যাত্রী স্বল্পতায় বাংলাদেশ থেকে ভারতের বিভিন্ন গন্তব্যে ফ্লাইট পরিচালনা ব্যাহত
মো. কামরুল ইসলাম
|
যাত্রী স্বল্পতায় বাংলাদেশ থেকে ভারতের বিভিন্ন গন্তব্যে ফ্লাইট পরিচালনা ব্যাহত
যুক্তিতর্ক
আন্তর্জাতিক কিংবা আঞ্চলিক যেকোনো বিবেচনায় বাংলাদেশ থেকে ভারতের বিভিন্ন গন্তব্যে ভ্রমণের জন্য বাংলাদেশি যাত্রীদের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয় মাধ্যম আকাশপথ। অথচ জুলাই মাসের মাঝামাঝি থেকে আজ অবধি বাংলাদেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে যাত্রী সংখ্যা ক্রমাগত হ্রাস পাচ্ছে। ৫ আগস্টের পর ভারতের ভিসা ইস্যূ সংক্রান্ত জটিলতার জন্য বাংলাদেশ থেকে জনপ্রিয় গন্তব্য ভারতের কলকাতা, চেন্নাই, দিল্লীসহ বিভিন্ন রুটে যাত্রীসংখ্যা স্মরণকালের মধ্যে নিম্নগতি দেখা যাচ্ছে।
ভ্রমণপিপাসু বাংলাদেশীরা পর্যটন ভিসার মাধ্যমে কলকাতা, দিল্লী ভ্রমণ, চিকিৎসা সেবা নেয়ার জন্য মেডিকেল ভিসার মাধ্যমে চেন্নাই, হায়দ্রাবাদ ভ্রমণ করে থাকে। এছাড়া বিভিন্ন কারন বিশেষ করে, ব্যবসায় সংক্রান্ত, শিক্ষার জন্য বাংলাদেশ থেকে অনেকে ভারতের বিভিন্ন গন্তব্যে ভ্রমণ করে থাকে।
বিজ্ঞাপন
বাংলাদেশ থেকে দেশীয় এয়ারলাইন্স জাতীয় বিমান সংস্থা বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স, অন্যতম বৃহৎ বেসরকারী বিমান সংস্থা ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স, ঢাকা-কলকাতা রুটে পরিচালনাকারী এয়ারলাইন্স নভো এয়ার অস্বাভাবিক যাত্রী স্বল্পতার জন্য আগস্টের শুরু থেকেই প্রতিটি বিমান সংস্থা উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ফ্লাইট বাতিল করতে বাধ্য হয়েছে।
ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স ঢাকা থেকে কলকাতা প্রতিদিন ২টি করে ফ্লাইট পরিচালনা করতো, যা সপ্তাহে ১৪টি ফ্লাইট। কিন্তু পরিস্থিতি বিবেচনায় বর্তমানে সপ্তাহে মাত্র ছয়টি ফ্লাইট পরিচালনা করছে। চট্টগ্রাম থেকে প্রতিদিন একটি ফ্লাইট পরিচালনা করে আসছিলো কিন্তু যাত্রী স্বল্পতার কারনে বর্তমানে চট্টগ্রাম-কলকাতা রুটে ফ্লাইট পরিচালনা বন্ধ রাখতে হয়েছে। চিকিৎসা সেবা গ্রহণ করার জন্য বাংলাদেশ থেকে রেকর্ডসংখ্যক যাত্রী চেন্নাই ভ্রমণ করে থাকে। ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স সপ্তাহে ১১টি ফ্লাইট পরিচালনা করছিলো কিন্তু বর্তমানে ঢাকা-চেন্নাই রুটে সপ্তাহে মাত্র ৬টি ফ্লাইট পরিচালনা করে থাকে।
বিজ্ঞাপন
কলকাতা রুটে চলাচলকারী নভোএয়ার যাত্রী স্বল্পতার জন্য সাময়িকভাবে বন্ধ রেখেছে ।বেসরকারী এয়ারলাইন্সের পাশাপাশি জাতীয় বিমান সংস্থা বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স ঢাকা-কলকাতা রুটে সপ্তাহে ১৪টি ফ্লাইটের পরিবর্তে বর্তমানে ৭টি ফ্লাইট পরিচালনা করছে। অন্যদিকে ঢাকা-চেন্নাই রুটে সপ্তাহে ৭টির পরিবর্তে ৩টি ফ্লাইট পরিচালনা করছে।
একই চিত্র ভারতের বিমান সংস্থাগুলোর বাংলাদেশে চলাচালকারী বিভিন্ন রুটে যাত্রী সংখ্যা নিম্নমূখী, যা দৃশ্যমান।
বাংলাদেশ থেকে ভারতের বিভিন্ন গন্তব্যে ভ্রমণকারী যাত্রীরা ভিসা ইস্যূর প্রক্রিয়া স্বাভাবিক না হওয়ায় চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে সময় অতিবাহিত করছে। অনেকে জরুরী প্রয়োজনে ভারত ভ্রমণ করতে পারছে না। পার্শ্ববর্তী দু’দেশের আর্থ-সামাজিকসহ নাগরিকদের সকল ধরনের সম্পর্কের স্বাভাবিকতা বজায় রাখার জন্য দু’দেশের নীতি-নির্ধারকদের দ্রুতলয়ে এগিয়ে আসার আহবান জানাচ্ছে ভারত ভ্রমণে ইচ্ছুক নাগরিকরা। বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে ভিসা জটিলতার কারনে নাগরিকদের যাতায়াত বন্ধ হয়ে গেলে দু’দেশের আকাশপথ প্রায় রুদ্ধ হয়ে যাবে, যা কোনোভাবে কাম্য নয়। ফলে বিমান চলাচল ও পর্যটন খাত হুমকির মুখে পরবে।
সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী, ডাক নাম মনি। এপেক্স ফুটওয়্যার লিমিটেডের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারপারসন। প্রতিষ্ঠা করেছেন এপেক্স ট্যানারি লিমিটেড, এপেক্স ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড, এপেক্স ফার্মা লিমিটেড, বুø ওশান ফুটওয়্যার লিমিটেড। বাংলাদেশের অন্যতম খ্যাতিমান শিল্পপতি, ব্যবসায়ী নেতা ও জনহিতৈষী সৈয়দ মঞ্জুর এলাহীর মৃত্যুতে দেশ একজন উজ্জ্বল নক্ষত্র হারাল। দেশের বাণিজ্য, অর্থনীতি ও শিল্প খাতে তাঁর অবদান চিরকাল স্মরণীয় থাকবে। গতকাল সকালে সিঙ্গাপুরের একটি হাসপতালে শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৩ বছর।
১৯৪২ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর কলকাতায় জন্মগ্রহন করেন তিনি। তাঁর বাবা স্যার সৈয়দ নাসিম আলী ছিলেন প্রথম বাঙালি মুসলিম বিচারক, ১৯৩৩ সালে কলকাতা হাই কোর্টের বিচারক হিসেবে নিয়োগ পান। পাঁচ বছর বয়সে বাবা মারা যান। বড় ও সেজ ভাইয়ের তত্ত্বাবধানে বেড়ে ওঠা তাঁর। বড় ভাই ছিলেন সমাজসেক, মেজ ভাই ধার্মিক, সেজ ভাই কলকাতা কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠাতা। ছোটবেলা থেকেই তিনি ছিলেন একরোখা। কারও কথা শুনতেন না। বড় ভাই এস এ মাসুদ যুক্তরাজ্যের কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইন বিষয়ে উচ্চতর ডিগ্রি নেন। পরে তিনিও কলকাতা হাই কোর্টের বিচারক ছিলেন। বাবার মতো তিনিও ১৯৭৭ সালে প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পান। আর মেজ ভাই এস এ মওদুদ বিলেত থেকে ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পড়াশোনা শেষ করে যোগ দেন সিভিল সার্ভিসে। আর সেজ ভাই এস এ মনসুর ছিলেন ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠাতা সদস্য।