বঙ্গবন্ধুর প্রতি সুবিচারে হাসিনার দুঃশাসন ছায়া না ফেলুক
জাতীয় ৭টি দিবস বাতিলের সরকারি সিদ্ধান্ত এসেছে গতকাল বৃহস্পতিবার। এর মধ্যে ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণের দিন, ১৫ মার্চ, সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা ও ৪ নভেম্বর সংবিধান দিবস অন্যতম। এসব দিবস বাতিলের পক্ষে-বিপক্ষে গতকাল থেকেই সরব সামাজিক-রাজনৈতিক পরিমণ্ডলসহ স্যোশাল মিডিয়া। এ বিষয়ে আজ ইংরেজি দৈনিক দ্য ডেইলি স্টার’র সম্পাদক মাহফুজ আনাম লিখেছেন বিশেষ সম্পাদকীয় নিবন্ধ। বার্তা২৪.কম এর পাঠকদের জন্য বাংলায় অনূদিত নিবন্ধটি প্রকাশিত হলো:
মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে আমাদের সম্মান জানাতেই হবে। দুটি সাম্প্রতিক ঘোষণা আমাদের বিস্মিত করেছে: প্রথমত, জাতীয়ভাবে উদযাপিত দিবসের পুনর্বিন্যাস এবং দ্বিতীয়ত, তথ্য উপদেষ্টা নাহিদ ইসলামের বক্তব্য, ‘অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে জাতির জনক মনে করে না।’
উল্লেখিত ৭টি জাতীয় দিবসের বিষয়ে, তিনটি ছাড়া বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সরকারের সঙ্গে আমাদের মতভিন্নতা নেই। তিনটি দিবস হচ্ছে-৭ মার্চ (বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণের দিন), ১৫ আগস্ট (সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার দিন) এবং ৪ নভেম্বর; যেদিন আমাদের সংবিধান জারি হয়েছিল। এই দিনগুলিতে যে অবিস্মরণীয় ইতিহাস তৈরি হয়েছিল, তার তাৎপর্য কখনও নিঃশেষ হওয়ার নয়।
বঙ্গবন্ধু ইতিহাসের এক মহানায়ক এবং আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনের সর্বোচ্চ নেতা। আরও অনেক নেতা ছিলেন, যেমন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, শেরে বাংলা একে ফজলুল হক, তাজউদ্দীন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, জেনারেল এম এ জি ওসমানী। ইতিহাস তাদের সবার বিচার করবে এবং তাদের উপযুক্ত স্থান দেবে।
আমাদের দৃষ্টিতে, বঙ্গবন্ধুকে অবশ্যই দুটি পৃথক অংশে বিচার করতে হবে: প্রথমটি আমাদের স্বাধীনতা পর্যন্ত, এবং দ্বিতীয়টি ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বাংলাদেশে ফিরে আসার পর। প্রথম পর্যায়ে, তিনি কেন্দ্রীয় ভূমিকায় এবং সিদ্ধান্ত নেওয়ার জায়গায় ছিলেন। তিনি বাঙালি জাতিকে তার অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক অধিকারের দাবিতে ঐক্যবদ্ধ করেন। বঙ্গবন্ধুই আমাদের মধ্যে অধিকারের দাবি এবং এর জন্য লড়াই করার আত্মবিশ্বাস সৃষ্টি করেছিলেন। জীবনের ১৩টি বছর তিনি জেলে কাটিয়েছেন, কখনই আপস করেননি। ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে তার ব্যাপক বিজয় তাকে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের মুখপাত্র করে তোলে, একটি মহান দায়িত্ব যা তিনি অত্যন্ত সাহস এবং সততার সাথে পালন করেছিলেন যতক্ষণ না আমরা স্বাধীন হয়েছি। পাকিস্তানি শাসনের কবল থেকে আমাদের মুক্ত করার জন্য তার আজীবন সংগ্রাম অনস্বীকার্য। তিনি সেই নেতা যিনি আমাদেরকে নৃশংস ও অমানবিক পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরতে অনুপ্রাণিত করেছিলেন। তিনি ছিলেন আমাদের মুক্তিযুদ্ধের নেতা।
