আধুনিক প্রযুক্তির প্রভাব ও তরুণ সমাজ
-
-
|

মুত্তাকিন হাসান, ছবি: বার্তাটোয়েন্টিফোর
আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ব্যাপক উন্নয়নের ফলে মানুষ সহজেই পরস্পরের কাছে আসছে, দুরত্ব কমে যাচ্ছে পৃথিবীর। বিশ্বায়নের যুগে গোটা পৃথিবী এখন আমাদের হাতের মুঠোয়। একটি ক্লিকেই পেয়ে যাচ্ছি সব তথ্য।
ধারণা করা হচ্ছে বিশ্বের অর্ধেক জনসংখ্যাই ইন্টারনেটের আওতায় এসেছে। ইন্টারনেটের বদৌলতে আমরা পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে সহজেই যোগাযোগ করতে পারছি। বর্তমানে পৃথিবীর ৪২.২ শতাংশ মানুষ ইন্টারনেট ব্যবহারের সঙ্গে প্রতেক্ষভাবে যুক্ত। এক হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা প্রায় নয় কোটি। পৃথিবীর যেসব শহরে ফেইসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি ঢাকা তার মধ্যে দ্বিতীয়। ধারণা করা হয়, প্রায় প্রতি ১২ সেকেন্ডে একটি করে ফেইসবুক একাউন্ট খোলা হচ্ছে, যা দেশে জন্মহারের চেয়েও বেশি।
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ব্যাপক উন্নয়নের প্রভাবে বিশেষ করে তরুণদের মাঝে উদ্যমী, সৃষ্টিশীল চিন্তা-চেতনা বিকশিত হওয়ার ক্ষেত্র সৃষ্টি হচ্ছে। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও সত্য, আজকালের বেশিরভাগ তরুণরা এ সুবিধাকে সঠিকভাবে কাজে লাগাচ্ছে না।
ফেসবুক, টুইটার, ইউটিউবের মতো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের প্রতি নেতিবাচকভাবে আসক্ত হওয়ায়, এ সুযোগ সুবিধা কাজে না লাগিয়ে, নিজেদের মেধা বিকাশ না করে জড়িয়ে পড়ছে অনৈতিক কার্যকলাপে। তবে গ্রামের তরুণদের চেয়ে শহরের স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া তরুণদের মধ্যে এ প্রবণতা বেশি লক্ষ্য করা যায়। বিশেষ করে তরুণরা যারা ইংরেজি মাধ্যমে পড়ালেখা করছে তাদের অবস্থা নাজুক।
শহরের তরুণরা ভিনদেশি সংস্কৃতি, গান-বাজনাতে অভ্যস্ত বেশি। তরুণরা ফেইসবুকের ভাষায় কথা বলছে। সালাম দেওয়ার পরিবর্তে ব্যবহার করছে হাই-হ্যালো। নিজের মাতৃভূমির ভাষাকে বিকৃতভাবে ব্যবহার করে ইংরেজি বাংলা মিলিয়ে চলছে কথোপকথন।
বেশির ভাগ সময় পড়ে থাকে ফেসবুক নিয়ে। সামাজিক যোগাযোগের ব্যাপ্তি এত প্রকট যে, ক্লাসে বসেও চ্যাট বা এসএমএস বিনিময় করছে ছেলে মেয়েরা। অমনোযোগী হচ্ছে পড়ালেখায়। স্মার্ট ফোন তাদেরকে এতই স্মার্ট করছে যে, সামাজিক বন্ধন যেমন-মা-বাবা, ভাই-বোন, বন্ধু-বান্ধবদের মধ্যেই শুধু দূরত্বের সৃষ্টি হচ্ছে না, বরং সামাজিক শ্রদ্ধাবোধ কি জিনিস তারা একেবারেই ভুলতে বসেছে, যার ফলে অবক্ষয় হচ্ছে সামাজিক মূল্যবোধের।
সামাজিক যোগাযোগের মধ্যে লিপ্ত হতে গিয়ে অনেকে জড়িয়ে পড়ছে বিভিন্ন অনাকাঙ্ক্ষিত সর্ম্পকে এবং পরবর্তীতে যা বিভিন্ন অপরাধমূলক ঘটনারও জন্ম দিচ্ছে। প্রশ্নপত্র ফাস থেকে শুরু করে ব্যাংকের লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়ার মতো ঘটনাও ঘটছে। ভেঙ্গে পড়ছে সামাজিক মূল্যবোধ। তবে ফেসবুক বন্ধ বা স্মার্ট ফোন বিক্রি বন্ধই যে, এর সমাধান তা মোটেও গ্রহণযোগ্য নয়।
ঠিক ফেসবুকের মতোই ডিস্কোর ছোয়ায় তরুণরা নিজেদের প্রায় ভুলতেই বসছে। এক সময় সামাজিক নৈতিকতা গঠনের নিমিত্তে পারিবারিক সংস্কৃতি, বংশ ও ধর্মীয় শিক্ষাকে বেশ গুরুত্ব দেওয়া হত। আর এখন বৈষয়িক বিষয়গুলোকে বড় করে দেখার প্রবণতা বেড়েছে। এ সমাজ ব্যবস্থার সাথে সাঞ্জস্য রেখে চলতে গিয়ে অনেকে হতাশা, হীনমন্যতায় ভুগছে এবং বাধ্য হয়ে অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে।
যদিও বর্তমান বিশ্বের প্রতিটি দেশের মতো আমাদের সমাজব্যবস্থাও কতিপয় আইন ও নিয়মকানুন দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে। কিন্তু কেউ তার তোয়াক্কা করছে না। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম হয়ে উঠছে অপরাধের দৈত্যদানব।
সামাজিক ব্যবস্থা অটুট রাখতে, সামাজিক মূল্যবোধ টিকিয়ে রাখতে দরকার সামাজিক সচেতনতা ও সামাজিক আন্দোলন। সামাজিক সচেতনতার শুরুটা পরিবার থেকেই হওয়া উচিত। অথচ, নারী-পুরুষ সবাই নিজেদের জীবনযাত্রার মান বৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কাজ করছে এবং সেখানেই বেশিরভাগ সময় ব্যয় করছে। এর ফলে সন্তানদের প্রয়োজনীয় সময় দিতে পারছে না। যার কারণে, তাদের সন্তানদের সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়া ব্যাহত হচ্ছে। সন্তানরা বিভিন্ন অপসংস্কৃতি বা অপরাধ কার্যক্রমে জড়িয়ে পড়ছে। তাই, পরিবারের সাথে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর উচিৎ আজকের সম্ভামনাময় এই তরুণদের নৈতিক মূল্যবোধ শিক্ষার প্রতি নজর দেওয়া।
মুত্তাকিন হাসান: কবি, প্রাবন্ধিক ও মানব সম্পদ পেশাজীবী।