রোজা, উপবাস ও ডিজিটাল ফাস্টিং

  • মুহাম্মদ আবুল হুসাইন, অতিথি লেখক, ইসলাম
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

রোজা, উপবাস ও ডিজিটাল ফাস্টিং, ছবি: সংগৃহীত

রোজা, উপবাস ও ডিজিটাল ফাস্টিং, ছবি: সংগৃহীত

অনেককেই দেখা যায়, রোজা রাখা সত্ত্বেও নামাজ পড়েন না, কোরআন মাজিদ তেলাওয়াত করেন না; বরং ঘণ্টার পর ঘন্টা মোবাইল ফোন, টেলিভিশন ও গল্প-গুজবের মাধ্যমে সময় পার করে দেন। তারা হয়তো রোজা রাখা বলতে উপবাস থাকাকেই মনে করেন। অথচ, রোজা শুধু উপবাস নয়।

উপবাস হলো- একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত কিছু নির্দিষ্ট বা সব ধরনের খাদ্য বা পানীয় অথবা সব ধরনের পানাহার থেকে বিরত থাকা।

বিজ্ঞাপন

অন্যদিকে রোজা হলো- সুবহে সাদিকের পর থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত সব ধরনের পানাহার ও যৌনাচারসহ সব ধরনের অনৈতিক ও পাপাচার থেকে বিরত থাকা। এর মূল উদ্দেশ্য আত্মশুদ্ধির মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন এবং ক্ষমা লাভ; যা শুধু উপবাসের মাধ্যমে অর্জিত হয় না।

কোরআন মাজিদে রোজার উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘হে ঈমানদারগণ! তোমাদের ওপর রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেমন ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর, যাতে তোমরা তাকওয়ার গুণ অর্জন করতে পারো।’

বিজ্ঞাপন

তাকওয়ার গুণ বলতে বুঝায় পাপ থেকে বেঁচে থাকা। কুপ্রবৃত্তি বা নফসের খাহেশাত থেকে আত্মরক্ষা করে বিবেকবোধের ওপর, সততা ও ঈমানদারির অটল-অবিচল থাকার সক্ষমতা।

সুতরাং রোজা রাখা মানে শুধু না খেয়ে থাকা নয়; বরং রোজা রাখা মানে হলো মনকে নিয়ন্ত্রণ করা। মন ভালো ভালো খাবার খেয়ে রসনা তৃপ্ত করতে চায়, ভোগ-বিলাস করতে চায়, রোজা রেখে অলস সময় কাটাতে চায়, আরামে শুয়ে শুয়ে অলস সময় কাটাতে চায়, সিনেমা, খেলা, গান-বাজনা, ফেসবুক ইত্যাদির মধ্যে ডুবে থেকে সময় পার করতে চায়। আবার কর্মক্ষত্রে দায়িত্বে অবহেলা, মানুষকে হয়রানি কিংবা মিথ্যা, প্রতারণা, শঠতা, সুদ, ঘুষ, চুরি, ডাকাতি, খেয়ানত, চাঁদাবাজি, অনৈতিক সুবিধা আদায় বা প্রদানের মাধ্যমে অবৈধভাবে অর্থবিত্তের মালিক হতে চায়। অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল ও প্রভাব-প্রতিপত্তি অর্জন করে লোক দেখানো দান-সদকাও করতে চায়।

রোজাদারকে এসব অবস্থায় নিজের মনের লাগাম টেনে ধরতে হয়। কুপ্রবৃত্তির ওপর সুপ্রবৃত্তি বা বিবেকবোধ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে হয়। যদিও এটা সহজ কাজ নয়। এ জন্য রীতিমতো সাধনা করতে হয়। এ কারণেই রোজাকে বলা হয় সিয়াম সাধনা তথা আত্মশুদ্ধির সংগ্রাম।

ইসলামের পরিভাষায় এই সংগ্রামকেই বলা হয় জিহাদে আকবর বা বড় জিহাদ। আর এর পুরষ্কারও তেমনি বড়। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত এক হাদিসে রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, আদম সন্তানের প্রতিটি নেক কাজের ফলাফল দশগুণ হতে সাতশত গুণ পর্যন্ত বর্ধিত করে দেওয়া হবে। কিন্তু রোজার ব্যাপারে এর ব্যতিক্রম হবে। কেননা আল্লাহ স্বয়ং বলেন, ‘বান্দা আমার সন্তুষ্টি বিধানের জন্যে রোজা রেখেছে এবং আমি নিজেই এর প্রতিদান দেব। সে তো আমার কথা মতই খানা-পিনা ও কামনা-বাসনা ত্যাগ করেছে।’

কিন্তু যারা নফসকে নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হবে তারা রোজার ফজিলত থেকে বঞ্চিত হবে। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত এক হাদিসে নবী কারিম (সা.) বলেছেন, ‘এমন বহু রোজাদার আছে, যাদের রোজা উপবাস ছাড়া আর কিছু নয়। আবার এমন অনেক নামাজি আছে যাদের নামাজ নিছক রাত্রী জাগরণ ছাড়া আর কিছু নয়।’

রমজানের প্রথম দশ দিন রহমত, দ্বিতীয় দশ দিন বরকত আর তৃতীয় দশ দিনে রয়েছে মাগফিরাত ও জাহান্নাম থেকে মুক্তি লাভের সুযোগ। এই সময়গুলোতে আল্লাহর রহমত, বরকত ও মাগফিরাত লাভের আশায় রোজা রেখে একদিকে যেমন গুনাহ থেকে বেঁচে থাকতে হয়, তেমনি এই পবিত্র মাসে বেশি বেশি করে নেক আমল করতে হয়।