কিন্তু তিনি দেশ পরিচালনায়, বিশেষ করে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনে মারাত্মকভাবে ব্যর্থ হন। আমাদের স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা নিয়ে অনেক বিতর্ক রয়েছে। রক্ষীবাহিনী গঠন এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা বরাবরই সমালোচনার বিষয় হয়েছে। কিন্তু যে কাজটি তার মর্যাদা ও সম্মানকে সত্যিকার অর্থে ক্ষতিগ্রস্ত করেছিল তা হল ১৯৭৫ সালের জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে একদলীয় শাসনের প্রবর্তন। এটি স্বাধীন বাংলাদেশে স্বৈরাচারী শাসনের সূচনা।
অনেক নেতা বিপ্লবে সফল হতে গিয়ে জাতি গঠনে পিছিয়ে পড়েন। তাদের কিছু ভুলে জনগণের নিদারুণ কষ্ট ও বহু প্রাণ বিসর্জন দিতে হয়। চীনের মহান নেতা মাও সেতুং এর কথা স্মরণ করা যেতে পারে। তাঁর জীবন সংগ্রাম ও সীমাহীন ত্যাগ, সর্বোপরি জনগণের প্রতি ভালবাসায় পূর্ণ ছিল। তবে তাঁর ‘গ্রেট লিপ ফরোয়ার্ড’ ও ‘সাংস্কৃতিক বিপ্লব’ অগণন ট্র্যাজেডি বয়ে আনে, যা শেষে পরিচালিত হয় এটি বুদ্ধিবৃত্তিক দমনে। আরও অসংখ্য উদাহরণ রয়েছে। বঙ্গবন্ধুর ব্যর্থতা ছিল, ইতিহাসের অন্যদের মতো, কিন্তু তাকে অবশ্যই সম্পূর্ণভাবে বিচার করতে হবে।
সর্বোত্তম হল যোগ্য ইতিহাসবিদদের কাজটি করতে দেওয়া, রাজনৈতিক ব্যক্তিদের নয়।
আমরা শেখ হাসিনার ত্রুটিপূর্ণ, অগণতান্ত্রিক, গণবিরোধী, দুর্নীতিবাজ, ক্ষমতালোলুপ, অসহিষ্ণু ও ফ্যাসিবাদী শাসনের আলোকে বঙ্গবন্ধুকে বিচার করতে পারি না । শেখ হাসিনা ১৫ বছরের বেশি সময় ক্ষমতায় থাকাকালে যা করেছেন তা দিয়ে কালিমালিপ্ত করতে পারি না বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ও অনস্বীকার্য ভূমিকাকে।
পূর্ব পাকিস্তানের জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করা, ধীরে ধীরে আইয়ুব খান বিরোধী আন্দোলন গড়ে তোলা, ছয় দফা কর্মসূচির মাধ্যমে আমাদের আন্দোলনে তরঙ্গায়িত করা, ১৯৭০ সালের নির্বাচনে অত্যাশ্চর্য বিজয়, তাঁর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ এবং ১৯৯১ সালের মার্চে অসহযোগ আন্দোলনে ভূমিকা-যার মাধ্যমে জনগণ তৎকালীন পাকিস্তান সরকারকে সম্পূর্ণভাবে পঙ্গু করে দিয়েছিল, তা আমাদের ইতিহাসের সবচেয়ে গৌরবের স্তম্ভ হিসাবে দাঁড়িয়ে আছে। এসবের মধ্যে সাধারণ মানুষ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা, বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (অনেকটা এই সময়ের মতো) অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে।
ইতিহাস নিয়ে আজকের বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের অনেক নেতা ও অনুসারীর ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি ও নিজস্ব ব্যাখ্যা থাকবে। যতক্ষণ না তারা সত্যকে আকড়ে থাকবেন তাদের প্রতি আমাদের অবশ্যই সম্মান থাকবে।