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স পরীক্ষা দিয়েই ১ হাজার ৯০০ রুপিতে পাকিস্তান টোব্যাকোর ফাইন্যান্স বিভাগে চাকরি নেন। প্রবেশন পিরিয়ড শেষ হওয়ার ছয় মাস আগে এবং যোগদানের ১৮ মাসের মাথায় ১৯৬৬ সালের অক্টোবরে তাঁর চাকরি স্থায়ী করা হয়। পরের মাস নভেম্বরের ১ তারিখে জয়পুরহাটের সংসদ সদস্য মফিজ চৌধুরীর মেয়ে নিলুফারকে বিয়ে করেন। ১৯৭০ সালে রাজনৈতিক পরিস্থিতি উত্তপ্ত হলে তাঁকে পুর্ব পাকিস্তানে (ঢাকায়) বদলি করা হয়। ঢাকা এসে পরিস্থিতি আরও খারাপ হওয়ায় পরবর্তী সময়ে বদলি করা হয় লন্ডনে প্রধান কার্যালয়ে। শর্ত দেওয়া হয়েছিল তিনি লন্ডনে বসবাসের আবেদন করতে পারবেন না এবং স্বাধীনতার পর দেশে ফিরে আসবেন। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীনের পর ২৫ ডিসেম্বর লন্ডন থেকে কলকাতা হয়ে পরিবার ও আত্মীয়স্বজন নিয়ে বাংলাদেশে আসেন ১৯৭২ সালের জানুয়ারিতে। মঞ্জুর এলাহীর শ্বশুর মফিজ চৌধুরীর কাছের বন্ধু ছিলেন সঞ্চয় সেন। ভারতের চামড়াশিল্পে রাজার মতো ছিলেন সঞ্চয় সেন। ভারতের সবচেয় বড় ট্যানারির মালিক ছিলেন সঞ্চয় সেনের বাবা। সঞ্চয় সেন ফেডারেশন অব ইন্ডিয়ান চেম্বারস অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফআইসিসিআই) সভাপতি ছিলেন। একটি ডেলিগেশন নিয়ে বাংলাদেশে আসেন তিনি। ১৯৭২ সালের মে অথবা জুন মাসের কোনো একদিন সৈয়দ মঞ্জুর এলাহীর শ্বশুর মফিজ চৌধুরী তাঁর বাসায় লিহাই ইউনিভার্সিটি বন্ধু এফআইসিসিআইর সভাপতি সঞ্চয় সেন ও অন্য সফরসঙ্গীদের নৈশভোজের আয়োজন করেন। সেখানে সৈয়দ মঞ্জুর এলাহীর সঙ্গে কথা হয় এক ফরাসি ব্যবসায়ীর। রেমন্ড ক্লেয়ার নামের ওই ফরাসি ব্যবসায়ী মঞ্জুর এলাহীকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, তুমি কী করো? মঞ্জুর এলাহী বলেন, চাকরি। মঞ্জুর এলাহীও জানতে চেয়েছিলেন তুমি কী করো, বলেন, ব্যবসা করি। ফ্রান্স থেকে রাসায়নিক আমদানি করি। আবার ঢাকা থেকে চামড়া কিনে ফ্রান্স নিয়ে যাই। দেশের পরিস্থিতি ভালো না হওয়ায় মঞ্জুর এলাহীর বিশ্বাস হচ্ছিল না। এ ছাড়া চট্টগ্রাম বন্দরও বন্ধ। তখন ফরাসি ব্যবসায়ীকে জিজ্ঞেস করেন, চামড়া কীভাবে নেন। জবাবে ওই ব্যবসায়ী বলেন, কার্গো উড়োজাহাজ পুরোটা ভাড়া নিয়ে রাসায়নিক আনি, তারপর আবার চামড়া কিনে সেটিতে ভরে নিয়ে যাই। ফরাসি ব্যবসায়ী তাঁর কোম্পানিতে জয়েন করার প্রস্তাব দিলে সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী তখন হেসে উড়িয়ে দিয়ে বলেন, আমি ভালো চাকরি করি। মাইনে ভালো। তোমার কোম্পানিতে কেন জয়েন করব। ব্যবসায়ী বলেন, আমি জয়েন করতে বলছি না। তোমাকে আমার কোম্পানির এজেন্ট হতে বলছি। কমিশনে ব্যবসা করবে।
মঞ্জুর এলাহী তখন কৌতূহলী হয়ে জানতে চাইলেন, কেমন কমিশন। রেমন্ড ক্লেয়ার জানান, এত এত কমিশন পাবে। হিসাব করে দেখেন অনেক টাকা। নৈশভোজ শেষে সবাই চলে যাওয়ার পর শ্বশুর এবং সঞ্চয় সেন বসে ছিলেন। তখন মঞ্জুর এলাহী ফরাসি ব্যবসায়ীর প্রস্তাবের কথা শ্বশুরকে জানান। তাঁর শ্বশুর কোনো কথা না বললেও সঞ্চয় সেন ছিলেন এক্সাইটেড। বলেন, ভালো তো। আমি ওদের হল্যান্ডার ফ্রান্স কোম্পানির প্রতিনিধিত্ব করি। আমার কাছে লোক চেয়েছিল, আমি ভুলে গেছিলাম। তুমি এই প্রস্তাবে রাজি হয়ে যাও। কিন্তু সমস্যা বাধল অন্যখানে। চাকরি ছেড়ে ব্যবসা করার কথা বউকে জানালে তিনি হেসে উড়িয়ে দেন। বড় ভাইকে জানালে তিনিও হাসেন। বলেন, ভালো চাকরি করছ। তখন মঞ্জুর এলাহীর মধ্যে জেদ চাপল। শ্বশুরের সঙ্গে দেখা করে বিষয়টি জানালেন। শ্বশুর অভয় দিয়ে বলেন, ভালো তো, করো। তখন বলেন, আপনার মেয়ে তো রাজি হচ্ছে না। তিনি বললেন, আমি রাজি করাব। ১৯৭২ সালের জুলাই বা আগস্টের দিকে। তখন মঞ্জুর এলাহীর বয়স ৩০ বছর। চাকরি ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। ফরাসি ব্যবসায়ীর এজেন্ট হিসেবে কাজ শুরু করলেন। কয়েকবার বিমানে করে ফ্রান্সেও গেছেন।
হাজারীবাগ থেকে চামড়া কিনে রেমন্ড ক্লেয়ারের হল্যান্ডার গ্রুপের কাছে কমিশনে বিক্রি করতে থাকেন সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী। ১৯৭৫ সালে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর সরকার ট্যানারি বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেওয়ার উদ্যোগ নিলে ১২ লাখ ২২ হাজার টাকায় ওরিয়েন্ট ট্যানারি কিনে নেন মঞ্জুর এলাহী। সেখানে ছিল কিছু জমি, টিনশেডের ঘর এবং কয়েকটি ড্রাম। সেই কারখানাকে সংস্কার করে ১৯৭৬ সালে যাত্রা শুরু করে এপেক্স ট্যানারি। ট্যানারিতে চামড়া প্রক্রিয়াজাত করে রপ্তানি করা শুরু করেন সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী। জাপানি ক্রেতা প্রতিষ্ঠান মিজুজে ছিল চামড়ার প্রথম ক্রেতা। ১৪ বছর পর গাজীপুরের সফিপুরে ৫০ বিঘা জমিতে জুতার কারখানা স্থাপনের কাজ শুরু করেন। ১৯৯০ সালে দেশে ফিরে প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত হন একমাত্র ছেলে সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর।
