'অন্ধজনে দেহো আলো' মিশন নিয়ে প্রত্যন্ত জনপদে
-
-
|

'অন্ধজনে দেহো আলো' মিশন নিয়ে প্রত্যন্ত জনপদে। বার্তা২৪.কম
'অন্ধজনে দেহো আলো, মৃতজনে দেহো প্রাণ/তুমি করুণামৃতসিন্ধু করো করুণাকণা দান', একটি জনপ্রিয় রবীন্দ্রসঙ্গীত, যা বিশ্বকবির রচিত একটি পূজা ও প্রার্থনা পর্যায়ের গান। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জীবিতকালে তাঁর স্বরচিত যে গানগুলো গ্রামোফোনে রেকর্ড করেছিলেন সেগুলোর মধ্যে এটি অন্যতম। সাধারণত মানবকল্যাণে এবং বিশেষত অন্ধত্বের চিকিৎসার ক্ষেত্রে স্লোগান হিসাবে এই গানের প্রথম লাইনের বহুল ব্যবহার লক্ষণীয়।
স্লোগান থেকে বাস্তবে কথাগুলোকে প্রতিষ্ঠিত হতে দেখা যায় কমই। মাঝে মাঝে চক্ষু শিবির কিংবা ছানি অপারেশনের কোনও আয়োজনে ঘটা করে স্লোগানটি উচ্চারিত হতে শোনা যায়। কিন্তু কেউ কেউ আছেন, যাদের কাছে 'অন্ধজনে দেহো আলো' একটি মিশন স্বরূপ। ডা. মাহবুবুর রহমান শাহীন তেমনি একজন নিবেদিতপ্রাণ চক্ষু বিশেষজ্ঞ, যিনি জীবনব্যাপী প্রত্যন্ত জনপদের জনসাধারণের চোখের চিকিৎসা করে আলোচিত হয়েছেন। এমনকি, অসুস্থ হয়ে কিডনি সংস্থাপন করার পরেও থেমে নেই এই অদম্য চিকিৎসক। কন্যা আয়েশাকে নিয়ে মানুষের চোখের জ্যোতি ফিরিয়ে দিতে অক্লান্ত পরিশ্রম করছেন গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে।
কিশোরগঞ্জের কটিয়াদি-পাকুন্দিয়া এলাকার কৃতি সন্তান ডা. মাহবুবুর রহমান শাহীন। পড়াশোনা করেছেন কিশোরগঞ্জ ও বরিশাল শেরে বাংলা মেডিকেল কলেজে। তারপর চক্ষু চিকিৎসা বিষয়ে দেশ-বিদেশ নিয়েছেন উচ্চতর প্রশিক্ষণ। পেশাজীবন শুরু করেন ঢাকার নামকরা চক্ষু হাসপাতালে। কয়েকটি মেডিকেল কলেজে অধ্যাপক হিসাবেও যুক্ত আছেন তিনি।
সবচেয়ে মানবিক ও সামাজিক যে বিষয়টি ডা. মাহবুবুর রহমান শাহীনকে অন্যান্য চিকিৎসকের চেয়ে আলাদা ও বিশিষ্ট করেছে, তা হলো তার মাটি ও মানুষের সঙ্গে সম্পৃক্ততা। পেশাজীবনের প্রথম দিন থেকেই তিনি শীত, বর্ষা নির্বিশেষে প্রতিটি শুক্র ও শনিবারের ছুটির দিনগুলো চলে এসেছেন কিশোরগঞ্জ শহরে। চিকিৎসা সেবা ও অপারেশন করেছেন পুরান থানাস্থ শাহি কলোনি ও গৌরাঙ্গ বাজারের চেম্বারে। 'আমার কষ্ট হয়েছে, তারপরেও এসেছি, যাতে গরিব মানুষকে চোখের অপারেশনের জন্য ঢাকা কিংবা ময়মনসিংহে গিয়ে আর্থিক ক্ষতি ও ভোগান্তির সম্মুখীন হতে না হয়', জানালেন তিনি।
দিনে দিনে রোগির চাপ বাড়ায় অনেক অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি তিনি কিশোরগঞ্জে নিয়ে আসেন এবং শহরের বাইরে প্রত্যন্ত গ্রাম-গঞ্জে ক্যাম্প করে একসঙ্গে বহু মানুষের চিকিৎসা দিতে থাকেন। নতুন চিকিৎসকদের ক্লাস নিতে থাকেন পরম মমতায়। পরিশ্রমের চাপে নিজের শরীরের খোঁজ নেওয়া হয় না তার। এক সময় দেখা যায় তার কিডনি বিকল হয়ে গেছে। জরুরি ভিত্তিতে কিডনি প্রতিস্থাপন করতে হয় তাকে। তারপরেও তিনি মোটেও দমে যান নি। তাজা তরুণের মতো ছুটে চলেন 'অন্ধজনে দেহো আলো' মিশন নিয়ে।
ফেব্রুয়ারি মাসেই তিনি কিশোরগঞ্জের অদূরে গচিহাটায় প্রতিষ্ঠিত সফর আলী মিয়া চক্ষু হাসপাতালে ৮৪ জন রোগির চিকিৎসা দিয়েছেন। ব্যবস্থাপনায় তার সঙ্গে ছিলেন কন্যা আয়েশা ও তার হাতে তৈরি একদল স্বাস্থ্যকর্মী। দিনশেষে তাপিত ও পীড়িত মানুষের মুখে খুশির হাসি দেখে তিনি মুছে ফেলেন নিজের সারাদিনের পরিশ্রমের কষ্ট।
সত্তর দশকে টগবগে তরুণ ডা. মাহবুবুর রহমান শাহীন সুঠাম দেহে বীরদর্পে সাইকেল চালিয়ে পড়তে আসতেন কিশোরগঞ্জ সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে। কখনো তার দীর্ঘদেহী মজবুত শরীরের পিতার সঙ্গে আমার আব্বা, কিশোরগঞ্জের কিংবদন্তি তুল্য চিকিৎসক, ভাষাসংগ্রামী ডা. এ এ মাজহারুল হকের কাছে এসে কিছুটা সময় কাটাতেন। প্রথম প্রজন্মের চিকিৎসকের কাছে এসে ডা. মাহবুবুর রহমান শাহীনের পিতা নিশ্চয় পুত্রের মধ্যে চিকিৎসক হওয়ার বীজ বুনে দিয়েছিলেন। ডা. মাহবুবুর রহমান শাহীন পিতাট স্বপ্ন সফল ও তার মুখ উজ্জ্বলই শুধু করেন নি, নিজের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকেও স্বাস্থ্যসেবায় নিবেদিত করেছেন। কমপক্ষে পঞ্চাশ বছরের স্মৃতি ও সম্পর্কের আবহে ডা. মাহবুবুর রহমান শাহীনের কথা ভাবলেই এক ক্লান্তিহীন মানবিক চিকিৎসকের মুখচ্ছবি ভেসে আসে, যিনি 'অন্ধজনে দেহো আলো' মিশন নিয়ে আলো হাতে অবিরাম ছুটে চলেছেন প্রত্যন্ত জনপদে, গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে, আলোহীন মানুষের মধ্যে আলোর ফেরিওয়ালা হয়ে।