যদিও, কেউ কেউ ১৯৬০ এর দশকের শেষের দিকে সেই দিনগুলির ঐতিহাসিক তাৎপর্য, ১৯৭০ সালের উত্তাল মুহূর্তের মোহময়তা কিংবা ১৯৭১ সালে আমাদের সশস্ত্র সংগ্রামের মহিমা পুরোপুরি অবগত নাও হতে পারেন। আমাদের মধ্যে যাদের বঙ্গবন্ধুর সেইসব অনুষ্ঠানে সক্রিয় অংশগ্রহণ করে তাঁর ঐতিহাসিক ভূমিকাকে চাক্ষুষ করা সুযোগ ঘটেছিল আমরা তা স্মরণ করতে পারি। প্রতিদিন মুক্তিবাহিনী ক্যাম্পে আমরা বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের রেকর্ড বাজাতাম নিজেদেরকে উজ্জীবিত ও উদ্বুদ্ধ করার জন্য।
শেখ হাসিনার দুঃশাসন, দুর্নীতি এবং ক্ষমতার অপব্যবহারের কারণে আজকের ২০-২৫ বছর বয়সী তরুণ প্রজন্মের মাঝে বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে বিরূপ ধারণা তৈরি করতে পারে; শেষ কয়েক সপ্তাহ, বিশেষ করে ১৫ জুলাই থেকে ৫আগস্ট, ২০২৪ পর্যন্ত। সাধারণ জনগণ, পথচারী, রাস্তার হকার, পথচারী এবং বিক্ষোভকারী ছাত্ররা হত্যাযজ্ঞের সাক্ষী ছিলেন। শেখ হাসিনা ও তাঁর দল যে সামান্য সদিচ্ছা ও বিশ্বাসযোগ্যতা স্থাপন করেছিলেন তা কর্পুরের মতোই উবে গিয়েছি।।এবং সেই সপ্তাহগুলিতে তখনকার শাসকদের প্রতি যে ঘৃণা জন্মেছিল সেই ফলাফল আমরা সবাই এখনও দেখতে পাচ্ছি।
গত দেড় দশক, বিশেষ করে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থার বিলুপ্তির পর, এরপর ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের কারচুপির নির্বাচন আওয়ামী লীগকে ফ্যাসিবাদী দলে পরিণত করেছে। এটি গভীরভাবে দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়ে এবং নিজেকে সমস্ত আইনের ঊর্ধ্বে মনে করে। শেখ হাসিনা চরম অহংকারী হয়ে ওঠেন, এবং ক্ষমতার প্রতি আচ্ছন্ন হয়ে পড়েন, সামান্য সমালোচনায় অসহিষ্ণু, স্বাধীন মিডিয়ার প্রতি অবজ্ঞা এবং সংবিধানের প্রতি ঘৃণা প্রদর্শন করেন। তিনি আত্মগৌরবে নিমগ্ন হয়ে ওঠেন ‘দেশকে আমার মতো কেউ ভালোবাসে না’ কিংবা ‘আমি বঙ্গবন্ধুর কন্যা বলে আমি কোনো অন্যায় করতে পারি না’-এই প্রক্রিয়ায় আওয়ামী লীগ পরিণত হয় শোষক, দালাল ও স্বার্থান্বেষীদের দলে, যারা দেশকে লুটপাট করেছে এবং বিদেশে অর্থ পাচার করেছে।
আমি মনে করি, বঙ্গবন্ধুর সবচেয়ে বড় ক্ষতি হয়েছিল তার জন্মশতবার্ষিকী উদযাপনের জন্য দেশের করদাতাদের সীমাহীন অর্থ ব্যয় করায়। এটি তাকে একজন অর্ধ-দেবতায় পরিণত করেছে, এমন একটি ব্যক্তিত্বের কাল্ট তৈরি করেছে যা কোনো গণতান্ত্রিক রাজনীতি সহ্য করতে পারে না এবং যাকে বাঙালির মানসিকতা সহজাতভাবে ঘৃণা করে। হাজার হাজার বই এবং শত শত মূর্তি চালু করা হয়েছিল এবং রাষ্ট্র দ্বারা অর্থ প্রদান করা হয়েছিল, যা কখনও কখনও অত্যধিক পরিমাণে হয়েছিল।
সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ সরকারি অফিস, ব্যাংক, হোটেল, বিমানবন্দর ইত্যাদিতে একটি ‘মুজিব কর্নার’ স্থাপন করতে হবে। প্রত্যেক মন্ত্রী, এমপি, মধ্য থেকে উচ্চপর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তাসহ অন্যদের বক্তৃতা শুরু করার জন্য বঙ্গবন্ধুর প্রতি পাঁচ-সাত মিনিট এবং শেখ হাসিনার উদ্দেশে একের পর এক শ্লোগান দিয়ে বক্তৃতা শুরু করা বাধ্যতামূলক হয়ে ওঠে। সরকারি চাকরিজীবীদের মধ্যে এই ভয় কাজ করে যে, যদি তাদের কৃতজ্ঞতা স্বাভাবিকের চেয়ে কম হয়ে যায়, তাহলে তাদের চাকরি হুমকির মুখে পড়তে পারে। এই প্রবণতা এভাবেই প্রলম্বিত হতে থাকে।
