মসজিদে হারামে দায়িত্ব পালন করছেন এক নারী পুলিশ, ছবি: সংগৃহীত
ইসলাম
চলতি রমজান মাসে বিশ্বের নানাপ্রান্তের অসংখ্য মানুষ পবিত্র উমরা পালন করতে সৌদি আরবের মক্কায় অবস্থান করছেন। মক্কায় এখন উপচেপড়া ভিড়। এমতাবস্থায় মসজিদে হারামে মুসল্লিদের চাপ কমাতে ও শৃঙ্খলা বজায় রাখতে নানা উদ্যোগ নিয়েছে সৌদি সরকার।
এর অংশ হিসেবে মুসল্লিদের মক্কার হারাম সীমানার ভেতরে অবস্থিত যেকোনো মসজিদে নামাজ পড়তে উৎসাহিত করা হচ্ছে। সেই সঙ্গে জনসচেতনতা সৃষ্টিতে নানা প্রচারণা চালাচ্ছে।
বিজ্ঞাপন
প্রচারণায় মসজিদে হারামের নিরাপত্তা বাহিনী কর্তৃক দেওয়া নির্দেশাবলী অনুসরণ এবং নিয়মকানুন মেনে চলার জন্য কঠোরভাবে অনুরোধ করা হয়েছে।
আরব নিউজের খবরে বলা হয়েছে, মসজিদে হারামের সিকিউরিটি ফোর্স জানিয়েছে যে, উমরা পালনকারীদের নিরাপত্তা ও চলাচলের সুবিধার কারণে বিভিন্ন স্থানে অস্থায়ী বাধা এবং প্রতিবন্ধকতা স্থাপন করা হয়েছে। এগুলো খোলা কিংবা বাধা সত্ত্বেও অতিক্রম করা আইনের লঙ্ঘন, যা চলাচলের প্রবাহকে বাধাগ্রস্ত করে। এগুলো অতিক্রম করা বিপজ্জনক হতে পারে।
বিজ্ঞাপন
উমরাযাত্রীদের নিরাপদ ও সুশৃঙ্খল পরিবেশে আচার-আচরণ পালন এবং নামাজ আদায় নিশ্চিত করার জন্যই এসব ব্যবস্থা। এমতাবস্থায় নিরাপত্তা বাহিনীর কাজকে বাধাগ্রস্ত করে এমন কাজ না করা এবং সর্বাবস্থায় সহযোগিতা করার জন্য আবেদন করেছে কর্তৃপক্ষ।
গত উমরা মৌসুমে মক্কা নগর ও পবিত্র ভূমি বিষয়ক রয়েল কমিশন ‘অল অব মক্কা ইজ হারাম’ শীর্ষক একটি ক্যাম্পেইন চালু করে। রয়েল কমিশন হারাম সীমানার মধ্যে যেকোনো মসজিদে নামাজ পড়ার ওপর জোর দিচ্ছে।
রয়েল কমিশন বিবৃতিতে জানায়, মক্কায় যে আধ্যাত্মিক প্রশান্তি মুসল্লিরা উপলব্ধি করেন তা শুধু গ্র্যান্ড মসজিদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং তা হারাম সীমান্তের মধ্যে অন্য মসজিদও বিশেষ এই প্রতিদান অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। যেমন- মক্কার আয়েশা মসজিদ, আল-রাজি মসজিদ, আল-বালাদ আল-আমিন কমপ্লেক্স মসজিদ, আবদুল কাদির আল-নুসাইর মসজিদ, আল-মুহাজিরিন মসজিদ, কিং আবদুল আজিজ মসজিদ, প্রিন্সেস ফাহদা আল-সুদাইরি মসজিদ ও শেখ ইবনে বাজ মসজিদ।
উল্লেখ্য, ইসলামে মক্কার নিষিদ্ধ তথা সম্মানিত এলাকাকে হারাম বলা হয়। হারামের সীমানার মোট আয়তন ৫৬০ বর্গকিলোমিটার। এর ভৌগোলিক সীমারেখা হলো, মক্কার উত্তরে পাঁচ কিলোমিটার পর্যন্ত আল-তানিম বিস্তৃত। আর পশ্চিমে জেদ্দা গভর্নরেটের দিকে ১৮ কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত। দক্ষিণে আরাফাতের ময়দান থেকে পবিত্র মসজিদুল হারামের দিকে ২০ কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত এবং পূর্বে জারানার দিকে ১৪.৫ কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত।
