৬ মাসে ঢাবি প্রশাসনের উল্লেখযোগ্য ১২টি কার্যক্রম

  • ঢাবি করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, ঢাকা
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

জুলাই অভ্যুত্থান পরবর্তী দায়িত্ব নেওয়া প্রশাসনের ৬ মাস পূর্তি উপলক্ষ্যে তাদের উল্লেখযোগ্য কার্যক্রম ও অর্জনগুলো এক সংবাদ সম্মেলনে তুলে ধরেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।

বিজ্ঞাপন

রোববার (৯ মার্চ) প্রশাসনিক ভবনস্থ অধ্যাপক আবদুল মতিন চৌধুরী ভার্চুয়াল ক্লাসরুমে ঢাবি উপাচার্য অধ্যাপক ড. নিয়াজ আহমদ খান সাংবাদিকদের ব্রিফিং প্রদান করেন।

তিনি বলেন, গণআন্দোলন-পরবর্তী সময়ে শিক্ষার্থীদের দাবির মুখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ভিসি, প্রো-ভিসি, প্রক্টরসহ বেশিরভাগ হলের প্রভোস্ট এবং অন্যান্য প্রশাসনিক দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাবৃন্দ পদত্যাগ করার ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক কার্যক্রম রীতিমতো স্থবির হয়ে পড়ে। এরকম অস্থির ও অস্বাভাবিক সময়ে দায়িত্ব গ্রহণ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন প্রশাসন এক মাসেরও কম সময়ের মধ্যে সকল বিভাগ ও ইন্সটিটিউটে ক্লাস চালু করতে সক্ষম হয়েছে।

বিজ্ঞাপন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন প্রশাসনের দায়িত্ব গ্রহণের ৬ মাসে ১২টি উল্লেখযোগ্য কার্যক্রম:

১. আবাসিক হলে গণরুম প্রথা বিলুপ্তিকরণ

আবাসিক হলে দীর্ঘকাল ধরে গণরুম প্রথা চলে আসছিল। প্রতিটি গণরুমে অনেক সময় ৩০-৪০ জনকেও থাকতে হতো। নতুন প্রশাসন দায়িত্ব নিয়েই সর্বসম্মতিক্রমে গণরুম প্রথা বাতিল করে মেধা ও প্রয়োজনের ভিত্তিতে আসন বণ্টনের নিয়ম চালু করে।

২. জুলাই বিপ্লব সংক্রান্ত পদক্ষেপ সমূহ

জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সম্মান ও মর্যাদা রক্ষায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে 'জুলাই গণঅভ্যুত্থান কর্নার' এবং জুলাই স্মৃতি সংগ্রহশালা প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। ডাকসু ভবনের দ্বিতীয় তলার একটি কক্ষে সাময়িক ভাবে জুলাই আন্দোলন স্মৃতি সংগ্রহশালা প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। সংগ্রহশালায় সংরক্ষণের জন্য শহিদ মো. আবু সাঈদ মিয়া, শহিদ মো. ওয়াসিম আকরাম, শহিদ মীর মাহফুজুর রহমান মুগ্ধ এবং শহিদ মোহাম্মদ ফারহানুল ইসলাম ভূঁইয়া (ফারহান ফাইয়াজ)-এর ব্যবহৃত জিনিসপত্র সংগ্রহ করা হয়েছে। খুব শীঘ্রই এই সংগ্রহশালার উদ্বোধন করা হবে।

আন্দোলন চলাকালে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে সহিংসতায় জড়িতদের চিহ্নিত করে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়ার উদ্দেশ্যে একটি সত্যানুসন্ধান কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটি অতিদ্রুতই রিপোর্ট প্রদান করবে।

এর পাশাপাশি আহত শিক্ষার্থীদের সুচিকিৎসার জন্য ৬-সদস্য বিশিষ্ট কমিটি গঠন করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। এই কমিটি আহত শিক্ষার্থীদের চিকিৎসা কার্যক্রমে সার্বিক বিষয়ে দেখভাল করছে।

ইতোমধ্যে আহত ১২ জন শিক্ষার্থীকে প্রায় ৫ লাখ টাকা আর্থিক সহায়তা প্রদান করা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়কে শিক্ষার্থীদের জন্য নিরাপদ করে গড়ে তুলতে এসব কার্যক্রম ইতিবাচক ভূমিকা পালন করবে বলে প্রশাসন আশাবাদী।

