রিকশা বন্ধেই কি সমাধান?
-
-
|

শাহজাহান মোল্লা, ছবি: বার্তাটোয়েন্টিফোর
রাজধানীর যানজট নিরসনে তিনটি সড়কে রিকশা বন্ধের সিদ্ধান্ত জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। এই সিদ্ধান্তের পক্ষে-বিপক্ষে নানা আলোচনা-সমালোচনা চলছে। রিকশার বিকল্প ঠিক না করেই সরকারের এমন সিদ্ধান্তে মানুষের মাঝে নেতিবাচক ধারণাই বেশি জন্মাচ্ছে।
সড়কে গতি আনা এবং দুর্ঘটনা কমাতেই গরিবের বাহন রিকশাকে নিরুৎসাহিত করা হয়। বলা হয়েছে- রিকশার কারণে সড়কে তীব্র যানজট এবং ধীরগতি দেখা দিচ্ছে। আসলে কি তাই? রাজধানীজুড়ে যে হারে নির্মাণযজ্ঞ চলছে, তাতে যানজটের জন্য রিকশা কতটা দায়ী?
অযান্ত্রিক বাহন রিকশা অবশ্যই ধীরগতি নিয়ে আসে। কিন্তু তার চেয়ে বেশি ধীরগতি দেখা যায় সড়কে যত্রতত্র গাড়ি পার্কিং। যেন রাজধানীজুড়েই গাড়ি পার্কিংয়ের ব্যবস্থা করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, বাসগুলো যখন রাস্তায় চলাচল করছে যাত্রীরা যেখানে হাত তুলছেন, সেখানেই অর্ধেক রাস্তা জুড়ে বাস দাঁড়িয়ে আছে। এই প্রতিযোগিতা প্রতিদিনের প্রতি মুহূর্তের।
ট্রাফিক পুলিশের সামনে এমনটি ঘটছে হরহামেশাই। কিন্তু দুই একটি বাসকে জরিমানা করা ছাড়া কীই বা করেছে ট্রাফিক পুলিশ? আর সড়কে যে দুর্ঘটনার দোহাই দিয়ে রিকশা বন্ধ করার কথা বলা হচ্ছে, তাতে আসলে কতটা সেই বাহন দায়ী, তা নিয়েও রয়েছে অনেক বির্তক। কেননা এযাবৎকালে যে কয়েকটি দুর্ঘটনা ঘটেছে তার বেশির ভাগই ছিল বাসগুলোর অসুস্থ প্রতিযোগিতার কারণে।
একটি রিকশা যতটুক জায়গা দখল করে, তার চেয়ে দুই বা তিন গুণ বেশি জায়গা দখল করে একটি প্রাইভেট কার। রাজধানীর প্রধান সড়কগুলোর দিকে তাকালে দেখা যাবে, গণপরিবহনের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি প্রাইভেট কার। সকালে যখন অভিজাত এলাকার স্কুলগুলোর সামনে দিয়ে যাওয়া যায় তখন দেখা যায়, প্রতিটি বাচ্চার জন্য একটি করে প্রাইভেট কার। যার সামর্থ্য আছে সে ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়ে চলাচল করবে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু বাচ্চাকে স্কুলে নামিয়ে গাড়িটি চলে গেলে হয়তো এই দুর্ভোগ পোহাতে হত না।
নামিদামি স্কুলগুলোর পাশ দিয়ে গেলে মনে হবে, রাস্তা নয় যেন গাড়ি পার্কিং সেন্টার! কই সেখানে তো যানজট নিয়ে এত বেশি হা-হুতাশ করতে দেখা যায় না! আর রিকশা বন্ধই যদি সমাধান হয় তাহলে যেসব রাস্তায় রিকশা চলে না সেখানে কেন যানজট হয়?
রিকশা বন্ধ ভালো সিদ্ধান্ত কিন্তু অসুস্থ, বয়স্ক, শিশু যারা আপনা আপনি বাসে উঠতে পারেন না, তাদের জন্য এই নগরীতে কি কোনো পরিবহন ব্যবস্থা আছে? বাস্তবে দেখা যাবে নেই। আর মহানগরীতে এখনো বাসের পর্যাপ্ত কাউন্টার নেই, নেই বাসস্টপ। তাহলে সমাধান কোন পথে? এটা কি রিকশা বন্ধ, নাকি বিত্তবানদের হাতে রাস্তা ছেড়ে দেওয়ার অজুহাত তা নিয়েও মানুষের মনে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
দুই বছর আগে ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়ন্ত্রণে আইন করার কথা জানিয়েছিলেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। এনিয়ে বিস্তর আলোচনাও হয়েছিল যে, একটি পরিবারের জন্য একটির বেশি গাড়ি কেনা যাবে না। আর স্কুলগুলোকে স্কুলবাসে উদ্বুদ্ধ করার কথা বলা হয়েছিল। গত অর্থবছরে অর্থাৎ ২০১৮-১৯ সালে স্কুলবাস আমদানিতে শুল্ক ছাড় দেওয়া হয়েছিল। তবে সেই সুবিধা নিয়েছে, এমন উদাহরণ এখনো তৈরি হয়নি।
আসলে রাজধানীতে ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়ন্ত্রণ না করে আর ফুটপাত দখলমুক্ত না করে রিকশা বন্ধের সিদ্ধান্ত খুব বেশি ফলদায়ক হবে বলে মনে করেন না নগরবাসী। সড়কে গতি ফেরাতে হলে ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়ন্ত্রণ, যত্রতত্র গাড়ি পার্কিং বন্ধ, পর্যাপ্ত স্কুল বাস সার্ভিস চালু এবং নির্মাণাধীন সড়কে এক লেন পুরো যানবাহন চলাচলের উপযোগী করতে হবে।
দুই সিটি করপোরেশনে বৈধ রিকশা আছে ৮০ হাজার ৪৭৩টি। তার মধ্যে দক্ষিণে ৫২ হাজার ৭৫৩ এবং উত্তরে ২৬ হাজার ৭২০টি। তবে রাস্তায় রিকশা চলে পৌনে সাত লাখের মত। ১৯৮৬ সালের পর রাজধানীতে আর কোনো রিকশার লাইসেন্স দেওয়া হয়নি। শুধু যেগুলো ছিল সেগুলোর নবায়ন করা হয়েছে। পুলিশ এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের চোখের সামনেই বছরের পর বছর অবৈধ রিকশা চলছে আর সংখ্যা ধাপে ধাপে বাড়ছে। এর দায় আসলে কার?
শাহজাহান মোল্লা: সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট, বার্তাটোয়েন্টিফোর.কম