জানতেন। অনেক আলোচনায় বলতেনও এখানে কাজ করাটা কতটা কঠিন। কিন্তু তার মধ্যেও তারই সময়ে বিশ্ববিদ্যালয় হয়েছিলো সেশনজট মুক্ত। এই একটি কাজ সফলতার সাথে করে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজার হাজার শিক্ষার্থীর জীবন থেকে দুই কিংবা তিনটি বছর করে বাঁচিয়ে দিয়েছেন। এটা যে কতবড় অবদান তা এর সুবিধাভোগী শিক্ষার্থীরা যতটা অনুধাবন করতে পারবে তার চেয়ে বেশি অনুধাবন করবে যারা এর আগে সেশন জটের কবলে পড়ে এক ক্যাম্পাসেই চার বছরের পাঠ সাত কিংবা আট বছরে শেষ করেছিলো তারা।

যাক আরেফিন সিদ্দিক তার অর্জনটাকে ফলাও করে প্রচার করতে চাইতেন না। বরং ব্যর্থ হচ্ছেন যেখানে সেখানটাই কি করে সারিয়ে তোলা যায় তা নিয়ে তার প্রচেষ্টা থাকতো। আমার সাংবাদিকতা ক্যারিয়ারে তাকে অন্তত তিনবার পূর্ণাঙ্গ সাক্ষাৎকারে পেয়েছি। ধৈর্য্য ধরে সকল সরল, কঠিন কিংবা নির্বোধ প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন। নিজের ব্যর্থতা বা অক্ষমতার কথা বলেছেন অকপটে।

বিশ্ববিদ্যালয়ে যেবার প্রশ্নপত্র ফাঁসের কারণে ভর্তিপরীক্ষা বাতিল হলো- সে ফাঁসের খবর তখন প্রকাশিত হয়েছিলো আমারই হাতে, বিশ্ববিদ্যালয় করেসপন্ডেন্টের মাধ্যমে। সে ঘটনা বিশ্ববিদ্যালয়কে তখন বিপাকে যেমন ফেলেছিলো, কিছুটা বিব্রত স্যারও ছিলেন। কিন্তু কোনো দিন কোন সাক্ষাতে তিনি সে কথা আমাকে বলেননি।

বরং আমার কেনো যেনো মনে হয়, তারই শিক্ষার্থী যখন একটি যোগ্য অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার উদাহরণ সৃষ্টি করে তখন তাতে তিনি গর্বিতই বেশি হতেন। হোক সে তার ব্যক্তিগত ক্ষতি কিংবা বিব্রত হওয়ার কারণ। এটাই আরেফিন সিদ্দিক। অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক। যিনি পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে পরপারে পারি জমিয়েছেন গত ১৩ মার্চ। পৃথিবীতে রেখে গেছেন তার অনন্য ব্যক্তিত্ব ও একটি মুচকি হাসি। যা তার সহস্র শিক্ষার্থী তাকে নিয়ে ভাবলেই দেখতে পায় চোখের সামনে ভাসছে। আর ভাসবে বহুকাল।

লেখক: শিক্ষক, ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি, ভার্জিনিয়া, যুক্তরাষ্ট্র।