মই নদীর তীরে কী হবে বাংলাদেশিদের ভাগ্যে?
-
-
|

ছবি: বার্তা২৪.কম
ব্যাংকক, থাইল্যান্ড: উত্তর পশ্চিম থাইল্যান্ডের শান্ত শহর মেসট। তার পশ্চিমে মই নদী পার হলে মিয়ানমারের শহর মিয়াওয়াদ্দি। যেখানে গড়ে উঠেছে ভয়ংকর সব স্ক্যাম কল সেন্টার। সেখানে অপহরণ করে নিয়ে যাওয়া হয়েছে বিভিন্ন দেশের মানুষদের। যার মধ্যে রয়েছেন বাংলাদেশিরাও।
মিয়ানমারের এই স্ক্যামসেন্টারগুলো চলছে থাইল্যান্ডের বৈদ্যুতিক সহায়তায় এবং মোবাইল নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে। গত জানুয়ারিতে একজন চায়নিজ অভিনেতাকেও অপহরন করে নিয়ে যায় চক্রটি। এরপর থেকে চায়না সরকারের সঙ্গে নড়েচড়ে উঠে থাইল্যান্ড কর্তৃপক্ষও। সকল অবৈধ বৈদ্যুতিক সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয় এবং ইন্টারনেট বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হয়। সেখানকার স্ক্যাম সেন্টারগুলো বিনাশ করার উদ্যোগ নেয়া হয়।
এরপর সীমান্তের ওপার থেকে ডেমোক্রেটিক কারেন বুদ্ধিস্ট আর্মি অভিযান চালিয়ে প্রথম দফায় ২৬১ জন বন্দীকে মুক্ত করে থাইল্যান্ডে পাঠায়। সব মিলিয়ে মিয়াওয়াদ্দী এবং আশপাশের এলাকাগুলো থেকে প্রায় ১০ হাজার বিদেশিকে মুক্ত করা হবে বলে ধারনা করছে মিয়ানমারের জান্তা আর্মি।
উদ্ধার হওয়াদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, স্ক্যাম সেন্টাগুলোর মূল মালিকানায় চায়নিজ ব্যবসায়ীরা। তাদের রয়েছে মিয়ানমারের স্থানীয় সশস্ত্র বাহিনী।
বন্ধুদের অপেক্ষায় জুনায়েদ
২০২৪ সালের নভেম্বরে মিয়াওয়াদ্দী থেকে মই নদী পার হয়ে পালিয়ে আসেন বাংলাদেশি তরুন জুনায়েদ। সেখানে কিভাবে ইলেক্ট্রিক শক দিয়ে, বেঁধে পিটিয়ে নির্যাতন করা হতো তার বর্ণনা তিনি দিয়েছেন বার্তাকে। মুক্ত হওয়ার সময় সেখানে একই কমপ্লেক্সে আরো ১২ জন বাংলাদেশিকে দেখতে পান তিনি। পরবর্তীতে দেশে ফিরে আবারো থাইল্যান্ডে আসেন সঙ্গে থাকা বন্ধুদের মুক্ত করতে।
শুক্রবার, ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, তিনি বার্তাকে বলেন, এখন পর্যন্ত ২ জন বাংলাদেশিকে স্ক্যাম সেন্টার থেকে উদ্ধার করা হয়েছে বলে আমরা জানতে পেরেছি।
দুবাই থেকে তিন মাসের জন্য থাইল্যান্ডে বেড়ানোর কথা ভেবেছিলেন জুনায়েদ এবং তার ৩ বন্ধু। সেখানেই এক বাংলাদেশি যুবক তাদেরকে জানান, থাইল্যান্ডে ৩ মাসের একটি চাকুরির সুযোগ রয়েছে। ফলে বেড়ানোর পাশাপাশি আয়ও করা যাবে।
তবে সেপ্টেম্বরে থাইল্যান্ডে তাদের সরাসরি স্ক্যাম সেন্টার চক্রের হাতে তুলে দেয়া হয়।
জুনায়েদ বলেন, যেদিন আমরা ব্যাংকক নামি সেদিন রাতেই আমাদের সীমান্ত পার করে মিয়ানমারে নিয়ে যাওয়া হয়। আমাদের পাসপোর্ট-মোবাইল নিয়ে রাখে তারা। কোন প্রশ্ন বা প্রতিবাদ করলেই নেমে আসতো অমানষিক নির্যাতন। শরীর অসুস্থ থাকলে বা কাজ কম করতে পারলেও তারা টর্চার সেলে নিয়ে যেয়ে মারতো।
