‘বিপদে আছি, টিকিট করেছি, হোটেলও বুকিং করা। যাত্রীরা প্রস্তুত কিন্তু এখনও ভিসা পাচ্ছি না।’ এভাবেই উমরার ভিসা না পেয়ে হাতাশার কথা বলছিলেন এক উমরা এজেন্সির মালিক।
শুধু একজন নয়, পবিত্র রমজান মাসে উমরা ভিসার চরম সঙ্কট নিয়ে এজেন্সিগুলোতে হাহাকার চলছে। উমরা ভিসা সংকট দেখা দেওয়ায় গত দু’দিনে প্রায় ২ হাজার যাত্রীর সিট বাতিল হয়েছে। যাত্রীর অভাবে খালি যাচ্ছে ফ্লাইট। এমনকি ফ্লাইট বাতিলের ঘটনাও ঘটছে। এদিকে, উমরা ভিসা না পাওয়ায় এক লাখ টাকার উমরা টিকিট এখন ৬০ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
একাধিক হজ এজেন্সি সূত্রে জানা গেছে, উমরা ভিসা হঠাৎ হ্রাস পাওয়ায় কাজী এয়ার ইন্টারন্যাশনাল, আল মদিনা ট্রাভেলস, হাসেম এয়ার ইন্টারন্যাশনাল ও সাদিয়া এয়ারের ব্লককৃত শত শত উমরা টিকিট বাতিল করতে হচ্ছে। ভিসার অভাবে অগ্রিম ক্রয়কৃত উমরা টিকিটের মূল্য এয়ারলাইন্সগুলো ফেরত দেবে কিনা তা নিয়ে কোনো সিদ্ধান্ত জানায়নি। এতে অনেকেই চরম হতাশায় দিন কাটাচ্ছেন।
ধর্ম মন্ত্রণালয়ের সচিব এ কে এম আফতাব হোসেন প্রামানিক জানিয়েছেন, ‘বাংলাদেশি উমরাযাত্রীদের ভিসা কমিয়ে দেওয়ার বিষয়টি বিস্তারিত জানার জন্য মক্কাস্থ বাংলাদেশ হজ মিশনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হচ্ছে।’
‘উমরা ভিসা কমিয়ে দেওয়ার বিষয়টি সৌদি কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্ত। মক্কায় ভিড় কমানো বা স্থান সঙ্কুলানের জন্য ভিসা ইস্যুর বিষয়টি হ্রাস করা হতে পারে।’ বিস্তারিত জানার পর সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ নেওয়া হবে বলেও তিনি আশ্বাস দেন।
গত ৪ মার্চ থেকে সৌদি আরবের নুসুক সিষ্টেমে কাঙ্খিত উমরাযাত্রীর ভিসা মিলছে না। নুসুক সিষ্টেমে ৯০ শতাংশ উমরা ভিসা কমিয়ে দিয়েছে। নুসুক সিষ্টেমে উমরাযাত্রীর মোফা (ভিসা) ইস্যু করতে সার্ভারে ঢুকলেই দেখাচ্ছে বাংলাদেশি দৈনিক উমরাযাত্রীর কোটা শেষ। ফলে ভিসা মিলছে না।
রমজান মাসে মক্কা-মদিনায় ইতেকাফ এবং ইবাদত-বন্দেগির জন্য যারা সৌদি আরব যাওয়ার নিয়ত করেছিলেন তারা চরম উৎকন্ঠায় দিন কাটাচ্ছেন। হঠাৎ বাংলাদেশি উমরাযাত্রীদের ভিসায় সঙ্কট সৃষ্টি হওয়ায় দেশি-বিদেশি এয়ারলাইন্সগুলোর ফ্লাইটে প্রায় ৭০ শতাংশ সিট খালি যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এজেন্সিগুলো অগ্রিম উমরার গ্রুপ টিকিট ক্রয় করে ভিসা সঙ্কটে পড়ে চরম আর্থিক সম্মুখীন হচ্ছে। হাবের একাধিক সূত্র এসব তথ্য জানিয়েছে।
