তাবলিগের চলমান সংকট সমাধানে আল্লামা শফি আলেমদের সম্মেলন থেকে ৫ সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছেন।
সোমবার (১০ ডিসেম্বর) সকাল ১১টায় হাটহাজারী মাদরাসার সেমিনার হলে তাবলিগ জামাতের চলমান সংকট ও টঙ্গি ইজতেমার মাঠে দিল্লির মাওলানা সাদপন্থীদের হামলার বিচারসহ করণীয় নির্ধারণে উলামা সম্মেলনে এসব সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়।
বিজ্ঞাপন
সম্মেলন থেকে টঙ্গিতে হামলাকারীদের দ্রুততম সময়ের মধ্যে গ্রেফতারের দাবি জানানো হয়। প্রতিনিধি সম্মেলনে তাবলিগের শীর্ষ মুরুব্বিরাও উপস্থিত ছিলেন।
সম্মেলনে হাটহাজারী মাদরাসার মহাপরিচালক আল্লামা শাহ আহমদ শফি সভাপতিত্ব করেন।
বিজ্ঞাপন
বৈঠকে তাবলিগের চলমান সংকট নিরসনে ৫টি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। সিদ্ধান্তগুলো হলো-
১. টঙ্গির ইজতেমার মাঠে সন্ত্রাসী হামলার সঙ্গে জড়িতদের এক সপ্তাহের মধ্যে গ্রেফতার করতে হবে।
২. ওয়াসিফুল ইসলাম, খান শাহাবুদ্দিন নাসিম ও মাওলানা আবদুল্লাহসহ হামলার ইন্ধনদাতাদের কাকরাইল থেকে স্থায়ীভাবে বহিষ্কার করতে হবে।
৩. তাবলিগে উলামায়ে কেরামের নেতৃত্ব গ্রহণ করা, মাওলানা সাদের বিভ্রান্তিসমূহ ও এ বিষয়ে একটি ফতোয়া তৈরি করে সারাদেশে প্রচার করা। বিষয়গুলো বাস্তবায়নের জন্য ৬-১০ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা।
৪. তাবলিগের কাজ সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য ১৫-১৮ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা। তাতে দেশের শীর্ষ আলেম ও তাবলিগি মুরুব্বিদের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা।
৫. যথাসময়ে বিশ্ব ইজতেমার আয়োজন করা। তবে সরকারের সঙ্গে আলোচনা করে পূর্ব নির্ধারিত তারিখের কাছাকাছি সময়ে অন্যকোনো তারিখও নির্ধারণ করা যেতে পারে।
বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ কওমি মাদরাসা শিক্ষাবোর্ড বেফাকের মজলিসে আমেলা (নির্বাহী কমিটি), মজলিসে খাস, কওমি মাদরাসাসমূহের সর্বোচ্চ নিয়ন্ত্রক সংস্থা আল হাইয়াতুল উলয়া লিল জামিয়াতিল কওমিয়ার শীর্ষ নেতৃবৃন্দ।
উল্লেখ্য, গত ১ ডিসেম্বর ইজতেমার মাঠে বিশ্ব ইজতেমার প্রস্তুতির কাজে থাকা তাবলিগের সাথী ও মাদরাসা শিক্ষার্থীদের ওপর নৃশংস হামলা চালায় সাদপন্থীরা। এতে ১ জন নিহতসহ আহত হয় সহস্রাধিক। আহতদের বেশিরভাগই মাদরাসার শিক্ষার্থী।
ধর্ম উপদেষ্টা ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন বলেছেন, রমজানের তাৎপর্যকে অনুধাবন করে সিয়াম সাধনা করতে হবে। রোজা যেন কেবল লৌকিকতায় পরিণত না হয়।
সোমবার (৩ মার্চ ২০২৫) বিকেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি অডিটোরিয়ামে বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের ইফতার মাহফিলে প্রধান অতিথির বক্তৃতায় তিনি এসব কথা বলেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এ আয়োজনে পৃষ্ঠপোষকতা দেন তুর্কি দিয়ানেত ফাউন্ডেশন।
ধর্ম উপদেষ্টা বলেন, রমজানের সুষমাকে ধারণ করে জীবনের প্রতিটি বাঁকে পরিশুদ্ধি আনতে হবে। আমাদের চরিত্রে নৈতিকতার উজ্জীবন ঘটাতে হবে এবং সুকুমার বৃত্তিকে জাগ্রত করতে হবে। চরিত্রের কূপ্রবৃত্তিকে দমিয়ে রাখতে হবে।