ছোটবেলা থেকেই তাঁর স্বপ্ন ছিল একটা কারখানা করার এবং সেখানে কিছু কর্মসংস্থান হবে। মানুষের চাকরি হবে। কিসের কারখানা করবেন সেটা তাঁর কাছে পরিষ্কার ছিল না। এটুকু ছিল একটা ম্যানুফ্যাকচারিং ফ্যাক্টরি করবেন। তাঁর সেই স্বপ্ন তিনি পূরণ করেছেন। কয়েক দশকের কর্মজীবনে সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী বাংলাদেশের আর্থিক ও শিল্প খাতের রূপান্তরে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তিনি মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক লিমিটেড এবং পাইওনিয়ার ইনস্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেডের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ছিলেন। এ ছাড়া তিনি দেশের অন্যতম সফল ব্যবসায়িক গোষ্ঠী এপেক্স গ্রুপের চেয়ারম্যান ছিলেন। ব্যবসায়িক দক্ষতার জন্য তিনি বহু পুরস্কারে ভূষিত হন। যার মধ্যে ‘বিজনেস এক্সিকিউটিভ অব দ্য ইয়ার ২০০০’ (আমেরিকান চেম্বার অব কমার্স, বাংলাদেশ) এবং ‘বিজনেস পারসন অব দ্য ইয়ার ২০০২’ উল্লেখযোগ্য। তাঁর জীবনব্যাপী অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তাঁকে ‘লাইফটাইম অ্যাচিভমেন্ট অ্যাওয়ার্ড’ প্রদান করা হয়েছিল ইউকে-বাংলাদেশ কেটালিস্টস অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি থেকে।
ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি মঞ্জুর এলাহী জনসেবার প্রতি নিবেদিত ছিলেন। তিনি ১৯৯৬ ও ২০০১ সালে দুইবার বাংলাদেশের সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন, যেখানে তাঁর পেশাদারিত এবং নেতৃত্ব ব্যাপকভাবে প্রশংসিত হয়েছিল। ক্রেডিট রেটিং এজেন্সি অব বাংলাদেশ (সিআরএবি), সানবিমস স্কুল লিমিটেড এবং এমটিবি ফাউন্ডেশনের মতো বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান হিসেবেও তিনি অবদান রেখেছেন। এ ছাড়াও তিনি ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি), ডায়াবেটিক অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশ ফ্রিডম ফাউন্ডেশনের প্রভাবশালী বোর্ড সদস্য ছিলেন।
কলকাতায় জন্মগ্রহণ করা মঞ্জুর এলাহী সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ থেকে অর্থনীতিতে স্নাতক ডিগ্রি অর্জনের পর পরিবারের সঙ্গে ঢাকায় চলে আসেন। পরবর্তী সময়ে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। তিনি ঢাকা ইউনিভার্সিটি অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের (ডিইউএএ) প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন, যা তাঁর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আজীবন সংযোগকে দৃঢ় করে।
বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকসের (বিএবি) চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব পাবলিকলি লিস্টেড কোম্পানিজের (বিএপিএলসি) ভাইস চেয়ারম্যান এবং বাংলাদেশ ব্যাংক, সোনালী ব্যাংক ও বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের পরিচালক হিসেবেও তিনি দায়িত্ব পালন করেন। তিনি মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এমসিসিআই) এবং বাংলাদেশ এমপ্লয়ার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিইএ) প্রেসিডেন্ট ছিলেন, যা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং করপোরেট উৎকর্ষের প্রতি তাঁর অঙ্গীকারকে তুলে ধরে। এ ছাড়াও সমাজকল্যাণ ও দানশীল কাজের প্রতি তাঁর গভীর আগ্রহ ছিল। তিনি অসংখ্য দাতব্য সংস্থার সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত ছিলেন, যা সমাজের প্রতি তাঁর দায়বদ্ধতার প্রতিফলন। অবসরে তিনি সত্যজিৎ রায় নির্মিত ছবি দেখতেন। তাঁর প্রিয় নায়ক ছিলেন দীলিপ কুমার। সৈয়দ মঞ্জুর এলাহীর ছেলে সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর এবং মেয়ে মুনিজে মঞ্জুর। করোনার প্রথম ঢেউয়ে সৈয়দ মঞ্জুর এলাহীর জীবনসঙ্গী নিলুফার মঞ্জুর করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন।
১৯৯১ সাল। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম দিন। কলা ভবনের নিচতলায় সাংবাদিকতা বিভাগের করিডোর ধরে হেঁটে আসছিলেন সটান দীঘল একজন মানুষ। স্যুটেড-ব্যুটেড। একটা গুঞ্জন উঠলো! আরেফিন স্যার, আরেফিন স্যার। আমার স্পষ্ট মনে আছে- স্যার হেঁটে আসছিলেন, হাতে একটি ফাইল জাতীয় কিছু। পাতলা গড়ণের মানুষটি দৃশ্যপটের আর কতটুকুই বা স্থান দখল করেছিলেন! কিন্তু মনে হচ্ছিলো যেনো পুরো দৃশ্যপট জুড়ে তিনিই আছেন। তিনি এগিয়ে যেতে থাকলেন! আমাদের অতিক্রম করে গেলেন। আর ছড়িয়ে দিয়ে গেলেন একটা মুচকি হাসি। এভাবেই স্বাগত জানিয়ে গেলেন নতুন শিক্ষার্থীদের।
মুখে কোনো কথা নয়, কিন্তু যেনো বলে গেলেন অনেক কথা। আরেফিন স্যারের এই মুচকি হাসিটার সাথেই আমরা পরিচিত। মানসপটে লেপ্টে থাকা স্মৃতিতে তার একটি মুচকি হাসির চেহারাই ভেসে ওঠে। আমার ধারণা এই মুচকি হাসির প্রতিক্রিয়াটি তিনি মৃত্যুদূতকেও ছুঁড়ে দিয়েছেন। সেই হাস্যময় মুখাবয়বই স্মৃতিজুড়ে থাকুক অটুট। পরপারে ভালো থাকবেন স্যার।
তো, বলছিলাম আরেফিন স্যারের কথা! সটান দীঘল কেতাদুরস্ত মানুষটা মুচকি হাসি দিয়ে জয় করে নিলেন হৃদয়। এরপর যেদিন ক্লাসরুমে এলেন, দিলেন যোগাযোগ বিদ্যার প্রথম পাঠ, আমি কিংবা আমরা মুগ্ধ হয়ে গ্রহণ করলাম সে পাঠ। আন্তঃব্যক্তিক যোগাযোগ, অন্তঃব্যক্তিক যোগাযোগ তথা গণযোগাযোগের সব ধরণ রকমফের উঠে এলো তার কোর্সের পর কোর্সে দেওয়া যোগাযোগের শিক্ষায়।
আমরা শিখলাম মিথস্ক্রিয়া, শিখলাম ছাঁচিকরণ, কিংবা গভীর থেকে শিখলাম কোহেসিভনেসের মর্মার্থ। আরও শিখলাম মেটা পারসপেক্টিভ, কিংবা মেটা মেটা পারসপেকটিভ! অর্থাৎ আপনার সম্পর্কে আমি কি ভাবি সে সম্পর্কে আপনি কি ভাবেন কিংবা কতটা বুঝতে পারেন সেটা আমি কতটা সঠিকতায় বুঝতে সক্ষম হই সেটাই। আরও শেখালেন যোগাযোগ বৈকল্যের সব সংজ্ঞায়ন বিশ্লেষণ, যা আজো মজ্জায় গেঁথে আছে আর ব্যবহার করি নিত্য কাজে ও চর্চায়।