পরের বছর ছিল আমাদের স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী উদযাপন। গল্পটি একই প্যাটার্ন অনুসরণ করেছে: হাসিনার বাবা ছাড়া আর কেউ আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে কোনো ভূমিকা রাখেনি। এর সবচেয়ে জঘন্য দিকটি ছিল সমস্ত সরকারি বর্ণনায় মুক্তিযোদ্ধাদের ভূমিকাকে আক্ষরিকভাবে বাদ দেওয়া । ২০২০ সালে যে জন্মশতবার্ষিকী হয়েছিল তা ‘জনগণের বাংলাদেশ’ এর পরিবর্তে ‘মুজিবের বাংলাদেশ’ প্রচারের চূড়ান্ত ফ্যাসিবাদী কার্যকলাপের সাথে এক বছর ধরে অব্যাহত ছিল।
হাসিনা সরকারের এসব বাড়াবাড়ির ফলে সৃষ্ট বিদ্বেষ এখন বঙ্গবন্ধুর ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করছে। বর্তমান প্রজন্মের ছাত্র আন্দোলনকারীরা—যারা ১৫-৩০ বছরের বয়সীদের দলে, আক্ষরিক অর্থে একটাই সরকার দেখেছে, গত দেড় বছরে শেখ হাসিনার। তাদের বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গি এবং রাজনৈতিক চেতনা তার সরকারের নিপীড়নমূলক আচরণ দ্বারা গঠিত হয়েছিল যা কেবল বিরক্তি এবং ঘৃণার জন্ম দিয়েছিল। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং লাগামহীন দুর্নীতির কারণে ‘উন্নয়ন’ আখ্যানটি হারিয়ে গেছে।
গত দেড় দশকে যদি একাডেমিক স্বাধীনতার অনুমতি দেওয়া হতো এবং বঙ্গবন্ধুর ভুলের পাশাপাশি তার ভূমিকাকে বস্তুনিষ্ঠভাবে মূল্যায়ন করা হতো, তাহলে তার প্রকৃত অবদান কখনোই প্রশ্নবিদ্ধ হতো না। শেখ হাসিনা কখনই বোঝেননি যে সত্য চিরকাল থাকে এবং অপপ্রচার শুধু শাসনামলের মেয়াদকাল পর্যন্তই থাকে।
শেখ হাসিনার দুঃশাসনের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর দিকে না তাকিয়ে শিক্ষার্থীদের প্রতি আহ্বান জানাই। তিনি আমাদের দৃষ্টিতে, একটি ব্যক্তিত্বের কাল্ট তৈরি করে তার পিতার উত্তরাধিকারের সবচেয়ে বড় ক্ষতি করেছিলেন যা সকলকে বিরক্ত করেছিল এবং আমাদের তাঁর (বঙ্গবন্ধুর) অসাধারণ সাহস, রাজনৈতিক বুদ্ধিমত্তা, ঐতিহাসিক অন্তর্দৃষ্টি এবং সংগঠিত করার ক্ষমতা ভুলিয়ে দিয়েছিল। তিনি বঙ্গবন্ধুকে কোনো ত্রুটি ছাড়াই একজন ব্যক্তি হিসেবে চিত্রিত করার চেষ্টা করেছিলেন, যা তরুণ প্রজন্ম তাঁকে যথাযথ কৃতিত্ব ও সম্মান দিতে অস্বীকার করে। তার কর্ম আমাদের ঠাকুরের সেই মহান গানের কথা মনে করিয়ে দেয়: ‘নিজেরে করিতে গৌরব দান, নিজেরে কেবলি করি অপমান’।
রাজনৈতিক গতিপথ পরিবর্তনের সাথে আমাদের বর্ণনার পরিবর্তন আমরা প্রায়শই দেখেছি। প্রায়শই, আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বিবরণকে যারা ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করেছিল তাদের দ্বারা টুকরো টুকরো করে কাটা হয়েছে, কারণ তারা তাদের নিজস্ব সংস্করণকে একমাত্র সত্য হিসাবে বিবেচনা করতে চেয়েছিল।