আরবি ইতিকাফ শব্দের অর্থ অবস্থান করা। শরিয়তের পরিভাষায়, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ জামাতসহকারে নিয়মিত আদায় করা হয় এমন মসজিদগুলোয় আল্লাহর ইবাদতের উদ্দেশ্যে নিয়তসহ অবস্থান করাকে ইতিকাফ বলে।
মাহে রমজানের শেষ ১০ দিন ইতিকাফ করা সুন্নতে মুয়াক্কাদা কিফায়া। অর্থাৎ মহল্লার কয়েকজন আদায় করলে সবার পক্ষ থেকে আদায় হয়ে যাবে। কিন্তু কেউই আদায় না করলে সবাই গুনাহগার হবে। তাই রমজানের শেষ দশক শুরু হওয়ার আগেই প্রতি মহল্লা থেকে অন্তত একজন মানুষ যেন ইতিকাফে বসেন, সে বিষয়ে মহল্লার আলেম-উলামাসহ সবার খেয়াল রাখা চাই।
ইতিকাফকারীকে রমজানের ২০তম দিনের (শুক্রবার) সূর্য ডোবার আগেই নিয়ত করে মসজিদে প্রবেশ করতে হবে। এ জন্য আগেভাগেই প্রস্তুত হওয়া উচিত। রমজানের শেষ দশকের কাজকর্ম আগেই সম্পাদন করা উচিত। পরিবারের দায়িত্ব থাকলে তা আদায় করা, বাজারসদাই করে দেওয়া, ১০ দিনের আয়-রোজগার আগেই প্রস্তুত রাখতে হবে, যাতে ইতিকাফের সময় পরিবারের লোকজন কোনো ধরনের সমস্যায় না পড়ে।
এ ছাড়া ইতিকাফের জন্য ব্যক্তিগত প্রস্তুতিগুলো আগেই সেরে নেওয়া উচিত। শারীরিক পরিচ্ছন্নতা অর্জন, কাপড়চোপড় ধোয়া এবং অন্যান্য ব্যক্তিগত কাজ সেরে নেওয়া গুরুত্বপূর্ণ।
মনে রাখতে হবে, ইতিকাফে বসা হয় পার্থিব সব ব্যস্ততা থেকে মুক্ত হয়ে ১০টি দিন নিভৃতে আল্লাহর ইবাদত করার জন্য। তাই এ সময়ে অন্য কোনো কাজ করা অনুচিত।
রমজানের সুন্নত ইতিকাফ শুদ্ধ হওয়ার তিনটি শর্ত রয়েছে, যা প্রত্যেক ইতিকাফকারীকে মেনে চলতে হবে। এক. মসজিদে অবস্থান করা; তবে নারীরা নিজ নিজ বাড়িতে ইতিকাফ করবে। দুই. গোসল ফরজ হলে শরীর পবিত্র করে নেওয়া। তিন. রোজা রাখা।
ইতিকাফের রয়েছে অনন্য ফজিলত। হাদিসে নবী কারিম (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি রমজান মাসের শেষ ১০ দিন ইতিকাফ করবে, তাকে দুটি হজ ও দুটি উমরার সওয়াব দান করা হবে।’ -শোয়াবুল ইমান
তাই সবার উচিত, সম্ভব হলে প্রতিবছর রমজানের শেষ ১০ দিন ইতিকাফ করা। রোজা ফরজ হওয়ার পর থেকে নবী কারিম (সা.) এ আমল কখনো ত্যাগ করেননি।
ইসলামের বিধানে, রমজানের শেষ দশকের গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত ইতিকাফ মসজিদে পালন করার নিয়ম। আগেই বলা হয়েছে, এলাকাবাসীর কোনো একজন ইতিকাফে বসলে সবার পক্ষ থেকে আদায় হয়ে যাবে। আর কেউ আদায় না করলে সবাই গুনাহগার হবে। এখন কোনো এলাকায় যদি কেউ পুরো ১০ দিন ইতিকাফে না বলে তাহলে এর বিধান কী হবে?
