‘আব্বাকে শেষ সময়ে কষ্ট ছাড়া কিছুই দিতে পারেনি ইউনাইটেড হাসপাতাল’
-
-
|

ছবি: সংগৃহীত
রাজধানীর বেসরকারি ইউনাইটেড হাসপাতালের সার্বিক চিকিৎসা ব্যবস্থা নিয়ে নিজের ভয়াবহ অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরেছেন মো: রাকিব উদ্দিন। সম্প্রতি হাসপাতালটিতে হার্টের চিকিৎসা করাতে গিয়ে তিনি তার বাবাকে হারান।
সোমবার (২৪ ফেব্রুয়ারি) বিকেলে নিজস্ব ফেসবুক আইডিতে এ নিয়ে বিস্তারিত লিখে পোস্ট করেন তিনি। বার্তা২৪.কমের পাঠকদের জন্য তার ফেসবুক পোস্টটি হুবহু তুলে ধরা হলো:
অপারেশন-জনিত জটিলতা নাকি হাসপাতালের অবহেলা থেকে আব্বার মৃত্যু?
এই লেখাটা সুনির্দিষ্ট কাউকে দোষারোপের জন্য নয় বরং বাংলাদেশের সামগ্রিক স্বাস্থ্যখাতের অবস্থা তুলে ধরতে, যাতে আর কেউ এভাবে আমার মতো স্বজন হারা না হন। আমার আব্বা অপারেশন-জনিত জটিলতার কারণে দেশের শীর্ষ স্বাস্থ্যকেন্দ্র ইউনাইটেড হাসপাতালে মারা গেছেন আজ ৪০ দিনেরও বেশি হয়ে গেছে। কিন্তু এখনো আমি মাকে আব্বার মৃত্যুর সঠিক কারণ জানাতে পারিনি। বলতে পারিনি- কী অবর্ণনীয় কষ্টে তিনি ছিলেন শেষ সময়ে! বাসা থেকে সবার কাছে বিদায় নিয়ে বের হয়েছিলেন হাসি-খুশি মনে, কিন্তু হাসপাতালের অসতর্কতা আর অবহেলায় আমরা তাকে অসময়ে হারিয়েছি। এখন প্রশ্ন হচ্ছে— ইউনাইটেড হাসপাতাল কী ধরনের অবহেলা করেছে, আর আব্বা কেন সেখানে চিকিৎসা নিতে গিয়েছিলেন?
আব্বার কয়েক বছর ধরে অ্যাজমার সমস্যা ছিল। তবে এছাড়া তিনি সুস্থই ছিলেন। সবসময় হেলদি লাইফস্টাইল মেনে চলার চেষ্টা করতেন। তবে ২০১২ সালের দিকে একটি ব্লকের জন্য তাঁর হার্টে একটি রিং বসানো হয়। আর কোনো জটিলতা ছিল না। তবে কোভিডের সময় থেকে আব্বার স্বাস্থ্য দুর্বল হতে থাকে। পরে পরীক্ষা করে দেখা যায়, তাঁর হার্টের একটি ভালভ প্রায় ৬০% ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে গেছে। এর ফলে আব্বার নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হতো। সমাধান হিসেবে ভালভ রিপ্লেস করার কথা বলা হয়। আব্বার বয়স ৮০-এর কাছাকাছি হওয়ায়- এই বয়সে ভালভ রিপ্লেস করার দুটো উপায় ছিল। একটি হলো ওপেন হার্ট সার্জারি করে পুরো বুক কেটে সার্জিক্যাল ভালভ বসানো। আরেকটি ব্যয়বহুল পদ্ধতি হচ্ছে- টাভি (TAVI - Transcatheter Aortic Valve Implantation)। টাভি এমন একটি প্রক্রিয়া, যেখানে পা দিয়ে ফুটো করে রিং পরানোর মতো করে ভালভ বসানো হয়। এটি ব্যথাহীন বলে দাবি করা হয়। টাভি বাংলাদেশে সাধারণত হয় না। এটি বিদেশে করা হয়, তবে দেশে শুধু ইউনাইটেড হাসপাতালে এই সুবিধা আছে কিন্তু ব্যয়বহুল। ইউনাইটেড হাসপাতাল আমাদের জানিয়েছিল- তখন পর্যন্ত ইউনাইটেডে সফল ভাবে ১২/১৩ জনের টাভি করা হয়।