সৌদি সংবাদ মাধ্যম এসপিএ জানিয়েছে, ২০২২ সাল থেকে উমরাযাত্রীর সংখ্যা ৫৮ শতাংশ বেড়েছে। পবিত্র স্থানগুলোর অবকাঠামো উন্নয়নে ১.৩ বিলিয়ন ডলারের ধারাবাহিক বিনিয়োগের ফল হিসেবে দেখছে দেশটির সরকার। ২০২৩ সালে ১ কোটি ৩৫ লাখ উমরাযাত্রীর রেকর্ডের পর, ২০২৫ সালের ৬ মার্চ একদিনে ৫ লাখ উমরাযাত্রীর নতুন রেকর্ড করেছে।
রমজান মাসে উমরা পালন হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সঙ্গে হজ আদায়ের সমতুল্য। এ কারণে বিশ্বের প্রায় দেশ থেকে মানুষ উমরাপালনে সৌদি আরব ভিড় করেন। ২০২৪ সালের ১ জুলাই থেকে এ পর্যন্ত প্রায় দুই লাখ বাংলাদেশি উমরা পালনের জন্য সৌদি গিয়েছেন।
উমরা ভিসা কমিয়ে দেওয়ায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন হাবের মহাসচিব ফরিদ আহমেদ মজুমদার। তিনি বলেন, সৌদি কর্তৃপক্ষ বিনা নোটিশে হঠাৎ উমরাযাত্রীদের ভিসা ইস্যু হ্রাস করায় যাত্রীদের মাঝে চরম উৎকন্ঠা দেখা দিয়েছে। এতে উমরাযাত্রীদের বিমানের ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ সিট খালি য়াওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
রমজানের আগের মতো উমরা ভিসা ইস্যু অব্যাহত রাখতে রাজকীয় সৌদি সরকারের আশু হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন তিনি।
হাব মহাসচিব উমরা ভিসায় সৃষ্ট সঙ্কটের দরুণ ট্রাভেলস এজেন্সিগুলোকে বিনা খরচে ইস্যুকৃত উমরা টিকিটের রিফান্ড, রি-ইস্যু এবং তারিখ পরিবর্তনের সুযোগ দেওয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট এয়ালাইন্সগুলোর প্রতি আহবান জানিয়েছেন।
অন্যথায় উমরা এজেন্সির মালিক ও ট্রাভেলস এজেন্সি এবং হাজার হাজার উমরাযাত্রী মারাত্মকভাবে আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হবেন বলে মনে করছেন তিনি।
উমরা ভিসা নিয়ে জটিলতা সৃষ্টিতে কোটা পদ্ধতির কথা শোনা যাচ্ছে। ভিসার জন্য পাসপোর্ট সাবমিট করলে তা এরর দেখায় ও লেখা আসে বাংলাদেশের জন্য দিনের কোটা অতিক্রম করছে। এই কোটা নিয়েও চলছে ধোঁয়াশা, কেউ স্পষ্ট করে কিছু বলতে পারছে না।
সৌদি আরবে বসবাসরত বিনা ইন্ট্যারন্যাশনাল কোম্পানির উমরা বিভাগে কর্মরত মো. রাশেদ খান বার্তা২৪.