এমন পরিস্থিতির ক্ষেত্রে ইসলামি আইন ও ফেকাহশাস্ত্রবিদেরা বলেন, মহল্লার কোনো একজনও পুরো ১০ দিন ইতিকাফে না বসলে কারো সুন্নত ইতিকাফ আদায় হবে না এবং এলাকাবাসী সুন্নত ইতিকাফ থেকে দায় মুক্ত হবে না। কারণ সুন্নত ইতিকাফের জন্য একজন হলেও রমজানের শেষের পুরো দশ দিন ইতিকাফ করতে হবে। তিন জন ভাগ করে দশ দিন অবস্থান করলে কারো সুন্নত ইতিকাফ আদায় হবে না; সেটা নফল ইতিকাফ বলে গণ্য হবে। -ফাতহুল কাদির: ২/৩০৫
রোজা পালনের মাধ্যমে মানুষ ত্যাগ ও তিতিক্ষার সাধনা করে, ছবি: সংগৃহীত
ইসলাম
রোজা ইসলামের অন্যতম ফরজ বিধান। ইবাদত ও আমলের পাশাপাশি এর আছে সামাজিক গুরুত্ব। নিম্নে রোজার সামাজিক গুরুত্ব নিয়ে আলোচনা করা হলো-
আদর্শ সমাজ গঠন: আদর্শ সমাজ ও জাতি গঠনের উদ্দেশ্যে রোজা তার মহান শিক্ষা নিয়ে প্রতিবছর একবার করে বাধ্যতামূলক আগমন করে। ইসলাম প্রকৃতপক্ষে এই অতুলনীয় নিয়মটির প্রবর্তন করে অফুরন্ত পুণ্য ও অমূল্য ফলদানকারী একটি চিরহরিত্ বৃক্ষরোপণ করেছে। এর ফলে সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয় এবং আদর্শ নতুন সমাজ গড়ে ওঠে।
সদ্ব্যবহারের শিক্ষা: রমজান মাস পরস্পর সহানুভূতি ও সদ্ব্যবহারের মাস। এ মাস সমাজে খেটে খাওয়া মানুষের প্রতি সদ্ব্যবহারের শিক্ষা দেয়। নবী কারিম (সা.) বলেন, এ মাসে যারা দাস-দাসীদের কাজের বোঝা হালকা করে দেয়, আল্লাহতায়ালা তাদের ক্ষমা করে দেবেন এবং দোজখের আগুন থেকে নাজাত দান করবেন।
বিপ্লবী শিক্ষা: রোজার সাহরি ও ইফতার হালাল রুজি দ্বারা করা, রোজা রেখে মিথ্যা কথা না বলা, পরনিন্দা ও গিবত না করা প্রভৃতি এই রোজাই শিক্ষা দিয়েছে। তা ছাড়া ‘আমি রোজাদার’-এ কথা বলে সর্বপ্রকার গোলযোগ থেকে দূরে থাকা যায়। পূর্ণ এক মাস আত্মশুদ্ধির ট্রেনিং নিয়ে মানুষ স্বাভাবিকভাবেই অন্যায় কাজ থেকে বিরত থাকে। এটাই রোজার একটি বিপ্লবী শিক্ষা।
ত্যাগের শিক্ষা: রোজা পালনের মাধ্যমে মানুষ ত্যাগ ও তিতিক্ষার সাধনা করে। রোজার মাধ্যমে তাকে এক কঠিন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে হয়। সাহরি খাওয়ার মাধ্যমে সারা দিনের জন্য রোজা শারীরিক ও মানসিক প্রস্তুতি এক অনন্য ত্যাগের শিক্ষা।
সমবেদনা প্রকাশ: সিয়াম পালন করে বোঝা যায়, সমাজে যারা অভুক্ত তাদের দুঃখ-বেদনা। ধনিক শ্রেণি দরিদ্রের ক্ষুধা ও অনাহার যাতনার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা লাভ করে। ফলে দরিদ্রের প্রতি তাদের অন্তরে সহানুভূতি জাগ্রত হয়। এ জন্য নবী কারিম (সা.) রমজান মাসকে সমবেদনা ও সহমর্মিতার মাস বলে আখ্যায়িত করেছেন।
