আবুধাবী শেখ জায়েদ গ্র্যান্ড মসজিদে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম ইফতার আয়োজন
-
-
|

ছবি: সংগৃহীত
সংযুক্ত আরব আমিরাতের রাজধানী আবুধাবির শেখ জায়েদ গ্র্যান্ড মসজিদ পবিত্র রমজান মাসে শুধু ইবাদতের স্থানই নয়, পরিণত হয় এক বিশাল ধর্মীয় ও সামাজিক মিলনমেলায়। এখানকার ইফতার আয়োজন বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ আয়োজনের একটি, যেখানে প্রতিদিন ৩৫ হাজারের বেশি রোজাদার বিনামূল্যে ইফতার গ্রহণ করেন। এটি মদিনার পর বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম ইফতার আয়োজন হিসেবে বিবেচিত হয়।
প্রতিদিনই ইফতারের দুই ঘণ্টা আগে থেকে মসজিদ প্রাঙ্গণে রোজাদারদের ভিড় জমতে শুরু করে। সারিবদ্ধ গাড়ির দীর্ঘ লাইন, প্রশস্ত পার্কিং সুবিধা এবং স্বেচ্ছাসেবকদের তৎপরতায় মসজিদের চতুর্দিক যেন এক ব্যস্ততার কেন্দ্র হয়ে ওঠে। নারী ও পুরুষদের জন্য পৃথক জোনসহ এখানে পরিবার-পরিজন নিয়ে একসঙ্গে বসে ইফতার করার সুযোগ রয়েছে। আমন্ত্রিত অতিথি, বিদেশি কূটনীতিক ও সম্মানিত ব্যক্তিদের জন্যও রয়েছে বিশেষ ব্যবস্থা।
শেখ জায়েদ গ্র্যান্ড মসজিদ সেন্টারের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত ‘আওয়ার ফাস্টিং ইনিশিয়েটিভ’-এর আওতায় রমজান মাসজুড়ে ২১ লাখের বেশি ইফতার প্যাকেট বিতরণ করা হয়। এর মধ্যে মসজিদ প্রাঙ্গণে সাড়ে ছয় লাখ এবং আবুধাবির বিভিন্ন স্থানে সাড়ে ১০ লাখ প্যাকেট সরবরাহ করা হয়। পাশাপাশি, রমজানের শেষ ১০ দিনে ৩০ হাজার জনকে সাহরি বিতরণ করা হয়।
বিশাল এই ইফতার আয়োজন সফল করতে প্রতিদিন প্রায় ১২ টন মুরগির মাংস, ছয় টন ভেড়ার মাংস এবং চাল, সবজি, টমেটো ও পেঁয়াজসহ ৩৫ টন অন্যান্য খাদ্যপণ্য ব্যবহার করা হয়। খাবারের মান ও স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করতে এক হাজারের বেশি কর্মী, যার মধ্যে ৩৫০ জন শেফ, ১৬০ জন স্টুয়ার্ড ও ৪৫০ জন সেবাদানকারী দায়িত্ব পালন করেন। খাবার বিতরণে সহায়তা করেন দেশটির রেড ক্রিসেন্টের ১৫০০ স্বেচ্ছাসেবক।
বিশাল এই ইফতার আয়োজনে অংশ নেওয়া মিসরীয় নাগরিক মোহাম্মদ আবদুল হামিদ বলেন, ‘এখানে এসে মনে হয় যেন নিজ দেশে রয়েছি, পরিবারের সঙ্গে ইফতার করছি। বিভিন্ন জাতি ও গোষ্ঠীর মানুষদের সঙ্গে ইফতার উপভোগ করা সত্যিই অসাধারণ অভিজ্ঞতা।’
বাংলাদেশি প্রবাসী মোশাহিদুর রহমান বলেন, ‘আমি ভাগ্যবান যে এত বড় একটি মাহফিলে ইফতার করার সুযোগ পেয়েছি। এখানে ধনী-গরিব সবাই একসঙ্গে বসে ইফতার করছেন, যা সত্যিই অবিস্মরণীয়।’
নির্মাণশ্রমিক হিসেবে কর্মরত বাংলাদেশের আব্দুর রহিম জানান, ‘আমার কর্মস্থল মসজিদের কাছেই। তাই রোজা এলে প্রায় প্রতিদিনই দেশের সবচেয়ে বড় এ ইফতার আয়োজনে অংশ নিই। খোলা আকাশের নিচে এত মানুষের সঙ্গে ইফতার করা সত্যিই অন্যরকম অনুভূতি।’
১৯৯৬ সালে শুরু হওয়া শেখ জায়েদ গ্র্যান্ড মসজিদের নির্মাণকাজ শেষ হয় ২০০৭ সালে। ৫৪৫ মিলিয়ন ডলার ব্যয়ে নির্মিত ৫৫৫,০০০ বর্গমিটার আয়তনের বিশাল এই মসজিদে একসঙ্গে ৫৫ হাজার মুসল্লির নামাজ পড়ার ব্যবস্থা রয়েছে। এতে রয়েছে ৮২টি সাদা মার্বেলের গম্বুজ, এক হাজার ৯৬টি বাইরের কলাম, ৯৬টি মূল্যবান পাথরখচিত অভ্যন্তরীণ কলাম এবং সাতটি ২৪ ক্যারেট স্বর্ণখচিত ঝাড়বাতি। মসজিদের মূল হলঘরে শোভা পায় বিশ্বের বৃহত্তম হস্তনির্মিত কার্পেট।
বিশ্বের অন্যতম দর্শনীয় স্থাপনার মধ্যে অন্যতম এই মসজিদে প্রতিবছর লাখো পর্যটক ভিড় করেন। ২০২৪ সালে মসজিদটি ৬৫ লাখ ৮২ হাজার ৯৯৩ জন মুসল্লি ও পর্যটকের পদচারণায় মুখরিত ছিল, যার ৮১ শতাংশই ছিল বিদেশি পর্যটক এবং ৫২ শতাংশ এশিয়ার বিভিন্ন দেশের নাগরিক।
শেখ জায়েদ গ্র্যান্ড মসজিদ শুধু নামাজ আদায়ের স্থান নয়, এটি সম্প্রীতি, সৌহার্দ্য ও মানবিকতার এক অনন্য নিদর্শন। ধনী-গরিব, স্থানীয়-প্রবাসী, রাজপরিবারের সদস্য থেকে সাধারণ শ্রমিক—সবার জন্য এখানে ইফতারে অংশ নেওয়ার সুযোগ রয়েছে। একসঙ্গে এত মানুষের ইফতার আয়োজন শুধু বৃহৎ আয়োজন হিসেবেই নয়, বরং এটি ভ্রাতৃত্ববোধ, মানবতা ও সৌহার্দ্যের এক উজ্জ্বল প্রতীক।