রাষ্ট্রের সম্পদ আত্মসাৎ করাকে দুর্ভাগ্যজনক অভিহিত করে ধর্ম উপদেষ্টা বলেন, দেশ পরিচালনার দায়িত্ব পেলে লুটেপুটে খাওয়ার অশুভ মানসিকতা পরিহার করতে হবে। আমরা দায়িত্ব পেলে ওপরেরটিও খাই, তলারটিও কুড়ায়। এই কালচার থেকে আমাদেরকে বের হয়ে আসতে হবে। তিনি রমজানের ত্যাগের মহিমায় চরিত্রের মন্দ দিকগুলো পুড়িয়ে ফেলার আহ্বান জানান।
ড. খালিদ বলেন, রমজানের সিয়াম সাধনা শুধু আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য, কেবল আল্লাহকে রাজি-খুশি করার জন্য। তিনি সকলকে সিয়াম সাধনার আল্লাহর সন্তুষ্টির পাশাপাশি সমাজে সম্প্রীতির বার্তা ও ভ্রাতৃত্বের সৌরভ ছড়িয়ে দেওয়ার অনুরোধ জানান।
বিশেষ অতিথির বক্তৃতায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে তুর্কি সরকারের সাথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নানামাত্রিক সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। বিশেষ করে দিয়ানেত ফাউন্ডেশন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়নে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। তিনি এ ইফতার মাহফিলকে বাংলাদেশ ও তুকি দুদেশের মধ্যকার সম্পর্কের ক্ষেত্রে নতুন মাইলফলক হিসেবে আখ্যা দেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ট্রেজারার প্রফেসর ড. এম জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীর সভাপতিত্বে এ অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথির বক্তৃতা করেন ভাইস চ্যান্সেলর প্রফেসর নিয়াজ আহমদ খান ও বাংলাদেশে দিয়ানেত ফাউন্ডেশনের প্রতিনিধি অঘুজহান আদসিজ। এ অনুষ্ঠানে মূখ্য আলোচক হিসেবে রমজানের গুরুত্ব ও তাৎপর্য নিয়ে আলোচনা করেন আরবী বিভাগের চেয়ারম্যান প্রফেসর জোবায়ের মোহাম্মদ এহসানুল হক।
এ সময় অন্যান্যের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রো-ভিসি সায়মা হক বিদিশাসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক, সহকারী অধ্যাপক, প্রভাষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীরা উপস্থিত ছিলেন।
রাফায় রমজানের প্রথম দিনে ইফতারের জন্য জড়ো হওয়া ফিলিস্তিনিরা ধ্বংসস্তূপে ঘেরা এক বিশাল ইফতারের টেবিলে বসে আছে, ছবি: সংগৃহীত
ইসলাম
শুরু হয়েছে পবিত্র রমজান। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের মুসলমানদের মতো ইসরায়েলি আগ্রাসনে বিধ্বস্ত গাজার মানুষেরাও শুরু করেছেন রোজা। তবে অন্যান্য দেশ বা অঞ্চলের মানুষ যতটা উৎসাহ, উদ্দীপনা আর উচ্ছ্বাস নিয়ে রমজান শুরু করেছেন, শোকাহত গাজাবাসীর সেই সুযোগ ছিল না। কিন্তু তাদের বিশ্বাসের কোনো কমতি নেই। গাজাবাসীর রমজান ও বিশ্বাসের বিষয়ে কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল-জাজিরায় লিখেছেন ফিলিস্তিনি লেখিকা ইসরা আবু ক্বামার।
বিশ্বের অন্য প্রান্তে যখন মানুষ উৎসবের আবহে রমজানের রোজা ও ইবাদত শুরু করছে, তখন আমরা তা করছি শোক ও বেদনার মধ্যে। যুদ্ধের আর্তনাদ এখনো কানে বাজছে। এই যুদ্ধবিরতি স্থায়ী হবে কি না, কেউ জানে না। সবাই উদ্বিগ্ন ভবিষ্যৎ নিয়ে। সবারই আশঙ্কা- যদি আবার যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়!