সাম্য প্রতিষ্ঠা: সাওম সমাজে সাম্য প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। এই সময় ধনী-নির্ধন সর্বস্তরের মানুষ এক কাতারে এসে শামিল হয়। একই নিয়তে, একই উদ্দেশ্যে যখন সবাই পানাহার, কামাচার ও ভোগ লালসা হতে বিরত থাকে, তখন অন্তরে প্রবাহিত হয় সাম্যের এক অনাবিল প্রবাহ।
নিয়মানুবর্তিতার প্রশিক্ষণ: রমজান মানুষকে নিয়মানুবর্তিতার ওপর প্রতিষ্ঠিত করে এবং সুস্থভাবে বেঁচে থাকার প্রেরণা জোগায়। এ মাসে যথাসময়ে সাহরি খাওয়া, যথাসময়ে ইফতার করা, যথাসময়ে তারাবির নামাজ আদায় প্রভৃতি মানুষকে নিয়মানুবর্তিতার শিক্ষা দেয়।
বদভ্যাস দূরীকরণ: রমজান মাসে রোজাদার ব্যক্তি তার সব বদভ্যাস পরিহার করতে সচেষ্ট। এ মাসে তার মন থেকে হিংসা-বিদ্বেষ, অনুকরণ, রাগ, ষড়যন্ত্র, বাগবিতণ্ডা, কু-ধারণা, ঠাট্ট-বিদ্রূপ, সীমা লঙ্ঘন, জুলুম-নির্যাতন, পরনিন্দার মতো কতগুলো বদভ্যাস দূরীভূত হয়। বাকি ১১ মাস আল্লাহ পাকের সব আদেশ-নিষেধের আনুগত্যের অভ্যাস বান্দার মধ্যে গড়ে ওঠে।
দৈহিক উপকারিতা: রোজার প্রায় সব বিধি-নিষেধই স্বাস্থ্য বিধিসম্মত। অনেক জটিল রোগের উপশমে রোজা
বিস্ময়কর সফল মাধ্যম: চিকিৎসকদের মতে, রোজা দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। শরীরের পরিপাক প্রক্রিয়ায় সুস্থতা বিধানে ব্যাপক ভূমিকা পালন করে। দেহযন্ত্রটি সচল রাখার জন্য অবশ্যই সার্ভিসিং করা এবং রেস্ট দেওয়ার প্রয়োজন হয়। বিশ্ববিখ্যাত ডাক্তার আর ক্যামফোর্ডের মতে, ‘সাওম হচ্ছে পরিপাক শক্তির শ্রেষ্ঠ সাহায্যকারী।’ তাই একজন রোজাদার ব্যক্তির রোজা সুস্বাস্থ্যের জন্য একটি শক্তিশালী অস্ত্র।
পরিচ্ছন্ন সামাজিক জীবন: সিয়াম সাধনাকারীর এক মাস সিয়াম পালনের মধ্য দিয়ে তার দেহমনে এক যুগান্তকারী পরিবর্তন সাধিত হয়। এ মাসে সব কু-অভ্যাস ও অসামাজিক কার্যকলাপ থেকে বিরত থাকে বলে সে পরিচ্ছন্ন ও সুস্থ জীবন-যাপনে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে।
ধনী-দরিদ্রের ব্যবধান হ্রাস: রমজান মানুষকে এ শিক্ষা দেয় যে আল্লাহর বান্দা হিসেবে প্রত্যেক মানুষ সমান। মানুষে মানুষে যে কোনো পার্থক্য নেই, তা ধনী-দরিদ্র-নির্বিশেষে সবার রোজা পালনের দ্বারা বুঝতে পারা যায়। সবাই একই সময়ে সাহরি খায়, একই সময়ে ইফতার করে, একই সময়ে তারাবির নামাজ পড়ে এবং রমজান শেষে ঈদের নামাজ আদায় করে। ফলে ধনী-দরিদ্রের মধ্যে কোনোরূপ ব্যবধান থাকে না।
মানুষের ষড়রিপু দমন: রোজা শুধু পেটের রোজা নয়। চোখের রোজা, কানের রোজা, মুখের রোজা, হাত-পায়ের রোজা। এই রোজার অর্থ হচ্ছে চোখ সে সব কিছু দেখবে না, কান সে সব কিছু শুনবে না, মুখ সে সব কিছু বলবে না, অঙ্গ-প্রতঙ্গ সে সব কাজ করবে না- আল্লাহতায়ালা যেসব অপছন্দ করেন এবং যা কিছু করতে নিষেধ করেছেন।