কমকে জানিয়েছেন, ‘সাম্প্রতিক বছরসমূহে সৌদি সরকার লাইসেন্সপ্রথা বাদ দিয়ে ফ্রিকোয়েন্ট ভিসা সার্ভিস চালু করায় উমরা ভিসার প্রক্রিয়া সহজ হয় এবং আনলিমিটেড ভিসা ইস্যু শুরু হয়। তবে প্রতি বছর রমজানের শুরু থেকেই উমরাযাত্রীর চাপ কমাতে ভিসা ইস্যুর ওপর কোটা দিয়ে দেওয়া হয়। যা পরবর্তী নতুন সিজন পর্যন্ত বলবৎ থাকে। এ কারণে ভিসা কম হচ্ছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘অনেক বাংলাদেশি উমরা ভিসায় পরিবারের সদস্যদের সৌদি আরব আনেন। এ কারণেও সমস্যা দেখা দেয়। তার মতে, সৌদি অথরিটি ভিসা এবং সার্ভিস প্রোভাইডার কোম্পানিকে একটা নির্দিষ্ট কোটা প্রদান করেন, যেখানে যত পরিমাণ ভিসা হয় এবং ১ মাসের মধ্যে যদি তত পরিমাণ যাত্রী সৌদি থেকে এক্সিট না করে তাহলে ওই কোম্পানির ভিসা প্রদান বন্ধ করে দেওয়া হয়। যতক্ষণ না তার আগের করা ভিসার যাত্রীরা সৌদিতে এসে ফিরে না যান। এই সমস্যার জন্য গতবছর অনেক এজেন্সিকে টিকিট লস দিতে হয়েছে। যদি এই বছর এটা কন্ট্রোল না করা যায়, সামনে বিপদ আছে। ইতোমধ্যে অনেক কোম্পানির পাকিস্তান কোটা বন্ধ হয়ে গেছে।’
মো. রাশেদ খান জানান, ‘সৌদি আরব এবার হজের প্রস্তুতি অনেক আগে থেকে শুরু করেছে। অন্যবার যেখানে জিলকদের ১৫ তারিখ পর্যন্ত উমরাযাত্রীর থাকার সুযোগ থাকত, সেখানে এবার শাওয়ালের ২০ তারিখের মধ্যে উমরাযাত্রীদের সৌদি ত্যাগের কথা বলা হয়েছে। উমরার ভিসায় এসে হজপালনের চেষ্টার প্রবণতা কমাতে এবার আগেভাগেই উমরা এবং সব ধরনের জিয়ারা ভিসা বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে।’
থেমে নেই প্রতারণা
উমরা ভিসা নিয়ে হাহাকারের মাঝেও থেমে নেই প্রতারণা। এক শ্রেণির প্রতারক শতভাগ গ্যারান্টি সহকারে ভিসার নিশ্চয়তা দিয়ে হাতিয়ে নিচ্ছে টাকা। হাবের সহ-সভাপতি হাফেজ মাওলানা নূর মোহাম্মদ প্রতারণার বিষয়ে এজেন্সির মালিকদের সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছেন।
হাব সহ-সভাপতি বার্তা২৪.কমকে বলেছেন, ‘কেউ যদি আপনাকে ২৪ ঘন্টায় ভিসা করে দেবো বলে, তাকে বিশ্বাস করবেন না। বাস্তবতা হলো, ভিসা হচ্ছে না, মানে হচ্ছে না।’
উমরা ভিসার তীব্র সঙ্কট দেখা দেওয়ায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে পবিত্র রমজান মাসে ইত্তেকাফকারীদের জন্য অবিলম্বে পূর্বের ন্যায় উমরা ভিসা ইস্যু বহাল রাখার জন্য সৌদি সরকারের প্রতি আহবান জানিয়েছেন তিনি।
প্রতারণা থেকে সতর্ক করে আরিশ ট্রাভেলস এন্ড ট্যুরসের পরিচালক আমিন ইকবাল বার্তা২৪.কমকে বলেন, ‘প্রতারকরা কাজ নেবে লটারির মতো, হলে হলো- না হলে সরি বলে কয়েকদিন ঘুরিয়ে টাকা ফেরত দেকে, অন্যথায় টাকা মেরে দেবে।’ তিনি বলেন, ‘এই সেক্টরে শুধু ফেসবুকের চমকপ্রদ বিজ্ঞাপনের কারণে শত শত মানুষ প্রতারিত হয়।’