এক কথায়, রমজান মাসের প্রতিটি মুহূর্ত মূল্যবান। তাই এই মাসে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ জামাতে পড়ার ব্যাপারে যত্নবান হওয়া উচিত। ফরজ নামাজের পাশাপাশি বেশি বেশি কোরআন তেলাওয়াত ও অধ্যয়ন, নফল নামাজ পড়া (ফরজ নামাজের আগে ও পরে অতিরিক্ত নামাজ, তারাবি ও তাহাজ্জুদ), বেশি দান-সদকা (বাধ্যতামূলক দান জাকাত ও ফেতরা ছাড়াও অতিরিক্ত দান-সদকা ও উপহার প্রদান) করা, বেশি বেশি তাসবিহ-তাহলিল ও জিকির-আজকার করা, হাদিস পাঠ ও ইসলামি বইপত্র পড়া। এ ছাড়া যথাসময়ে ও যত্নের সঙ্গে নামাজ আদায় করার চেষ্টা করা। একটু আগে আগেই মসজিদে চলে যাওয়া, যাতে সুন্নত ও নফল নামাজ পড়া যায়। মসজিদে যেয়ে প্রথমে দুই রাকাত নামাজ পড়ে নেওয়া উচিত। আল্লাহর রাসূল (সা.) এ আমলটি নিয়মিত করতেন এবং সাহাবিদেরকেও করার জন্য উৎসাহিত করতেন।

রোজা রেখে কোরআন তেলাওয়াত করা, ছবি: সংগৃহীত

রমজান মাসের ব্যাপারে যারা উদাসীন তাদের উদ্দেশে নবী কারিম (সা.) বলেছেন, ‘ধ্বংস হোক ওই ব্যক্তি, যে রমজান মাস পেলো, অথচ নিজের গুনাহ মাফ করাতে পারলো না।’ -জামে তিরমিজি: ৩৫৪৫

সুতরাং, শুধু উপবাস নয়, খোদাভীতি ও আত্মার উন্নয়ন সাধনার মধ্যেই নিহিত রয়েছে রোজার আসল ফজিলত। কিন্ত রোজাদারকে এ লক্ষ্য ও ফজিলত থেকে বিচ্যুত করে ডিজিটাল আসক্তি। বিশেষ করে এর সহজ শিকার হচ্ছে তরুণরা।

ডিজিটাল আসক্তি তরুণদের ইচ্ছাশক্তি ও কর্মোদ্দীপনাকে নষ্ট করার পাশাপাশি তাদের মধ্যে অলসতা, অপরিপক্বতা এবং বিষণ্ণতা বৃদ্ধি করছে। এর ফলে শুধু সিয়াম সাধনা নয়; পড়াশোনা, চিন্তাভাবনা, সৃজনশীলতা ও উদ্ভাবনাসহ সব ইতিবাচক ও গঠনমূলক কাজের প্রতি অনাগ্রহ ও অনীহা তৈরি করছে। অথচ অধ্যবসায় ও আত্মগঠনের সবচেয়ে সুন্দর ও উপযুক্ত সময় হলো- যৌবন কাল। এ সময়টা হলো মানব জীবনের সবচেয়ে উত্তম সময়। এ সময়টাতে মানুষের যে কর্মস্পৃহা, উদ্দীপনা, কর্মক্ষমতা ও শক্তি-সামর্থ থাকে তা অন্যসময়ে থাকে না। তরুণ বয়সে যত বেশি ও যত স্বাচ্ছন্দে ইবাদত-বন্দেগি করা যায় তা অন্য সময়ে করা যায় না।

অথচ এই মূল্যবান সময়টার প্রতিই সবচেয়ে অবহেলা ও অপচয় করা হয়। এ অপচয় আসলে একটা মারাত্মক খেয়ানত। কারণ, তারুণ্য ও যৌবনের এ মূল্যবান সম্পদ মানুষের প্রতি আল্লাহর দেওয়া এক বিরাট নেয়ামত। আর প্রতিটি নেয়ামত একেকটি আমানত। আল্লাহতায়ালা কেয়ামতের কঠিন সময়ে প্রতিটি নেয়ামতের হিসাব নেবেন।

তারুণ্যের আমানতকে ক্ষয়িষ্ণুতার হাত থেকে রক্ষা করতে হলে ডিজিটাল আসক্তি ও অপব্যবহার থেকে মুক্ত হতে হবে। বিশেষ করে স্মার্টফোন ও সোশ্যাল মিডিয়ার আসক্তি এখন মাদকাসক্তির মতই একটি ভয়াবহ অভিশাপ হিসেবে দেখা দিয়েছে। এ অভিশাপ থেকে মুক্তি পেতে অনেকেই ডিজিটাল ফাস্টিং করার চেষ্টা করেন। অর্থাৎ একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত এসব থেকে বিরত থাকা। এর ফলে ‘আসক্তি’ কাটিয়ে ওঠা সহজ হয়। আর এই ফাস্টিং’র ক্ষেত্রে বিশেষভাবে সহায়ক হতে পারে পবিত রমজান মাস।

ডিজিটাল উপবাস বেছে নেয়, যেখানে তারা একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য সমস্ত প্রযুক্তি থেকে বিরত থাকে। অন্যরা তাদের প্রযুক্তি ব্যবহার সীমিত করতে বেছে নিতে পারে, যেমন শুধুমাত্র জরুরি অবস্থার জন্য স্মার্টফোন ব্যবহার করা অথবা প্রতিদিন একটি নির্দিষ্ট সময়ের পরে ইমেল চেক না করা।