সুস্থ বিবেকের বিকাশ: রোজা পালনে বান্দাকে বাধ্য করার মতো কোনো জাগতিক কর্তৃপক্ষ বর্তমান থাকে না। তা সত্ত্বেও সে গোপনে ও প্রকাশ্যে বিশ্বস্ততার সঙ্গে রোজা রাখে শুধু আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার জন্য। একটি সুস্থ বিবেকের বিকাশ ঘটানোর জন্য এর চেয়ে উত্তম পথ আর কিছু হতে পারে না।
ভ্রাতৃত্ব বন্ধন সুদৃঢ়: সাওমের মাধ্যমে মানুষে মানুষে যে অধিকার রয়েছে তার বাস্তবতা প্রতিষ্ঠিত হয়। এটি সমাজের মানুষের মধ্যে পারস্পরিক হৃদ্যতা ও ভ্রাতৃত্ববোধকে সুদৃঢ় করে এবং তাদের মধ্যে কর্তব্য ও দায়িত্ববোধের অনুপ্রেরণা জোগায়।
অনেককেই দেখা যায়, রোজা রাখা সত্ত্বেও নামাজ পড়েন না, কোরআন মাজিদ তেলাওয়াত করেন না; বরং ঘণ্টার পর ঘন্টা মোবাইল ফোন, টেলিভিশন ও গল্প-গুজবের মাধ্যমে সময় পার করে দেন। তারা হয়তো রোজা রাখা বলতে উপবাস থাকাকেই মনে করেন। অথচ, রোজা শুধু উপবাস নয়।
উপবাস হলো- একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত কিছু নির্দিষ্ট বা সব ধরনের খাদ্য বা পানীয় অথবা সব ধরনের পানাহার থেকে বিরত থাকা।
অন্যদিকে রোজা হলো- সুবহে সাদিকের পর থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত সব ধরনের পানাহার ও যৌনাচারসহ সব ধরনের অনৈতিক ও পাপাচার থেকে বিরত থাকা। এর মূল উদ্দেশ্য আত্মশুদ্ধির মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন এবং ক্ষমা লাভ; যা শুধু উপবাসের মাধ্যমে অর্জিত হয় না।
কোরআন মাজিদে রোজার উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘হে ঈমানদারগণ! তোমাদের ওপর রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেমন ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর, যাতে তোমরা তাকওয়ার গুণ অর্জন করতে পারো।’
তাকওয়ার গুণ বলতে বুঝায় পাপ থেকে বেঁচে থাকা। কুপ্রবৃত্তি বা নফসের খাহেশাত থেকে আত্মরক্ষা করে বিবেকবোধের ওপর, সততা ও ঈমানদারির অটল-অবিচল থাকার সক্ষমতা।
সুতরাং রোজা রাখা মানে শুধু না খেয়ে থাকা নয়; বরং রোজা রাখা মানে হলো মনকে নিয়ন্ত্রণ করা। মন ভালো ভালো খাবার খেয়ে রসনা তৃপ্ত করতে চায়, ভোগ-বিলাস করতে চায়, রোজা রেখে অলস সময় কাটাতে চায়, আরামে শুয়ে শুয়ে অলস সময় কাটাতে চায়, সিনেমা, খেলা, গান-বাজনা, ফেসবুক ইত্যাদির মধ্যে ডুবে থেকে সময় পার করতে চায়। আবার কর্মক্ষত্রে দায়িত্বে অবহেলা, মানুষকে হয়রানি কিংবা মিথ্যা, প্রতারণা, শঠতা, সুদ, ঘুষ, চুরি, ডাকাতি, খেয়ানত, চাঁদাবাজি, অনৈতিক সুবিধা আদায় বা প্রদানের মাধ্যমে অবৈধভাবে অর্থবিত্তের মালিক হতে চায়। অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল ও প্রভাব-প্রতিপত্তি অর্জন করে লোক দেখানো দান-সদকাও করতে চায়।