আব্বার টাভির জন্য ইউনাইটেডে যাওয়ার সিদ্ধান্তের পেছনে কিছু কারণ ছিল। আমরা বিভিন্ন দেশে টাভি বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে পরামর্শ করতে গিয়ে জানতে পারলাম, টাভির জন্য থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়াতে বাংলাদেশের চেয়ে প্রায় তিনগুণ খরচ বেশি। আর ভারতের খরচ বাংলাদেশের কাছাকাছি। ভারতে আমরা যেতাম; কিন্তু আব্বার পাসপোর্টের মেয়াদ শেষ হয়ে গিয়েছিল এবং রিনিউ করতে সময় লাগতো। এর মধ্যে ভারতের ভিসাও বন্ধ হয়ে যায়। আব্বা যেহেতু ইউনাইটেডে আগে থেকেই নিয়মিত চিকিৎসা করাতেন, তিনি সেখানকার ডাক্তারের সঙ্গে এ নিয়ে কথা বললেন। ডাক্তার তাকে বুঝিয়ে ইনফ্লুয়েন্স করল - “ইউনাইটেডে টাভি করা হয়, তাহলে বিদেশে যাওয়ার দরকার কী?” আব্বাও আশ্বস্ত হয়ে ইউনাইটেডে ভরসা করলেন। প্রায় ৬ মাস ধরে এই বিষয়ে তাদের সঙ্গে টুকটাক আলোচনা চলছিল।
অবশেষে- গত বছরের সেপ্টেম্বরের শেষে, অর্থাৎ ২৮ তারিখে টাভির প্রস্তুতির জন্য আব্বার বিভিন্ন টেস্ট করা হয়। তখন এনজিওগ্রামে তাঁর আরও দুটি ব্লক ধরা পড়ে, এবং আরও দুটি রিং বসানো হয়। মোট তিনটি রিং বসানোর পর ইউনাইটেড থেকে এ বিষয়ে আর কোনো ফলোআপ হয়নি। তিনটি রিং পরানোর পর টাভি ঝুঁকিপূর্ণ কি না তাও আমাদের খোলাসা করা হয়নি। ডাক্তার বলেছিলেন, টাভি করা যেতে পারে। উল্লেখ্য, এই বয়সে ওপেন হার্ট সার্জারি ঝুঁকিপূর্ণ, যা আগেই আমাদের বলা হয়েছিল।
ইউনাইটেড ভালভ তৈরির খরচসহ মোট খরচ কত হবে তা আমাদেরকে জানায়। এবং জানায় যে ভালভের টাকা আমরা একটি থার্ড পার্টি ভেন্ডরের কাছে দিতে হবে। ডাক্তার আব্বাকে আশ্বস্ত করেন, “বিদেশে যাওয়ার দরকার নেই, আমরা এখানেই করতে পারব। এর ঝুঁকি মাত্র ১%।” আমরা-ভাইবোনরা দেশে থাকায় আব্বা দেশেই টাভি করার বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেন। ইউনাইটেড এর ডাক্তাররা জানিয়েছিলেন- আব্বা ভর্তি হওয়ার দুই দিন পর্যবেক্ষণে থাকবেন, তৃতীয় দিন টাভি অপারেশন হবে, আর চতুর্থ বা পঞ্চম দিন বাসায় ফিরবেন। এরপর টাভি প্রক্রিয়ার জন্য আলোচনা চললেও ডেট পাওয়া যাচ্ছিল না, কারণ ইউনাইটেড আরও দুজন রোগীর জন্য অপেক্ষা করছিল। পরে আরও দুজন রোগী পাওয়া গেলে তিনজনের একসঙ্গে টাভির সিদ্ধান্ত হয়। আমাদের জানানো হয়, থাইল্যান্ড বা তাইওয়ান থেকে একজন বিশেষজ্ঞ এসে ভালভ বসাবেন।