শুরুতে শুধু আওয়ামী লীগই ছিল- অন্য কোনো দল, গোষ্ঠী এমনকি সাধারণ মানুষও আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে দৃশ্যত কোনো ভূমিকা রাখেনি। মুক্তিবাহিনীর অধিকাংশ সদস্যই ছিল দরিদ্র কৃষকের সন্তান। তাদের কোনো কৃতিত্ব দেওয়া হয়নি; তারা সবাই আওয়ামী লীগার। খন্দকার মোশতাক আহমদ, জেনারেল জিয়াউর রহমান এবং জেনারেল এরশাদের সময় শেখ মুজিব অন্তর্হিত হন এবং যদিও পরে তিনি প্রতিস্থাপিত হন। ১৯৯০ সালে স্বৈরাচারের পতনের পর খালেদা জিয়া যখন ক্ষমতা গ্রহণ করেন, তখন বর্ণনাটি ছিল জিয়াউর রহমান স্বাধীনতা ঘোষণা করার পরই আমাদের মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়েছিল। এর আগে শেখ মুজিবকে দৃশ্যপটে নিয়ে আসার মতো কিছুই ঘটেনি। এই পুরো সময়কালে, যুদ্ধের সময় গণহত্যার অপরাধীদের ‘হানাদার বাহিনী’ বলা হয়। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নামকরণ নিষিদ্ধ হয়ে যায়।
হাসিনা ক্ষমতায় আসার সাথে সাথে বর্ণনাটি পাল্টে যায় এবং হঠাৎ করেই জিয়াউর রহমান দৃশ্যপট থেকে অদৃশ্য হয়ে যায় এবং স্বাধীনতা ঘোষণার ক্ষেত্রে তার ভূমিকা এবং শুরুতে তার গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপের তাৎপর্যকে ‘আইএসআই এজেন্ট,’ ‘পাকিস্তানি গুপ্তচর’ ইত্যাদি মিথ্যা ও নিন্দনীয় শব্দ দ্বারা প্রতিস্থাপিত করা হয়।
ইতিহাস হস্তগত করা এবং সত্যের রাজনীতিকরণ না করার ফলে একটি জাতি হিসাবে আমরা এবং আমাদের শিশুরা, ভবিষ্যত নাগরিক হিসাবে ভয়ঙ্করভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি-যার জন্য একমাত্র হাসিনাই দোষী নন।
রাজনৈতিকভাবে সুবিধাজনক ইতিহাস বলা, ইতিহাসের প্রতি শ্রদ্ধা নষ্ট করে; বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে। আমাদের স্কুলের পাঠ্যপুস্তকগুলি সবচেয়ে দুঃখজনক উদাহরণ। এটা বন্ধ করতে হবে। এখন সেই মুহূর্ত যখন আমাদের ক্ষমতায় এমন লোক আছে যারা আমাদের রাজনীতির দ্বি-মেরুত্বের বাইরে। আমাদের অবশ্যই দুই পক্ষের আখ্যানের সীমাবদ্ধতা থেকে দূরে সরে যেতে হবে। একটি পক্ষপাতমূলক আখ্যান থেকে অন্যটিতে স্থানান্তরিত- যা আমাদের পক্ষপাত ও অজ্ঞতায় বন্দী করে রেখেছে-এই ফাঁদ এড়াতে হবে। শিক্ষার্থীরা আমাদের চিন্তা প্রক্রিয়ায় পরিবর্তনের একটি সতেজ বাতাস বয়ে এনেছে, তবে তাদের এই পুরানো ফাঁদে পড়ার বিরুদ্ধে সতর্ক থাকতে হবে।
আমরা ১৯৭১ সালে সার্বভৌম ভূমি পেয়েছি, কিন্তু জাতি গড়তে ব্যর্থ হয়েছি। সম্প্রীতির পরিবর্তে বিভাজন সৃষ্টি করেছি। অন্যদের কাছে পৌঁছানোর পরিবর্তে, আমরা তাদের শত্রু হিসাবে পরিহার করেছি। একে অপরকে বোঝার পরিবর্তে, আমরা বিভেদকে আরও গভীর করার জন্য ইতিহাস নিয়ে রাজনীতি করেছি। যা আমাদের প্রাণশক্তিকে জাতি গঠন থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছে। এখন সময় এসেছে আমাদের উত্তরাধিকারের সত্যিকারের চিত্রের সাথে জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করার এবং ধ্বংসাত্মক রাজনীতির গভীর ক্ষতিকারক সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসার।
লেখক: দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদক ও প্রকাশক
দ্য ডেইলি স্টার’র সৌজন্যে