রোজাদারকে এসব অবস্থায় নিজের মনের লাগাম টেনে ধরতে হয়। কুপ্রবৃত্তির ওপর সুপ্রবৃত্তি বা বিবেকবোধ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে হয়। যদিও এটা সহজ কাজ নয়। এ জন্য রীতিমতো সাধনা করতে হয়। এ কারণেই রোজাকে বলা হয় সিয়াম সাধনা তথা আত্মশুদ্ধির সংগ্রাম।
ইসলামের পরিভাষায় এই সংগ্রামকেই বলা হয় জিহাদে আকবর বা বড় জিহাদ। আর এর পুরষ্কারও তেমনি বড়। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত এক হাদিসে রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, আদম সন্তানের প্রতিটি নেক কাজের ফলাফল দশগুণ হতে সাতশত গুণ পর্যন্ত বর্ধিত করে দেওয়া হবে। কিন্তু রোজার ব্যাপারে এর ব্যতিক্রম হবে। কেননা আল্লাহ স্বয়ং বলেন, ‘বান্দা আমার সন্তুষ্টি বিধানের জন্যে রোজা রেখেছে এবং আমি নিজেই এর প্রতিদান দেব। সে তো আমার কথা মতই খানা-পিনা ও কামনা-বাসনা ত্যাগ করেছে।’
কিন্তু যারা নফসকে নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হবে তারা রোজার ফজিলত থেকে বঞ্চিত হবে। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত এক হাদিসে নবী কারিম (সা.) বলেছেন, ‘এমন বহু রোজাদার আছে, যাদের রোজা উপবাস ছাড়া আর কিছু নয়। আবার এমন অনেক নামাজি আছে যাদের নামাজ নিছক রাত্রী জাগরণ ছাড়া আর কিছু নয়।’
রমজানের প্রথম দশ দিন রহমত, দ্বিতীয় দশ দিন বরকত আর তৃতীয় দশ দিনে রয়েছে মাগফিরাত ও জাহান্নাম থেকে মুক্তি লাভের সুযোগ। এই সময়গুলোতে আল্লাহর রহমত, বরকত ও মাগফিরাত লাভের আশায় রোজা রেখে একদিকে যেমন গুনাহ থেকে বেঁচে থাকতে হয়, তেমনি এই পবিত্র মাসে বেশি বেশি করে নেক আমল করতে হয়।
এক কথায়, রমজান মাসের প্রতিটি মুহূর্ত মূল্যবান। তাই এই মাসে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ জামাতে পড়ার ব্যাপারে যত্নবান হওয়া উচিত। ফরজ নামাজের পাশাপাশি বেশি বেশি কোরআন তেলাওয়াত ও অধ্যয়ন, নফল নামাজ পড়া (ফরজ নামাজের আগে ও পরে অতিরিক্ত নামাজ, তারাবি ও তাহাজ্জুদ), বেশি দান-সদকা (বাধ্যতামূলক দান জাকাত ও ফেতরা ছাড়াও অতিরিক্ত দান-সদকা ও উপহার প্রদান) করা, বেশি বেশি তাসবিহ-তাহলিল ও জিকির-আজকার করা, হাদিস পাঠ ও ইসলামি বইপত্র পড়া। এ ছাড়া যথাসময়ে ও যত্নের সঙ্গে নামাজ আদায় করার চেষ্টা করা। একটু আগে আগেই মসজিদে চলে যাওয়া, যাতে সুন্নত ও নফল নামাজ পড়া যায়। মসজিদে যেয়ে প্রথমে দুই রাকাত নামাজ পড়ে নেওয়া উচিত। আল্লাহর রাসূল (সা.) এ আমলটি নিয়মিত করতেন এবং সাহাবিদেরকেও করার জন্য উৎসাহিত করতেন।