তাইতো বুঝতে পারি, মনের গভীরে কোন অভিসন্ধি রেখে ঢাবি কর্তৃপক্ষ ‘পরিবার চায়নি বলে ক্যাম্পাসে জানাজা হয়নি’ এমন নাটক সাজিয়েছে! কিংবা কোন মনস্তত্বে এখন আবার বিশ্ববিদ্যালয়ে এক দিনের ছুটি ঘোষণা করছে।
যাক যোগাযোগের পাঠ বিশ্লেষণে বসিনি। কিংবা বসিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকাণ্ডের বিশ্লেষণেও। শুধু বলে রাখি, মনের ভেতর অভিসন্ধি রেখে কেউ কিছু করলে তা অন্তত আরেফিন সিদ্দিকের কাছ থেকে যোগাযোগের পাঠ নেয়া প্রতিটি শিক্ষার্থী অনায়াসে ধরে ফেলতে পারে, এটা মনে রাখবেন।
স্যারের কথায় ফিরি। মাস কয়েক আগে স্যার যখন যুক্তরাষ্ট্রে এসেছিলেন তখন ভার্জিনিয়ায় এসেছিলেন তার মেয়েকে দেখতে। মেয়ে ও জামাতা দুজনই এখানকার স্বনামধন্য জন হপকিনস বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কলারশিপে অধ্যায়নরত। তো সেই সুবাদে আমাদের জনাকয়েক যারা গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা- এমসিজে পরিবারের সদস্য তারা একত্রিত হয়েছিলাম বিভাগেরই অপর প্রাক্তন শিক্ষক ড. সুব্রত শংকর ধরের বাসায়। সে সময় স্যারের সাথে সময় কাটিয়ে ভীষণ আপ্লুত ছিলাম। সেদিনও স্যারের কথা শুনে ছিলাম মুগ্ধ। স্যার বলছিলেন- ‘তোমরা শিক্ষার্থীরা আছো বলেই আমরা শিক্ষক হতে পেরেছি…।’ পরে ফেসবুক পোস্টে লিখেছিলাম, শিক্ষকের বড়ত্বের কৃতিত্ব কিভাবে শিক্ষার্থীকে দিয়ে দেওয়া যায় তা আরেফিন স্যারের কাছ থেকেই শিখতে হবে…।
অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিকের সান্নিধ্যে মাহমুদ মেনন
স্যার তার প্রতিটি শিক্ষার্থীকে নামে চিনতেন। প্রতিটি শিক্ষার্থীর মনস্তত্ব আলাদা করে বুঝতেন। এর অন্যতম কারণ হচ্ছে তিনি শুনতেন। যতবার দেখা হয়েছে কথোপকথন শুরু হয়েছে একটি কথা দিয়ে, স্যার বলতেন- ‘বলো মেনন’। আমি একটি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিতে পারি, এমনটি কারো সাথে কখনোই ঘটেনি যে আরেফিন সিদ্দিক বলছেন, শোনো কিংবা শুনুন। শুধুই বলতেন- ‘বলো কিংবা বলুন’।
যুক্তরাষ্ট্রের সেই সফরের শেষের দিকে স্যার নিউইয়র্কে ছিলেন। তখন সেখানেও এমসিজে পরিবারের সদস্যের একটি সমাবেশ ঘটেছিলো বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী দম্পতি আশরাফুল আলম খোকন ও রিজওয়ানা নুপূরের বাসায়। সেখানেই পুনর্বার অভিজ্ঞতা নিলাম স্যারের ধৈর্য্য় ধরে সকলের কথা শোনার সেই বিরল মনের। পরে ফেসবুকে লিখেছিলাম- ‘পাঠদানে তিনি যেমন অনন্য… সবসময়ই তাকে দেখেছি মনযোগী শ্রোতা হতে… বড়দের কাছে গেলে আমরা কেবলই শুনি, বলতে খুব কমই পারি। কিন্তু স্যারকে মনের কথা বলতে পারিনি এমনটা কোনোদিনই ঘটেনি…।’
যাক স্যার শুনতেন। আর সে কারণেই শিক্ষার্থীরা তথা সকলেই তার কাছে তাদের সমস্যা, চাহিদা, প্রয়োজনে যেতেন। স্যার ধৈর্য্য ধরে শুনতেন। আর বলতেন। ‘দেখা যাক’। এই দেখা যাক উচ্চারণের মধ্যেই তিনি জানিয়ে দিতেন, তিনি চেষ্টা করবেন। এবং করতেন। যারা স্যারের কাছ থেকে উপকারভোগী (সুবিধাভোগীও বলা চলে) তারা জানবেন, তারা সেই সামান্য দেখা যাক- থেকেই তাদের আশানুরূপ ফলটি পেয়ে যেতেন।
কিন্তু সকলেই কি প্রয়োজনে যেতো? না! অনেকেই যেতো অপ্রয়োজনে, স্রেফ স্যারের সাথে দেখা করতে। শিক্ষার্থীদের জন্য তার দরজা ছিলো অবাধ-উন্মুক্ত। তারই সুবিধা নিয়ে কখনো মধ্যরাতে, কখনো মধ্যরাত গড়িয়ে গভীর রাতেও আমরা স্যারের বাসায় গিয়েছি। বিশেষ করে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের সদস্যরা রাতে দীর্ঘ মিটিং শেষ করে স্যারের বাসায় যেতাম। কখনো স্রেফ স্যারের সাথে একটু দেখা করার জন্য। কী যে আন্তরিকতায় স্যার আমাদের সময় দিতেন।
ভাবছেন, ক্যাম্পাসে ভিসির বাড়িতে থাকতেন। সেই সুবাদে এটা সম্ভব হতো। তা নয়। তিনি যখন ভিসি ছিলেন না তার আগেও, পরেও আমাদের সুযোগ হয়েছে স্যারের বাড়িতে যাওয়ার। চা-কফি আর মিষ্টি খাওয়ার। সময় কাটানোর।
সেবার যখন জর্জ অরওয়েলের ‘১৯৮৪’ অনুবাদ প্রকাশিত হলো, স্যারকে দিয়ে এলাম একটি কপি। তার অনেক দিন পর আবার অন্য এক কাজে যখন গেলাম- স্যার বললেন, মেনন তুমি জর্জ অরওয়েলের সবগুলো কাজ অনুবাদ করে ফেলো। তোমার হাতে তার সাহিত্য কর্মের অনুবাদ খুব ভালো হয়। আমি রীতিমতো অবাক- এত ব্যস্ততায় তিনি আমার অনুদিত বইটি পড়েছেন এবং তার সকল কর্ম অনুবাদ করতে বলছেন। বললাম ‘জ্বি স্যার করবো।’ বললাম, ‘অ্যানিম্যাল ফার্ম’ তো আগেই অনুবাদ হয়ে গেছে। ৎ
স্যার বললেন, ‘তাতে কি, তুমি করবে তোমার অনুবাদ।’ আর সেদিনই তিনি আমাকে জানালেন, জর্জ অরওয়েলের আরেকটি বই ‘কিপ দ্য অ্যাস্পেডিস্ট্রা ফ্লাইং’ এর কথা। বললেন, ‘এটি যোগাড় করে অনুবাদ করো। অসাধারণ একটি উপন্যাস।’ ভাবুন তার পাঠের দৌড় কতটা। যাক আমি শুরু করেছিলাম ‘কিপ দ্য অ্যাস্পেডিস্ট্রা ফ্লাইং’ এর অনুবাদ ‘উড়াও শতাবতী’ নামে। এখনো শেষ হয়নি। দুর্ভাগ্য এই বইটি (যদি কখনো প্রকাশিত হয়) স্যারের হাতে তুলে দিতে পারবো না।
স্যারকে নিয়ে নানান কথা হয়, তার উপাচার্য্যের দায়িত্বকালকেই বড় করে দেখা হয়। কিন্তু আমি মনে করি, অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিকের শিক্ষকতার জায়গাটাই সবচেয়ে বড়। সেটাকে তিনি নিজেই বড় করে দেখতেন। যতবার কথা হয়েছে, বলতেন, ‘আমি আসলে ক্লাসরুমেই বেশি সাচ্ছন্দ্য বোধ করি।’ ভিসির দায়িত্ব পাওয়ার পর- এটাই বলতেন, ‘আমি ক্লাসরুমে ফিরতে চাই’। আর সে কারণেই ভিসির দায়িত্বে থাকা কালেও নিয়মিত ক্লাস নিতেন।