৩. বিশেষ আপদকালীন আর্থিক সহায়তা

হলে আবাসিক সিট পাওয়ার সকল শর্ত পূরণ করা সত্ত্বেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যেসকল ছাত্রীকে আসন বরাদ্দ দেয়া সম্ভব হচ্ছেনা, বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব অর্থায়নে তাদের প্রতি মাসে ৩ হাজার টাকা হারে বিশেষ আপদকালীন আর্থিক সহায়তা প্রদান করা হবে।

৪. উচ্চতর গবেষণাকেন্দ্র সমূহে পরিচালক নিয়োগে স্বচ্ছতা নিশ্চিতকরণ

নতুন প্রশাসন দায়িত্ব গ্রহণের পর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে থাকা উচ্চতর গবেষণা কেন্দ্রসমূহে পরিচালক নিয়োগের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ও যোগ্যতাকে সর্বোচ্চ প্রাধান্য দিয়েছে। এই প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে বিভিন্ন ইন্সটিটিউটে পরিচালক নিয়োগের লক্ষ্যে সার্চ কমিটি গঠন করা হয়েছে।

৫. গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ চর্চা

গণতন্ত্র চর্চা, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও মানবাধিকার বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টি এবং এসংক্রান্ত মৌলিক গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনার লক্ষ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে অ্যাপ্লাইড ডেমোক্রেসি ল্যাব। শিক্ষার্থীদের দক্ষ মানবসম্পদ হিসেবে গড়ে তুলতেও এই ল্যাব কার্যকর অবদান রাখবে বলে আশা করা যাচ্ছে।

৬. ছাত্ররাজনীতির সংস্কার

দায়িত্ব নেয়ার পর থেকে ডাকসু নির্বাচনসহ বিভিন্ন বিষয়ে শিক্ষার্থী ও অন্যান্য অংশীজনদের সাথে নতুন প্রশাসন মতবিনিময় করে আসছে। ক্যাম্পাসে রাজনীতি চর্চার প্রকৃতি ও ধরণ বিষয়ে প্রয়োজনীয় পরামর্শ ও সুপারিশ প্রদানের জন্য খ্যাতিমান ব্যক্তিবর্গের সমন্বয়ে একটি বিশেষ কমিটি গঠন করা হয়েছে। বিভিন্ন বিষয়ে প্রধান অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনা, মতবিনিময় ও পরামর্শ গ্রহণের লক্ষ্যে উপাচার্যের অফিসে একটি পরামর্শ বাক্স স্থাপন ও বিশেষ একটি ই-মেইল খোলা হয়েছে।

৭. ডাকসু নির্বাচন সংক্রান্ত ৩টি পৃথক কমিটি গঠন

ডাকসু ও হল সংসদ নির্বাচন সফলভাবে আয়োজনের বিষয়ে পরামর্শদান, নির্বাচনের আচরণবিধি প্রণয়ন/সংশোধন এবং ডাকসু ও হল সংসদের গঠনতন্ত্র সংশোধন/পরিমার্জন করার বিষয়ে পৃথক ৩টি কমিটি গঠন করা হয়েছে। এসব কমিটির কাজ ইতোমধ্যেই চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে।

৮. বিশ্ববিদ্যালয়ের অবকাঠামো ও প্রশাসনিক উন্নয়ন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের আবাসন সংকট নিরসনসহ তিনটি মেগা প্রকল্প শিগগিরই বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে বলে আশা করা যাচ্ছে। ২ হাজার ৮শ' ৪১ কোটি ৮৬ লাখ টাকা প্রাক্কলিত ব্যয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকতর উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় ছাত্রীদের জন্য ৪টি হল, ছাত্রদের জন্য ৫টি হলসহ বিভিন্ন ভবন নির্মাণ করা হবে। এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে প্রায় ৩ হাজার ছাত্রী ও ৫ হাজার ১০০ ছাত্রের আবাসনের ব্যবস্থা হবে।

এছাড়া, চীন সরকারের আর্থিক সহযোগিতায় ২৪৪ কোটি টাকা প্রাক্কলিত ব্যয়ে বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী হল নির্মাণ প্রকল্পের আওতায় ছাত্রীদের জন্য একটি হল নির্মাণ করা হবে। সেখানে ১ হাজার ৫০০ ছাত্রীর আবাসনের ব্যবস্থা হবে। বাংলাদেশে নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত মি. ইয়াও ওয়েন ছাত্রী হল নির্মাণে সহযোগিতার ব্যাপারে তাঁর অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করেছেন।

বিভিন্ন হলে শিক্ষার্থীদের জন্য মানসম্মত খাবারের ব্যবস্থা নিশ্চিতকল্পে হল মেস চালু করা, ক্যান্টিনের মালিকানা পরিবর্তনসহ নানাবিধ উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে।