নভেম্বরে ক্যাম্প থেকে বের হয়ে হাসপাতাল যাওয়ার সুযোগ হয় জুনায়েদের। সেদিনই নদীতে সাতড়ে থাইল্যান্ডে পালিয়ে বাঁচতে পারেন তিনি। পরে বন্দী বাংলাদেশিদের পরিবারের অনুরোধে আবারো থাইল্যান্ডে আসেন তাদের উদ্ধার করার উপায় বের করতে।
স্ক্যাম সেন্টারে কি ধরনের কাজ করানো হয়
জুনায়েদ বার্তা২৪কে জানান, মূলত এগুলো স্ক্যাম কল সেন্টার। সেখানে এআই ব্যাবহার করে নারী সেজে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের প্রলুব্ধ করা হয়। এরপর ব্যাংকিং চ্যানেল জানা হলে বা বিনিয়োগের কথা বলে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর থেকে অর্থ হাতিয়ে নেয়া হয়।
তিনি বলেন, আমরা অপহৃত হওয়ার পর সেখানে যখন নিয়ে যাওয়া হয়, আমাদেরকে বন্দুকের মুখে চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর করানো হয়। যেখানে বলা হয় আমরা দেড় বছরের আগে এখান থেকে যেতে পারবো না। এবং প্রতি মাসে প্রায় ১৫ হাজার ডলার করে আয় করে দিতে হবে। আয় করতে না পারলে চলতো অমানুষিক নির্যাতন এবং ইলেক্ট্রিক শক।
জুনায়েদ বলেন, একদিন আমি একবারে একজন আমেরিকান ক্লায়েন্টের কাছ থেকে একবারে ১৫ হাজার ডলার পর্যন্ত নিয়ে আসতে পেরেছিলাম। আমাদেরকে প্রথমে ২১ দিনের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছিল এই কাজের জন্য।
এছাড়াও কেউ যদি কাজে দক্ষ না হতো বা নির্যাতনের ফলে প্রায় অক্ষম হয়ে পড়ে তাহলে তাদের শরীরেরর অঙ্গ প্রতঙ্গও খুলে নিয়ে বিক্রি হতো বলে স্থানীয় গণমাধ্যমকে তথ্য দিয়েছেন একজন ইথিওপিয়ান বন্দী।
কতজন বাংলাদেশি রয়েছে
ঠিক কি পরিমান বাংলাদেশি সেখানে আটক রয়েছে তার সঠিক তথ্য পাওয়া কঠিন। আবার অনেকেই এই স্ক্যাম সেন্টারে কাজ করতে করতে সেই অপরাধের জগতেই নিজেকে হারিয়ে ফেলেন। তাদের আর ফেরত আসা হয় না। আবার যারা স্ক্যাম সেন্টারের জন্য বেশি আয় করতে পারেন, তাদেরকে সহজে ছাড়ে না মালিকরা।
জুনায়েদ জানিয়েছেন, তিনি যেই ভবনে বন্দী ছিলেন সেখানে তিনি ছাড়াও ১২ জন বাংলাদেশি ছিল। এর মধ্যে একজন মুক্তি পেয়েছেন। আরো ৮ জন বাকি রয়েছে।
মুক্ত হওয়াদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি রয়েছেন চায়নিজ নাগরিক। এরপর ইথিওপিয়াসহ আফ্রিকার বিভিন্ন দেশের। এরপর ভারতীয় এবং দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশের নাগরিকরা।
ব্যাংককের বাংলাদেশ দূতাবাস সূত্র জানিয়েছেন, এখন পর্যন্ত দুই জন বাংলাদেশিকে উদ্ধার করা হয়েছে। প্রথমেই যে ২৬৪ জনকে উদ্ধার করা হয় সেখানে ২ জন বাংলাদেশি ছিলেন। তাদেরকে সেদিনই বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো হয়েছে।
দূতাবাসের ওই কর্মকর্তা জানান, এখন পর্যন্ত ২৪ জনের তথ্য পেয়েছি আমরা। আমরা প্রথমে নয় জনের তথ্য পেয়েছিলাম। উদ্ধার হওয়াদের মধ্যে ১ জন আমাদের সেই তালিকায় ছিল। আরেকজন তালিকার বাইরে। সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে এই বিষয়টি দেখা হচ্ছে। সব স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে কথা বলা হচ্ছে বলে উল্লেখ করেন তিনি।