রোজা রেখে কোরআন তেলাওয়াত করা, ছবি: সংগৃহীত
রমজান মাসের ব্যাপারে যারা উদাসীন তাদের উদ্দেশে নবী কারিম (সা.) বলেছেন, ‘ধ্বংস হোক ওই ব্যক্তি, যে রমজান মাস পেলো, অথচ নিজের গুনাহ মাফ করাতে পারলো না।’ -জামে তিরমিজি: ৩৫৪৫
সুতরাং, শুধু উপবাস নয়, খোদাভীতি ও আত্মার উন্নয়ন সাধনার মধ্যেই নিহিত রয়েছে রোজার আসল ফজিলত। কিন্ত রোজাদারকে এ লক্ষ্য ও ফজিলত থেকে বিচ্যুত করে ডিজিটাল আসক্তি। বিশেষ করে এর সহজ শিকার হচ্ছে তরুণরা।
ডিজিটাল আসক্তি তরুণদের ইচ্ছাশক্তি ও কর্মোদ্দীপনাকে নষ্ট করার পাশাপাশি তাদের মধ্যে অলসতা, অপরিপক্বতা এবং বিষণ্ণতা বৃদ্ধি করছে। এর ফলে শুধু সিয়াম সাধনা নয়; পড়াশোনা, চিন্তাভাবনা, সৃজনশীলতা ও উদ্ভাবনাসহ সব ইতিবাচক ও গঠনমূলক কাজের প্রতি অনাগ্রহ ও অনীহা তৈরি করছে। অথচ অধ্যবসায় ও আত্মগঠনের সবচেয়ে সুন্দর ও উপযুক্ত সময় হলো- যৌবন কাল। এ সময়টা হলো মানব জীবনের সবচেয়ে উত্তম সময়। এ সময়টাতে মানুষের যে কর্মস্পৃহা, উদ্দীপনা, কর্মক্ষমতা ও শক্তি-সামর্থ থাকে তা অন্যসময়ে থাকে না। তরুণ বয়সে যত বেশি ও যত স্বাচ্ছন্দে ইবাদত-বন্দেগি করা যায় তা অন্য সময়ে করা যায় না।
অথচ এই মূল্যবান সময়টার প্রতিই সবচেয়ে অবহেলা ও অপচয় করা হয়। এ অপচয় আসলে একটা মারাত্মক খেয়ানত। কারণ, তারুণ্য ও যৌবনের এ মূল্যবান সম্পদ মানুষের প্রতি আল্লাহর দেওয়া এক বিরাট নেয়ামত। আর প্রতিটি নেয়ামত একেকটি আমানত। আল্লাহতায়ালা কেয়ামতের কঠিন সময়ে প্রতিটি নেয়ামতের হিসাব নেবেন।
তারুণ্যের আমানতকে ক্ষয়িষ্ণুতার হাত থেকে রক্ষা করতে হলে ডিজিটাল আসক্তি ও অপব্যবহার থেকে মুক্ত হতে হবে। বিশেষ করে স্মার্টফোন ও সোশ্যাল মিডিয়ার আসক্তি এখন মাদকাসক্তির মতই একটি ভয়াবহ অভিশাপ হিসেবে দেখা দিয়েছে। এ অভিশাপ থেকে মুক্তি পেতে অনেকেই ডিজিটাল ফাস্টিং করার চেষ্টা করেন। অর্থাৎ একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত এসব থেকে বিরত থাকা। এর ফলে ‘আসক্তি’ কাটিয়ে ওঠা সহজ হয়। আর এই ফাস্টিং’র ক্ষেত্রে বিশেষভাবে সহায়ক হতে পারে পবিত রমজান মাস।
ডিজিটাল উপবাস বেছে নেয়, যেখানে তারা একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য সমস্ত প্রযুক্তি থেকে বিরত থাকে। অন্যরা তাদের প্রযুক্তি ব্যবহার সীমিত করতে বেছে নিতে পারে, যেমন শুধুমাত্র জরুরি অবস্থার জন্য স্মার্টফোন ব্যবহার করা অথবা প্রতিদিন একটি নির্দিষ্ট সময়ের পরে ইমেল চেক না করা।