শহিদ ড. মোর্তজা মেডিকেল সেন্টারকে অটোমেশনের আওতায় আনা ও সেবার মান বৃদ্ধি করার লক্ষ্যে বিভিন্ন পদক্ষেপ (যেমন এক্সরে মেশিন ক্রয়, নতুন চিকিৎসক নিয়োগ, প্যাথলজির আধুনিকীকরণ, অবকাঠামোগত সংস্কার ইত্যাদি) নেয়া হয়েছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিশেষ করে নারী শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার স্বার্থে ক্যাম্পাসে বহিরাগত যানবাহন নিয়ন্ত্রণের জন্য ছয়টি প্রবেশদ্বারে এবং বিএনসিসি ভবনের সামনে যানবাহন নিয়ন্ত্রক ব্যারিয়ার ও চেকপোস্ট বসানো হয়েছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌন নিপীড়ন বিষয়ক সেলের কার্যপরিধি বাড়ানোর ব্যাপারে পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে।

৯. শিক্ষাগত উৎকর্ষতা ও গবেষণা কার্যক্রম

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা কার্যক্রম ত্বরান্বিত করতে উল্লেখযোগ্য কিছু ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে প্রশাসন। পরিবেশ, কৃষি, স্বাস্থ্য, পারমাণবিক বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তি বিষয়ে গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনার পাশাপাশি চীন, জাপান, এবং ইউরোপের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যৌথ শিক্ষা ও গবেষণা কার্যক্রম জোরদার করার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে।

সম্প্রতি প্রকাশিত কিউএস এশিয়া ইউনিভার্সিটি র‍্যাঙ্কিংয়ে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে শীর্ষস্থানে রয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। বৈজ্ঞানিক গবেষণা নিবন্ধ প্রকাশে দেশ সেরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক 'স্কোপাজ ডাটাবেজ'-এর বিভিন্ন উপাত্ত বিশ্লেষণ করে সম্প্রতি এ তথ্য প্রকাশ করেছে বাংলাদেশের গবেষণা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণকারী ম্যাগাজিন 'সায়েন্টিফিক বাংলাদেশ'।

১০. শিক্ষার্থীদের জন্য প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা প্রদান

অসচ্ছল ও মেধাবী শিক্ষার্থীদের জন্য বৃত্তি কার্যক্রম জোরদার করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। শিক্ষার্থীদের মানসিক সুস্থতা বজায় রাখার লক্ষ্যে কাউন্সেলিং, কর্মশালা ও বিভিন্ন সেবা প্রদান কর্মসূচির আয়োজন করা হচ্ছে। উন্নত চিকিৎসাসেবা প্রদানের লক্ষ্যে হলভিত্তিক টিকা কার্যক্রম, রক্তদান কর্মসূচি ইত্যাদির আয়োজন করা হয়েছে।

১১. ক্যাম্পাসে শাটল বাস সার্ভিস চালুকরণ

শিক্ষার্থীদের অভ্যন্তরীণ চলাচলের সুবিধার্থে প্রথমবারের মতো ক্যাম্পাসে শাটল বাস সার্ভিস চালু করা হয়েছে। ৩টি নন এসি মিনিবাস সকাল ৭ টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত চক্রাকারে ক্যাম্পাসের ৩টি রুটে চলাচল করছে।

১২. পরিবেশ সংরক্ষণ ও সহশিক্ষামূলক কার্যক্রম

বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় পরিবেশ সংরক্ষণ ও উন্নয়নের লক্ষ্যে পরিচ্ছন্নতা অভিযান, প্লাস্টিক বর্জন কর্মসূচি, বৃক্ষরোপণ মেলা ইত্যাদি ইতিবাচক পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে।

এছাড়াও, কয়েকটি হলে 'মব জাস্টিস' বিরোধী সচেতনতামূলক কর্মসূচি পালন করা হয়েছে। বিভিন্ন রকম সহশিক্ষামূলক কার্যক্রম, যেমন বিতর্ক প্রতিযোগিতা, আলোকচিত্র প্রদর্শনী, যোগব্যায়াম প্রশিক্ষণ ইত্যাদি আয়োজন করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।

এসময় প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর (প্রশাসন) অধ্যাপক ড. সায়মা হক বিদিশা, প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর (শিক্ষা) অধ্যাপক ড. মামুন আহমেদ, কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. এম. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী, প্রক্টর সহযোগী অধ্যাপক সাইফুদ্দীন আহমদ এবং ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার মুনসী শামস উদ্দিন আহম্মদ উপস্থিত ছিলেন।