আরেফিন সিদ্দিক মনে করতেন, ভিসি হিসেবে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়কে তেমন কিছুই দিতে পারবেন না। তার কারণও তিনি জানতেন। অনেক আলোচনায় বলতেনও এখানে কাজ করাটা কতটা কঠিন। কিন্তু তার মধ্যেও তারই সময়ে বিশ্ববিদ্যালয় হয়েছিলো সেশনজট মুক্ত। এই একটি কাজ সফলতার সাথে করে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজার হাজার শিক্ষার্থীর জীবন থেকে দুই কিংবা তিনটি বছর করে বাঁচিয়ে দিয়েছেন। এটা যে কতবড় অবদান তা এর সুবিধাভোগী শিক্ষার্থীরা যতটা অনুধাবন করতে পারবে তার চেয়ে বেশি অনুধাবন করবে যারা এর আগে সেশন জটের কবলে পড়ে এক ক্যাম্পাসেই চার বছরের পাঠ সাত কিংবা আট বছরে শেষ করেছিলো তারা।
যাক আরেফিন সিদ্দিক তার অর্জনটাকে ফলাও করে প্রচার করতে চাইতেন না। বরং ব্যর্থ হচ্ছেন যেখানে সেখানটাই কি করে সারিয়ে তোলা যায় তা নিয়ে তার প্রচেষ্টা থাকতো। আমার সাংবাদিকতা ক্যারিয়ারে তাকে অন্তত তিনবার পূর্ণাঙ্গ সাক্ষাৎকারে পেয়েছি। ধৈর্য্য ধরে সকল সরল, কঠিন কিংবা নির্বোধ প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন। নিজের ব্যর্থতা বা অক্ষমতার কথা বলেছেন অকপটে।
বিশ্ববিদ্যালয়ে যেবার প্রশ্নপত্র ফাঁসের কারণে ভর্তিপরীক্ষা বাতিল হলো- সে ফাঁসের খবর তখন প্রকাশিত হয়েছিলো আমারই হাতে, বিশ্ববিদ্যালয় করেসপন্ডেন্টের মাধ্যমে। সে ঘটনা বিশ্ববিদ্যালয়কে তখন বিপাকে যেমন ফেলেছিলো, কিছুটা বিব্রত স্যারও ছিলেন। কিন্তু কোনো দিন কোন সাক্ষাতে তিনি সে কথা আমাকে বলেননি।
বরং আমার কেনো যেনো মনে হয়, তারই শিক্ষার্থী যখন একটি যোগ্য অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার উদাহরণ সৃষ্টি করে তখন তাতে তিনি গর্বিতই বেশি হতেন। হোক সে তার ব্যক্তিগত ক্ষতি কিংবা বিব্রত হওয়ার কারণ। এটাই আরেফিন সিদ্দিক। অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক। যিনি পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে পরপারে পারি জমিয়েছেন গত ১৩ মার্চ। পৃথিবীতে রেখে গেছেন তার অনন্য ব্যক্তিত্ব ও একটি মুচকি হাসি। যা তার সহস্র শিক্ষার্থী তাকে নিয়ে ভাবলেই দেখতে পায় চোখের সামনে ভাসছে। আর ভাসবে বহুকাল।
লেখক: শিক্ষক, ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি, ভার্জিনিয়া, যুক্তরাষ্ট্র।
মাগুরায় ধর্ষণের শিকার শিশুটির জ্ঞান ফেরেনি এখনও। দুই দিন ধরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (পিআইসিইউ) রাখা হয়েছে তাকে। বৃহস্পতিবার বেলা ১১টা থেকে শিশুটি অচেতন অবস্থায় রয়েছে। শুক্রবার রাতে তাকে লাইফ সাপোর্টে নেওয়া হয়। শনিবার, ঘটনাচক্রে যেদিন আন্তর্জাতিক নারী দিবস, সেদিনও জীবন ও মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে রয়েছে শিশুটি।
৮ মার্চ যখন বাংলাদেশসহ বিশ্বজুড়ে আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালিত হচ্ছে, তখন চিকিৎসকদের বরাত দিয়ে ভুক্তভোগীর একজন স্বজন জানান, শিশুটি এখনও অচেতন। তার জ্ঞান ফেরেনি। চিকিৎসকেরা বলেছেন, আগামী ২৪ ঘণ্টা তাকে পর্যবেক্ষণে রাখা হবে। আট বছরের ছোট্ট এই শিশুটি বুধবার গভীর রাতে বোনের বাড়ি বেড়াতে গিয়ে বাড়িতে ধর্ষণের শিকার হয়। নারকীয় ঘটনায় ক্ষত-বিক্ষত আট বছরের শিশুর চিকিৎসা চলছে হাসপাতালের বিছানায় ।
একাধিক গণমাধ্যম সরেজমিন তথ্য ও পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে জানাচ্ছে, বর্বরোচিত নির্যাতনের শিকার শিশুটি কথা বলছে না। নড়াচড়াও নেই তার। অচেতন অবস্থায় শুয়ে আছে ধর্ষণের শিকার শিশুটি। আর তার পাশে বসে কাঁদছেন মা। সন্তানের এই অবস্থায় তিনি যেন পৃথিবীর সবচেয়ে অসহায় মানুষ। এক হাত দিয়ে মেয়ের মাথা স্পর্শ করছেন, আরেক হাতে নিজের চোখের পানি মুছছেন। মেয়ের করুণ অবস্থা দেখে বারবার মূর্ছা যাচ্ছেন তিনি।
কাকে বিচার দেবে এই অবোধ শিশু ও তার স্তম্ভিত মা? যখন ধর্ষণের প্রধান অভিযুক্ত হলো শিশুটির বোনের শ্বশুর ও স্বামী, যাদের বাড়িতে বেড়াতে গিয়ে অমানবিক বর্বরতার মুখোমুখি হতে হয়েছে শিশুকে। এই জঘন্যতম ঘটনার প্রতিবাদে ফুঁসে উঠেছে সাধারণ মানুষ। অভিযুক্তের শাস্তির দাবিতে বিশাল বিক্ষোভ মিছিল হয়েছে। পরে মাগুরা সদর থানা ঘেরাও করে জনতা।
এমন পাশবিক ঘটনা কেন ঘটলো? আইনের শৈথিল্যের কারণে? নীতি-নৈতিকতার অভাবে? মানবিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ে? নাকি অন্যকোনো কারণে? বিপ্লবোত্তর একটি পরিস্থিতিতে একের পর এক এমনই অগ্রহণযোগ্য ও অকল্পনীয় ঘটনাসমূহ কেন ঘটছে তার অন্তর্নিহিত কারণ চিহ্নিত হওয়া দরকার। তা না হলে আমরা এক অপরাধমূলক সমাজের চৌহদ্দির মধ্যে বন্দি হয়ে পড়বো। আর অকল্পনীয়, পাশবিক, বর্বর, নৃশংস ঘটনাগুলো প্রতিদিনই আমাদের চোখের সামনে ঘটতে থাকবে। আমরা অসহায়ের মতো দেখবো যে, শিশু বা বৃদ্ধা কিংবা নববধূও ধর্ষণের কবল থেকে বাঁচতে পারছে না। স্বামী-সন্তানদের আটক কিংবা জিম্মি করে পালাক্রম ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। ধর্ষণ ছাড়াও চলছে উত্তেজিত মব কর্তৃক গণপিটুনিতে জ্যান্ত মানুষকে প্রকাশ্য দিনেদুপুরে পিটিয়ে মেরে ফেলার ঘটনা। এসব অভাবনীয় ঘটনাগুলো কিসের আলামত? এগুলো কি আইন-শৃঙ্খলার পতন নাকি মনুষ্যত্বের পতন? নাকি সামগ্রিক পরিস্থিতির পতন ও অবক্ষয়ের ফল?