এরমধ্যে ভালভ তৈরির প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে জরুরি পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য আব্বা বেশ কয়েকবার ইউনাইটেডে যান। ৫ ডিসেম্বর আমরা ভেন্ডরকে ভালভ-এর জন্য পুরো টাকা দিয়ে দিই। টাভির জন্য ৭ ডিসেম্বর তিনি ভর্তি হন, দুই দিন পর্যবেক্ষণ ও বিভিন্ন টেস্ট করা হয় কিন্তু ডাক্তাররা আমাদের কোনো আপডেট দেননি— আব্বার শারীরিক অবস্থা কেমন, টাভির জন্য প্রস্তুত কি না, রিং বা টাভির কারণে অন্য কোনো সমস্যা হবে কি না; এসব কোনো বিষয়ই আমরা অবগত ছিলাম না। ৭ ও ৮ তারিখে নরমাল টেস্ট হয়। ৯ তারিখ ভোর ৫টায় আব্বাকে প্রস্তুত করা হয়, আর সকাল ৯টায় টাভি শুরু হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এই প্রক্রিয়াটি ডাক্তারদের নিয়ন্ত্রণেই ছিল না। এর ফলে নানা ধরনের জটিলতা দেখা দেয়।
কিন্তু সেদিন দুপুর সাড়ে ১২টা-১টার দিকে ডাক্তার আমাদের জানান, সব ঠিক আছে, তবে একটি জায়গা থেকে সামান্য রক্তক্ষরণ হচ্ছে, যা স্বাভাবিক। আমাদের তখন আরও চার ব্যাগ এ-নেগেটিভ ব্লাড সংগ্রহ করতে বলা হয়। আব্বার রক্ত খুব দুষ্প্রাপ্য হওয়ায় আমরা আগে থেকে দুই ব্যাগ প্রস্তুত রেখেছিলাম। অনেক কষ্ট করে- আরও চার ব্যাগ সংগ্রহ করে দিই। তারপর আব্বাকে সিসিইউতে নেওয়া হয়। হঠাৎ দেখি ডাক্তাররা ছোটাছুটি করছেন। আমার বোন, যিনি ডাক্তার, জোর করে ভেতরে ঢুকে দেখেন আব্বা কলাপস করেছেন, তাকে সিপিআর দেওয়া হয়েছে, চারপাশে রক্ত পড়ে আছে। ডাক্তাররা বলেন, ইন্টারনাল ব্লিডিং বন্ধ হচ্ছে না। কেন বন্ধ হচ্ছে না- এ বিষয়ে তারা স্পষ্ট জবাব দিতে পারেননি কেউ।
টাভির প্রত্যাশিত রেজাল্ট না আসায় ওই দিনই ডিসেম্বরের ৯ তারিখ রাতে আব্বার আরেকটি জটিল সার্জারির (ওপেন হার্ট) সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সেদিন বিকেল ৫টায় তাকে ওটিতে নেওয়া হয়। বাধ্য হয়ে ওপেন হার্ট সার্জারি করে ব্লিডিং-এর উৎস খুঁজে বের করা হয়। দেখা যায়, টাভির সময় ভালভ বসানোর প্রক্রিয়ায় হার্টে একটি ফুটো হয়েছে, সেখান থেকে রক্তক্ষরণ শুরু হয়। ৯ তারিখ রাতে ডাক্তার স্বীকার করেন, ভালভ বসানোর সময় ওপরের দিকে খোঁচা লেগেছে। আমরা অনিশ্চয়তা আর উৎকণ্ঠায় ভুগতে থাকি। এরপর ২৪ ঘণ্টা হার্ট ওপেন রাখার পর ডাক্তাররা ১০ তারিখ রাতে আব্বার ব্লিডিং বন্ধ হবার কথা জানান ও হার্ট বন্ধ করা হয়। কিন্তু ওপেন হার্টের পর আব্বার শরীরে নানা জটিলতা দেখা দেয়- ইনফেকশন, নিউমোনিয়া, শ্বাসকষ্ট। পরে তাকে বাইপ্যাপ লাগানো হয়। তবুও তিনি স্বাভাবিকভাবে শ্বাস নিতে পারছিলেন না। কয়েক ধাপে লাইফ সাপোর্ট দিয়ে রাখা হয়।