শেষ হলো মক্কার মসজিদে হারামের সম্প্রসারণ প্রকল্প। দীর্ঘ প্রায় ১৫ বছরের অক্লান্ত পরিশ্রম শেষে বহুল প্রতীক্ষিত এই প্রকল্পের কাজ সম্পন্ন হয়েছে। এর ফলে লাখ লাখ হজ ও উমরাযাত্রী আধুনিক বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা বোগ করবেন। বলা হচ্ছে, এর মধ্য দিয়ে সৌদি আরব এক নতুন যুগের সূচনা করেছে। সেই সঙ্গে ঘোষিত ভিশন ২০৩০ লক্ষ্য অর্জনে একধাপ এগিয়ে গেলো দেশটি।
প্রায় ১৫ বছর আগে শুরু হওয়া এই বৃহৎ প্রকল্পের লক্ষ্য ছিল মসজিদের অবকাঠামোকে আধুনিক করা, ধারণক্ষমতা বৃদ্ধি করা আর প্রতি বছর আগত লাখ লাখ হজ ও উমরাযাত্রীর জন্য আরও আরামদায়ক ও নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত করা।
মসজিদে হারামের এ সম্প্রসারণ প্রকল্প অবশেষে সফলভাবে শেষ হলো। বিস্তৃত সংস্কার ও সম্প্রসারণ কার্যক্রমের মাধ্যমে মসজিদে হারাম এক নতুন রূপ লাভ করেছে, যেখানে সংযোজিত হয়েছে অত্যাধুনিক সুযোগ-সুবিধা, উন্নত ভিড় ব্যবস্থাপনা ব্যবস্থা, ব্যাপকভাবে সম্প্রসারিত নামাজের স্থান। এই প্রকল্পের ফলে দর্শনার্থীদের অভিজ্ঞতা আরও উন্নত হবে বলে মনে করে সৌদি।
কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, সম্প্রসারণ প্রকল্পের সফল সমাপ্তি সৌদি আরবের দূরদর্শী দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন। দেশটি ধর্মীয় ঐতিহ্য সংরক্ষণের পাশাপাশি সৌদি আরবের বৃহত্তর ভিশন ২০৩০ লক্ষ্য অর্জনের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
এই প্রকল্প ব্যাপক সমর্থন লাভ করেছে, এর সফল সমাপ্তি হজ, উমরা এবং অন্যান্য বিশেষ উপলক্ষ্যে ক্রমবর্ধমান হজযাত্রীদের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
মসজিদে হারামের এই উন্নয়নের ধাপে প্রবেশ করায়, হজযাত্রী ও দর্শনার্থীরা আরও আধুনিক, দক্ষ ও আধ্যাত্মিকভাবে মনোমুগ্ধকর পরিবেশ উপভোগ করতে পারবেন।
শেষ হলো মক্কার মসজিদে হারামের সম্প্রসারণ প্রকল্প, ছবি: সংগৃহীত
নির্দিষ্ট সময়ে কাজটি শেষ করতে বেশ বেগ পোহাতে হয়েছে। এমনকি বৈশ্বিক মহামারি করোনার সংক্রমণ ও বিস্তাররোধে জারি করা লকডাউনেও মসজিদে হারামের নির্মাণ কাজ বন্ধ করা হয়নি।
সৌদি আরব প্রতিষ্ঠার পর এটা মসজিদে হারামের তৃতীয় সম্প্রসারণ প্রকল্প। এর ফলে মসজিদে হারামের আয়তন ৪১৪,০০০ বর্গমিটার থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ১.৫৬৪ মিলিয়ন বর্গমিটারে উন্নীত হবে। স্বাভাবিকবাবেই নামাজের জায়গা বাড়বে। সেই সঙ্গে উন্নত সুযোগ-সুবিধা সম্বলিত শৌচাগার ও অজুখানার সংখ্যাও বাড়বে।
ভবনের সম্প্রসারণ শেষ হলেও বাইরের সৌন্দর্যবর্ধনের কাজ চলবে। বিভিন্ন রঙের মনোমুগ্ধকর ধাতব বস্তু ও কাঁচের সংমিশ্রণে কোরআনে কারিমের ক্যালিগ্রাফি সমৃদ্ধ নকশাগুলো দর্শনার্থীদের দেবে তৃপ্তি।