গত এক বছরে আমরা যা দেখেছি, যা সহ্য করেছি, তার স্মৃতি ও ট্রমা আমাদের মনকে ভারাক্রান্ত করে রেখেছে। তবে এটি প্রথম নয় যে, আমরা যুদ্ধের মধ্যে রমজান পালন করছি। ২০১৪ সালেও যুদ্ধ চলাকালে রমজান কেটেছিল। তখন আমার বয়স মাত্র ৯ বছর। তবুও স্পষ্ট মনে আছে, কীভাবে সে সময় বিমান হামলা আর ধ্বংসস্তূপের মধ্যে আমাদের রমজানের রাতগুলো কেটেছিল। স্পষ্ট মনে আছে, আমাদের পাড়ায় বোমা বর্ষণের সময় কীভাবে আমরা অন্ধকারের মধ্যে তাড়াহুড়ো করে ঘর ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছিলাম।
কিন্তু গত বছরের রমজান ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। সেটা ছিল অকল্পনীয়ভাবে ভয়াবহ। চারপাশে শুধুই ক্ষুধা। সারা দিন উপবাস থেকে ইফতার করতাম এক ক্যান হামুস বা মটরশুঁটি দিয়ে। এইটুকু খাবারও খেতাম ছয়জন মিলে ভাগ করে। বিদ্যুৎ না থাকায় সেই বিস্বাদ টিনজাত খাবার অন্ধকারে চিবিয়ে খেতাম। টেবিলের ওপারে থাকা পরিবারের সদস্যদের মুখও দেখতে পেতাম না।
প্রথম রোজায় খালেদ আল-নাজি এবং তার পরিবার তাদের ধ্বংসপ্রাপ্ত বাড়িতে ইফতার করছেন, ছবি: সংগৃহীত
আমরা আমাদের আত্মীয়স্বজনদের থেকেও দূরে ছিলাম। যাদের সঙ্গে আগে রমজান কাটাতাম- আমার দাদি, খালা, ফুফু, চাচাতো-খালাতো ভাইবোনরা-সবাই ছড়িয়ে-ছিটিয়ে গিয়েছিল। কেউ আশ্রয়শিবিরের তাঁবুতে, কেউ আটকে ছিল উত্তরে। যে মাসটি একত্রিত হওয়ার, তা আমাদের জন্য হয়ে উঠেছিল বিচ্ছিন্নতা ও নিঃসঙ্গতার মাস।
আমাদের কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া হয়েছিল রমজানের আনন্দময় আবহ। আমরা ব্যাকুল হয়ে অপেক্ষা করতাম মাগরিবের আজানের জন্য, ফজরের আজানের জন্য- কিন্তু সেই ডাক কখনো শোনা যেত না। সব মসজিদ ধ্বংস হয়ে গিয়েছে। যারা আজান দিতে চেয়েছিল, তারাও ভয় পেয়েছিল। ভয় ছিল, তাদের কণ্ঠস্বর হয়তো বোমার নিশানা বানিয়ে দেবে, তারা হয়তো হামলার লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হবে।
কাছের মসজিদের লাউডস্পিকারে মুয়াজ্জিনের কণ্ঠ শোনার বদলে আমরা ইফতার করতাম ক্ষেপণাস্ত্রের বিকট আওয়াজ আর গোলাগুলির শব্দে। যুদ্ধের আগে, ইফতারের পর পরিবারের সঙ্গে মসজিদে যেতাম নামাজ পড়তে, আপনজনদের সঙ্গে দেখা করতে। তারপর গাজার রাস্তায় ঘুরে বেড়াতাম, রমজানের প্রাণবন্ত পরিবেশ উপভোগ করতাম, শেষে বাড়ি ফিরে তাজা কাতায়েফ খেতাম। কিন্তু গত বছর, গণহত্যার মধ্যে, আমাদের কোথাও যাওয়ার উপায় ছিল না।
গাজার সবচেয়ে সুন্দর ও ঐতিহাসিক মসজিদগুলোর একটি- গ্রেট ওমরি মসজিদ, যেখানে আমার বাবা ও ভাইয়েরা রমজানের শেষ দশ রাত কাটাতেন, যেখানে কোরআন তেলাওয়াত হতো সুমধুর কণ্ঠে- সেটাও ধূলিসাৎ হয়ে গিয়েছিল। যে স্থান একসময় ছিল ইবাদত ও শান্তির প্রতীক, তা পরিণত হয়েছিল ধ্বংসস্তূপে।
এ বছরের রমজান শুরু হচ্ছে যুদ্ধবিরতির মধ্যে। ইফতারের সময় আর বোমার আঘাতে জমিন কাঁপে না। ফজরের নীরবতা ভেঙে আর বিস্ফোরণের শব্দ শোনা যায় না। এখন অন্তত এই ভয় নেই যে, ঘর সাজানোর রঙিন বাতি ঘরগুলোকে হামলার লক্ষ্যবস্তু বানিয়ে দেবে।