যারা রাষ্ট্র ও সমাজের কর্তাব্যক্তি, তাদেরকে এসব সমস্যার কারণ জানতে হবে। তাহলেই প্রতিকারের ব্যবস্থা নেওয়া যাবে। মানুষ ও সমাজকে বাঁচাতে ও নিরাপদ রাখতে হলে এহেন বর্বরদশা কাটিয়ে উঠতেই হবে। নৃশংসতার অবসান ঘটাতেই হবে। প্রয়োজনে কঠোরতম পন্থায় হলেও এই পাশবিক পরিস্থিতির অবসান ঘটাতেই হবে।
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস যথার্থভাবে বলেছেন, সম্প্রতি নারীদের ওপর যে জঘন্য হামলার খবর আসছে, তা গভীরভাবে উদ্বেগজনক। এটি ‘নতুন বাংলাদেশ’এর যে স্বপ্ন আমরা দেখছি তার সম্পূর্ণ বিপরীত। আমরা এই ‘নতুন বাংলাদেশে’ নারী-পুরুষ সবার সমান অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে অঙ্গীকারাবদ্ধ। আমরা আমাদের সব শক্তি প্রয়োগ করে এই অধিকার প্রতিষ্ঠা করব।
ড. মুহাম্মদ ইউনূস আরো বলেন, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে অংশ নেওয়া নারীরা বিভিন্ন সময়ে আমাকে তাদের সংগ্রাম ও আশা-আকাঙ্ক্ষার কথা জানিয়েছে। আমরা যে নতুন বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন দেখছি, নারীদের অংশগ্রহণ ও তাদের অধিকার নিশ্চিত করা ছাড়া তা সম্ভব হবে না। এই অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য নারীদের সঙ্গে পুরুষদেরও সহযোদ্ধা হয়ে কাজ করতে হবে।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রধানের এই প্রত্যয় সরকারের সকল সংস্থা ও বিভাগে অনুরণন জাগাতে পারবে বলে আমরা আশা করি এবং এর মাধ্যমে নারকীয় অপরাধের বিরুদ্ধে সরকারি ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের জোরালো পদক্ষেপ দেখা যাবে। অপরাধপ্রবণ মানুষ কিছুটা হলেও ভীত ও সতর্ক হবে। সমাজের অপরাধমুখী গতি কিছুটা হলেও স্তিমিত হবে। প্রয়োজনে কঠোর শাস্তির দৃষ্টান্ত স্থাপন করে অপরাধী ও অপরাধে ইচ্ছুকদের লাল কার্ড দেখাতে হবে।
এইসব জঘন্য অপরাধ আইনের শাসনের জন্য হুমকি। নীতি ও নৈতিকতা ভিত্তিক সমাজ নির্মাণের জন্য প্রতিবন্ধকতা স্বরূপ। নারী ও পুরুষের সম্মিলিত মানবসম্পদ বিকাশের মাধ্যমে দেশকে এগিয়ে নেওয়ার পরিপন্থী। বর্তমানের রোমহর্ষক নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনাগুলোর সঙ্গে সঙ্গে সাম্প্রতিক সময়ের অপরাধের ধারাগুলোকে পর্যালোচনা করা জরুরি। যেমন, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের মতে, ২০২৪ সালে ২,৩৬২ জন নারী ও মেয়ে সহিংসতার শিকার হয়েছে, যার মধ্যে ১,০৩৬ জন শিশু। তাদের মধ্যে ৪৮৬ জনকে হত্যা করা হয়েছে। ২০২৪ সালের প্রথম ১১ মাসে ১৮৬ জন নারী ও মেয়েকে ধর্ষণ করা হয়েছে, গণধর্ষণের শিকার হয়েছে ১৩ জন এবং ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ৩ জনকে।
বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসেই যৌন সহিংসতা ও হয়রানিসহ ১৮৬টি ঘটনা নথিভুক্ত হয়েছে। তবে প্রকৃত সংখ্যা আরও বেশি হতে পারে, কারণ অনেক ঘটনাই রিপোর্ট করা হয় না।
৮ মার্চ বিশ্বজুড়ে আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালিত হয়। ২০২৫ সালের নারী দিবসের প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে, “অধিকার, সমতা, ক্ষমতায়ন: নারী ও কন্যার উন্নয়ন”। কিন্তু বাস্তবতা হলো, বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে প্রতিনিয়ত নারীরা এখনো সহিংসতা, বৈষম্য ও নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান ও ঘটনা পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতার মাত্রা আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে।
আমরা কি নারী ও শিশু নির্যাতনকে সারা বছরের বারোয়ারী ঘটনায় পরিণত করবো এবং আন্তর্জাতিক নারী দিবসকে পর্যন্ত চিহ্নিত করবো নারকীয়, নৃশংস, রোমহর্ষক নানা অপরাধ সংঘটিত হওয়ার দিনে? পতন ও অবক্ষয়ের কোন্ অতলে তলিয়ে যাওয়ার পর আমাদের বোধোদয় হবে, বিবেক জাগবে, মানবিকতা সমুন্নত হবে?