আব্বা ৯ ডিসেম্বর রাত থেকে ১৮ ডিসেম্বর সকাল পর্যন্ত সিআইসিইউতে ছিলেন। ১৮ ডিসেম্বর তাকে রুমে দেওয়া হয়। আর এখান থেকেই শুরু হয় ইউনাইটেডের চূড়ান্ত রকমের অবহেলা। এবং তা কোনো সুস্থ্য মানুষ মেনে নিবে না। যেমন- ক্রিটিক্যাল রোগীকে হুইলচেয়ারে করে বেডে দেওয়া হয়। কোনো ডাক্তার বা নার্স রোগীর ব্যাকগ্রাউন্ড জানতেন না। জুনিয়র নার্সরা দায়িত্বে ছিলেন, সিনিয়র কাউকে রাখা হতো না। ১৮ ও ১৯ ডিসেম্বর এই দুই রাত রুমে থাকার পর আব্বার অবস্থা আরও খারাপ হয়। আব্বার শ্বাসকষ্ট বাড়লে ২০ তারিখে তাকে আবার সিআইসিইউতে নেওয়া হয়। ২০ তারিখ থেকে আব্বা সিআইসিইউতেই ছিলেন। এরপর ডাক্তার আমাদের জানায়, আব্বার চেস্টে ইনফেকশন হয়েছে, কিডনি বিকল হয়েছে, ডায়ালাইসিস লাগবে। অথচ আব্বার আগে কখনো কিডনির সমস্যা ছিল না। ২১ ডিসেম্বর থেকে ৭ জানুয়ারি পর্যন্ত ১২ বার আব্বার কিডনি ডায়ালাইসিস করা হয়। ৯ ডিসেম্বর রাত থেকে ৭ জানুয়ারি পর্যন্ত মোট ১৬ ব্যাগ হোল ব্লাড এবং ১১ ব্যাগ প্লাটিলেট দেওয়া হয় আব্বাকে। এতো রকমের জটিলতা ও রোগীর শরীর পুরোপুরি কলাপস করার পরেও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ কোনো বোর্ড কল করেনি। দৃশ্যত ডাক্তারদের ভেতরে কোনো রকমের সমন্বয় ছিল না।
জন্ম-মৃত্যু ভাগ্যে লেখা থাকে। তবে আমরা যেটা ভুলতে পারব না সেটা হচ্ছে- আব্বার প্রতি ইউনাইটেড হাসপাতালের চরম অবহেলা, তথ্যের লুকোচুরি ও সবমিলিয়ে দায়িত্বহীনতা। শুধু সেরা ডাক্তার থাকলেই হয় না, ভালো চিকিৎসার জন্য প্রয়োজন টিম ওয়ার্ক এবং আনুষাঙ্গিক সাপোর্ট। ইউনাইটেড হাসপাতালের পোস্ট অপারেটিভ ও কেয়ার সার্ভিস বলতে গেলে আব্বাকে আমাদের কাছ থেকে কেড়ে নিল। এতদিন পর এসব বিস্তারিত বলার কারণ আমি ও আমার পরিবার ভয়াবহ অভিজ্ঞতাগুলো ভুলতে পারছি না। তাদের পোস্ট অপারেটিভ সার্ভিস এতটাই খারাপ যে, সিআইসিইউ থেকে নরমাল রুমে দেওয়ার দুই দিন পরই রোগীকে আবার সিআইসিইউতে-ই ফিরিয়ে নিতে হয়। রোগী যেন তাদের কাছে একটা পণ্য মাত্র, যার ওপর তারা ইচ্ছামতো পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাতে পারে। ৯ ডিসেম্বর যদি আব্বার হার্টের ফুটোটা ডাক্তাররা না করতেন হয়তো আমার আব্বা আজ এভাবে হঠাৎ চলে যেতেন না।
আমি আমার আম্মাকে আব্বার মৃত্যুর আসল কারণটা এখনো বলতে পারিনি। আম্মা নিজেও হার্টের রোগী, ওপেন হার্ট করা। তিনি জানেন না যে- আব্বার ওপর এত অত্যাচার হয়েছে। চিকিৎসা শেষ করে ৫ দিন পরেই আব্বা বাসায় ফেরার কথা ছিলো, অথচ ৩৪ দিন পরেও আব্বাকে আমরা ফেরত আনতে পারিনি। আর ইউনাইটেডের খরচের কথা নাই বা বললাম, তারা যে বাজেট দিয়েছিলো সেটা দ্বিগুণে গিয়ে শেষ হয়েছে। কিন্তু আব্বাকে শেষ সময়ে কষ্ট ছাড়া আর কিছুই দিতে পারেনি ইউনাইটেড হাসপাতাল।