ড. মাহফুজ পারভেজ: অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম; প্রফেসর ও চেয়ারম্যান, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও নির্বাহী পরিচালক, চট্টগ্রাম সেন্টার ফর রিজিওনাল স্টাডিজ, বাংলাদেশ (সিসিআরএসবিডি)।
আমাদের দেশে পবিত্র রমজান এলে নিত্যপণ্যের কোন মূল্যছাড় লক্ষ্য করা যায় না। বরং কে কত লাভ করবেন সেটা নিয়ে ব্যবসায়ীদের মধ্যে অস্থির প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায়। প্রতিবছর রমজান মাস সমাগত হবার আগেই এক শ্রেণির লোভী ব্যবসায়ী কোমর বেঁধে অধিক লাভের আশায়ায় অংকের নতন হিসেব মেলাতে ব্যস্ত হয়ে উঠেন। পবিত্র রমজানে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে ব্যবসায়ীরা লাভের কথা ভুলে গিয়ে রোজাদারকে স্বল্পমূল্যে পণ্য সরবরাহ করার প্রতিযোগিতা শুরু করলেও আমাদের দেশে এর উল্টোচিত্র দেখা যায়। এবং অধিক মুনাফা লাভের কুৎসিত প্রবণতা আমাদের দেশের ব্যবসায়ীদের একটা মজ্জাগত বিষয় হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে।
সৌদি আরবের ব্যবসায়ীগণ পবিত্র রমজান মাসে লাভ করতে চান না। তাদের খাদ্যপণ্যের দোকানগুলোতে ৫০% মূল্যছাড় দেয়া হয়ে থাকে। সেখানে ৬৫ রিয়ালের একটি ট্যাং জুসের মূল্য ৪০ রিয়ালে বিক্রি করার মানসিকতা দেখা যায়। এইভাবে কাতার, ওমান, সংযুক্ত আরব আমীরাত, বাহরাইন, ব্রুনাই, মালয়েশিয়া প্রভৃতি দেশেও বিশাল মূল্যছাড়ের কথা জানা যায়। এমনকি যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও অনেক অমুসলিম দেশেও পবিত্র রমজান ও ঈদ উপলক্ষ্যে খাদ্য ও পোশাকের উপর বিশেষ মূল্যছাড় দেয়া হয়ে থাকে। কিন্তু বাংলাদেশে রমজান বা ঈদে দ্রব্যমূল্যছাড়ের রীতি বা কৃষ্টিই গড়ে উঠেনি। বরং এখানে আড়ৎদারী, মজুতদারী ও একাই আয়-লাভ করব, একাই খাব নীতিতে মানুষ অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে। এভাবেই দেশে আশিভাগ সম্পদ মাত্র ২০ ভাগ মানুষের হাতে কুক্ষিগত হয়ে পড়েছে। তারা সুনির্দিষ্ট নিজসম্পদের হিসেব করে জাকাত প্রদানেও কার্পণ্য করে থাকেন। তাহলে দারিদ্র বিমোচন ও মানবিক বাংলাদেশ গড়ে উঠবে কীভাবে?
তাই আমাদের অতি লোভী ব্যবসায়ীরা নিজেদের থেকে নিত্যপণ্যের কোন মূল্যছাড় দিতে আগ্রহী না হলে সরকারীভাবে রমজান মাসে মূল্যছাড়ের জন্য হস্তক্ষেপ করা প্রয়োজন। কারণ হিসেবে বলা যেতে পারে, বাংলাদেশ একটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ট দেশ। নামাজের ওয়াক্ত হলে এত বেশী আযানের সুর বিশ্বের অন্য কোন মুসলিম দেশেও শোনা যায় না। কিন্তু আদারেকে টিটকারী করে বলা হয়ে থাকে- ‘মুসলিম এই দেশে, ইসলাম ঐ দেশে।’ তাই পরিবর্তিত নতুন বাংলাদেশের এই সুন্দর সময়ে নিত্যপণ্যমূল্যবৃদ্ধির এই কুৎসিত প্রতিযোগিতার অবসান হওয়া জরুরী।
সারা বছর ঘুরে একমাসের জন্য পবিত্র রোজার সওগাত নিয়ে হাজির হয় মাহে রমজান। যে ব্যক্তি রোজা রাখে তার জন্যই কল্যাণের বার্তা রয়েছে। কারণ নিজেকে নিজের সাথে শপথ করার মাধ্যমে দেহ, মন ও চিন্তা চেতনার আসল শুদ্ধি শুধু রোজার মাধ্যমেই সম্ভব। অন্য কোন বাহ্যিক ইবাদতের সাথে রোজার এখানেই আসল পার্থক্য বিরাজমান। তাই একজন সৎ মানুষ তথা আসল মুমিন হবার বিকল্প নেই।
কিন্তু সৎ মানুষের সংকটে রোজার আসল উদ্দেশ্য থেকে মুসলমানগণ অনেক দুরে সরে গেছেন। অতি মুনাফালোভী, মজুতদার ও সৎ মানুষের সংকটে রমজান আসার আগেই প্রতিবছর বাজারে নিত্যপণ্যের দ্রব্যমূল্য বাড়িয়ে দেয়া হয়। প্রতি রমজানে দ্রব্যমূল্যবৃদ্ধি করা যেন একটা কুৎসিত নেশা।
বলা হয়ে থাকে রমজান মাস শুরু হলে শয়তানকে একমাসের জন্য শিকলবন্দী করে রাখা হয়। যাতে সে মানুষকে ইবাদত থেকে বিচ্যুত করতে না পারে। তা ঠিক। কারণ, রমজানের আগমনে মানুষের মনের মধ্যে বিরাট পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। রোজা রাখার জন্য প্রস্তুতি চলে বেশ জোরেশোরে। সারাদিন রোজা রাখার পর ইফতারী করা, তারাবীহ্ নামায আদায় করা, শেষরাতে সেহ্রী খাওয়া সবকিছুতেই একটা ধর্মীয় আমেজ চলে। মুমিনগণ তাঁদের সৎভাবে উপার্জিত আয়ের অর্থ দিয়ে এসকল ধর্মীয় কাজের খরচ বহন করে থাকেন। বাধ সাধে তাদের জন্য, যারা সৎ-অসৎ ও হারাম-হালাল আয় ও দ্রব্যের মধ্যে পার্থক্য সূচিত করতে ভুলে যান অথবা জেনেশুনে মোটেও পার্থক্য করেন না । অথবা, যারা হেঁয়ালী করে ভাল-মন্দ সবকিছুর মধ্যে মাখামাখি করে নিজের মূল্যবান জীবনটাকে অসততার মাঝে সঁপে দিয়ে দ্বিকুলে অর্থহীন করে ফেলেন।
সে জন্যই রমজানে শয়তান ইবলিস শিকলবন্দী থাকলেও মানুষরূপী শয়তানের তৎপরতা বেশ বেপরোয়া। যে সকল মানুষরূপী শয়তান তাদের কথা, কর্ম ও পরিবেশের মধ্যে ইবলিস শয়তানের আদর্শ চর্চা করে নিজেকে গড়ে তুলে পাপসঙ্কুল জীবন যাপনে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে- তাদেরকে তো আর শিকলবন্দী করে রাখা হয়নি। তাদের ক্ষমতা ও অন্যায় কাজের সীমাহীন প্রভাবে রমজান মসেও ঘরে ঘরে মানুষের মনে শয়তানী শুরু করার উপকরণ থেকে যায়। ঘরে-বাইরে চারদিকে শয়তানী কাজের উপকরণ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রেখে ইবলিস শয়তানকে আহব্বান করা হয় মাত্র। এভাবে শয়তান মুসলমানদের অন্তরে প্রবেশ করে সবসময় ধোঁকা দিচ্ছে এবং তাকে আরো বেশী অনুসরণ করার জন্য উস্কে দিচ্ছে। এভাবেই শুরু হয়েছে ন্যায়-অন্যায়ের সংকট। একজন ভাল মানুষের নৈতিকতাবোধ হরিত হয়ে পড়ে এই সংকটের সময়।
কিছু লোভী ও স্বার্থপর মানুষের মধ্যে এই ধরণের সংকট থেকে আমাদের দেশে শুরু হয়েছে বাজারে নিত্য পণ্যের সংকট। অতি মুনাফা লাভের আশায় মজুতদাররা সামান্য পিঁয়াজ-তেলের কৃত্রিম সংকট শুরু করেন। আমাদের দেশে কৃষি উৎপাদনের কমতি নেই। পাশাপাশি আমদানিও করা হয় প্রচুর। তাই বাজারে পণ্য যোগানের স্বল্পতা নেই। তবে কেন নিত্যপণ্যের কৃত্রিম সংকট? তবে কেন বাসি-পঁচা ইফতার পরদিন বিক্রি করার জন্য ডালায় সাজানো হয়? মানুষের সংগে ভেজাল দ্রব্য দিয়ে প্রতারণা করা ও অতি মুনাফা করাই এখানে সংকটের পিছনে বিশেষভাবে দায়ী। আরো রয়েছে- এক শ্রেণির কাঁচা পয়সাধারী উঠতি বিত্তশালী ভোগবাদী মানুষের অপরিনামদর্শী কেনাকাটার উন্মত্ত আচরণ। এরা দরিদ্র ও সীমিত সৎ আয়ের মানুষের ক্রয়ক্ষমতাকে সম্মান করে না। বরং বাহাদুরী করে কেনাকাটায় বেহুঁশ হয়ে বাজারে দ্রব্যমূল্য বাড়ানোকে উস্কে দেয়। ফলে বাজার হয়ে পড়ে অস্থিতিশীল। আমাদের দেশে ঘুষ-দুনীতিবাজরা কাঁচা পয়সা হাতে পেয়ে কোথাও দরিদ্রদেরকে পাত্তা দেয় না। স্বভাবতই: নি¤œ আয়ের মানুষ তাদের সাথে প্রতিযোগিতায় হেরে বাজারে ক্রয়ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। বর্তমানে বাজারে সাড়ে ছয়শত টাকায় দেশী মুরগী, সাড়ে আটশত টাকায় গরুর মাংস এবং বারশত টাকায় খাসীর মাংস কেনার সামর্থ্য কোন সীমিত আয়ের মানুষের আছে? অথচ, অবৈধভাবে হঠাৎ বনে যাওয়া বিত্তশালীদের বাড়িতে কয়েকটি ডিপ ফ্রীজে প্রয়োজনাতিরিক্ত আমিষ দীর্ঘদিন হিমে পড়ে থেকে নষ্ট হয়ে যায়। উন্নত দেশে বিশেষ করে সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের ধনী দেশগুলোতে খাদ্য অপচয়ের মাত্রা সীমাহীন। সারা বিশে^ বছরে একশ’ কোটি টন রান্না করা খাবার নষ্ট হয়ে যায়!
আমাদের দেশেও মানুষে-মানুষে আয়-ব্যায়ের বিস্তর ফাঁরাক। খাদ্যপণ্য ভোগের ক্ষেত্রেও চরম বৈষম্য লক্ষ্যনীয়। বাজারে সবকিছু থরে থরে সাজানো দ্রব্যের কমতি নেই। লাগামহীন মূল্যস্ফীতিতে সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা নেই। এজন্য ভোক্তা আইন-আন্দোলন ইত্যাদি থাকলেও বাজার মনিটরিং করার দায়িত্বে নিয়োজিত ক্উাকে অকুস্থলে খুঁজে পায়া যায় কি?
আমার এক বন্ধু আক্ষেপ করে লিখেছেন- “সামনে রোজা আসছে। দেখবেন রোজার আগমনে অন্যান্য মুসলিম দুনিয়া শান্ত হয়ে আসছে। মানুষের মাঝে একটা ভাবগম্ভীর পরিবেশ তৈরি হচ্ছে। কিন্তু আমাদের দেশে শুরু হবে কেনা কাটার মচ্ছব। যার দুই কেজি পিঁয়াজ দরকার সে কিনবে বিশ কেজি। যার এক কেজি চিনি দরকার সে কিনবে- দশ কেজি। এমন করে খাবার মজুদ করা শুরু হবে - যেন সারা বছর না খেয়ে ছিলো। রোজার পরও আর কোনোদিন খাবার খাবোনা। দুনিয়ার সব খাবার এই ত্রিশ দিনেই খেয়ে শেষ করতে হবে। এই সুযোগে পবিত্র রমজানের ব্যানার টাঙ্গিয়ে দ্রব্য মূল্যের দাম বাড়িয়ে ব্যবসায়ীরাও অপবিত্র কাজ করা শুরু করে দিবে।
নকল ও ভেজাল খাদ্যদ্রব্য বিক্রি করা রমজানের সময় একটি ভয়ংকর সংকট। মেয়াদউত্তীর্ণ পণ্যের তারিখ পরিবর্তন করে বিক্রি করার প্রবণতা ব্যাপক বেড়ে গেছে। বিশেষ করে প্রাণঘাতি করোনার ভয়ে মানুষ যখন বাড়ি থেকে বের হবার সাহস হারিয়ে ঘরে বসে কেনাকাটা করতে চান তখন একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী অনলাইনে কেনাকাটার ফাঁদ পেতে বসেছেন।
অনলাইনে কেনাকাটার জন্য ফেসবুক, ইউটিউব, টুইটার ও টিভি-পত্রিকাও ব্যাপকভাবে ব্যবহার করে বিজ্ঞাপন দিয়ে নিরীহ মানুষের সংগে প্রতারণা করা হচ্ছে। গুদামের পচা খাদ্যশস্য, দোকানের ছেঁড়াফাটা কাপড়, ভেজাল তেল-ঘি, নকল জুস, হোটেল-রেঁস্তরার বাসি-পঁচা খাবার ইত্যাদি এখন অনলাইনে কেনাকাটার পণ্যদ্রব্য। তাই নিরুপায় মানুষ নিত্য প্রতারিত হতে হচ্ছে অনলাইন কেনাকাটায়।
নিম্ন আয়ের মানুষের কথা ভেবে টিসিবি-কে পাড়ায় পাড়ায় নিত্যপণ্য সরবরাহ বাড়াতে হবে। উপজেলা ও গ্রাম পর্যায়ে যেন নিত্যপণ্যের অভাবে হাহাকার সৃষ্টি না হয় সেদিকে খেয়াল রেখে সরবরাহ চেইন নিয়মিত ঠিক রাখতে তৎপর হতে হবে।
এক শ্রেণির অনৈতিক মানুষের কাজ হলো- শুধু নিজে খাব, কাউকে দেব না। এজন্য তারা অন্যের রিজিকের উপর হাত দিতে কার্পণ্য করে না। কেউ যেন অন্যায়ভাবে অপরের রিজিক কেড়ে না নেয় সেজন্য মানুষের মধ্যে সচেতনা বাড়াতে হবে। রমজানের রোজা রেখে মানুষের আত্মশুদ্ধি হোক ও আত্মপোলদ্ধি জাগ্রত হয়ে সকল পাপ-দুর্নীতির বিরুদ্ধে সবার আত্মা জেগে উঠুক।
প্রতিবছর পবিত্র রমজান ও দুই ঈদকেন্দ্রিক অতি মুনাফা করার প্রবণতা বন্ধ হোক। রোজার মহিমায় যাবতীয় অতি মুনাফালোভী, মজুতদার, শঠ ও দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিকারীদের ভন্ডামী নস্যাৎ হয়ে যাক। সরকারী করছাড় সুবিধা নিয়ে স্বল্পমূল্যে পণ্য আমদানী করে আনার পর গোপনে গুদামজাত করে রাখা এবং সমুদ্রে লইটার ভেসেলে ভাসমান গুদাম তৈরী করে দীর্ঘদিন পণ্য খালাস না করে দুর্নীতিচক্রের সাথে যোগসাজশ করে কৃত্রিম মুনাফা করার ঘৃণ্য প্রবণতা গুড়িয়ে দেবার সুবর্ণসময় এখন। এতসব শয়তানী প্রভাবে বিচ্যুত সকল মানুষ রোজার তাপে পুড়ে আত্মপোলব্ধি থেকে আত্মশুদ্ধি লাভ করে ঈমান মজবুত করুক এবং ফিরে ফিরে পাবার প্রেরণা পাক দুই জীবনের কল্যাণ ।
*লেখক রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডীন। E-mail: [email protected]