ব্যথা আর বিপর্যয়ের মাঝেও গাজার রাস্তায় জীবন ফিরে আসার চেষ্টা করছে। যেসব দোকানপাট এখনো টিকে আছে, সেগুলো আবার খুলেছে। ফেরিওয়ালারাও ফিরে এসেছে। নুসেইরাতের বড় সুপারমার্কেট হাইপার মল আবার চালু হয়েছে। রমজানের আগে আমার বাবা আমাকে ও আমার বোনকে সেখানে নিয়ে গিয়েছিলেন। আলোকিত মলে ঢুকে আমরা উচ্ছ্বাস সামলাতে পারছিলাম না। মুহূর্তের জন্য মনে হয়েছিল, যেন আমরা অতীতে ফিরে গিয়েছি। তাকাগুলো আবার ভরে গিয়েছে- চকোলেট, বিস্কুট, চিপসের নানা ব্র্যান্ডে। ছিল রমজানের সাজসজ্জা, নানা আকৃতির ফানুস, খেজুরের বাক্স, রঙিন শুকনো ফল আর ক্বমর আল-দিন।
কিন্তু এই প্রাচুর্য বিভ্রমমাত্র। দোকানপাটে যা কিছু রয়েছে, তার বেশির ভাগই এসেছে বাণিজ্যিক ট্রাকে, যা মানবিক সাহায্যের পরিবর্তে গাজায় ঢোকার অনুমতি পেয়েছে। অথচ এসব পণ্য অধিকাংশ মানুষের সাধ্যের বাইরে- যারা তাদের জীবন ও জীবিকা হারিয়েছে।
তাহলে গাজার বেশির ভাগ মানুষ এবার ইফতারে কী খাবে? হয়তো টিনজাত খাবারের চেয়ে একটু ভালো কিছু- একটা সাধারণ খাবার, হয়তো ভাত, মোলোখিয়া বা যতটুকু সবজি তারা কিনতে পারবে।
আল ফারুক মসজিদের ধ্বংসাবশেষের চারপাশে নামাজ আদায়, ছবি: সংগৃহীত
আমাদের পরিবারের জন্য প্রথম ইফতারে থাকছে মুসাখান-পালংশাকের রুটি, মুরগি ও প্রচুর পেঁয়াজ দিয়ে তৈরি এক ফিলিস্তিনি খাবার। আমরা জানি, আমরা ভাগ্যবান। গাজার বেশির ভাগ মানুষ সেই মুরগিও কিনতে পারবে না, যা এখন বাজারে পাওয়া গেলেও যুদ্ধের আগে দামের দ্বিগুণ হয়ে গেছে।
কিন্তু খাবারই একমাত্র জিনিস নয়, যা এ বছরের রমজানের টেবিল থেকে হারিয়ে যাবে। যুদ্ধের এই সময়ে ৪৮ হাজারের বেশি মানুষ নিহত হয়েছে। পুরো পরিবার ধ্বংস হয়ে গেছে, সরকারি তালিকা থেকে তাদের নামই মুছে গেছে। তারা আর কখনো রমজান পালন করবে না।
অসংখ্য ইফতার টেবিলে থাকবে এক শূন্য আসন- একজন বাবা, যার কণ্ঠে আর শোনা যাবে না সন্তানদের ডাক; এক ছেলে, যে আর অধীর আগ্রহে ইফতারের অপেক্ষা করবে না; এক মা, যার হাতে আর কখনো তৈরি হবে সুস্বাদু খাবার।
আমিও আমার প্রিয় মানুষদের হারিয়েছি। আমার খালার স্বামী, যিনি প্রতি বছর আমাদের ইফতারে ডাকতেন, তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। আমার বন্ধু শাইমা, লিনা আর রোয়া- যাদের সঙ্গে আমি তারাবির নামাজের পর মসজিদে দেখা করতাম- তারা সবাই শহীদ হয়েছে।
ধ্বংসাবশেষের পাশে বসে কোরআন তেলাওয়াত করছেন এক ফিলিস্তিনি, ছবি: সংগৃহীত
উৎসবের আমেজ হয়তো নেই, কিন্তু রমজানের মূল সত্তা টিকে আছে। এই মাস আমাদের জীবনের অন্যান্য ব্যস্ততা ও চিন্তা থেকে দূরে সরে গিয়ে ইমানের সঙ্গে সংযোগ করার সুযোগ দেয়। এটি ক্ষমার সময়। এটি আল্লাহর কাছে ঘনিষ্ঠতা ও আধ্যাত্মিক ধৈর্য খোঁজার মাস।
আমাদের মসজিদ ধ্বংস হয়ে যেতে পারে, কিন্তু আমাদের বিশ্বাস ভাঙেনি। আমরা এখনো ধ্বংসস্তূপে, তাঁবুর নিচে তারাবির নামাজ পড়ব। আমরা আমাদের সব আশা নিয়ে দোয়া করব, কোরআন তেলাওয়াতে সান্ত্বনা খুঁজব, এই বিশ্বাস নিয়ে যে, আমাদের সব কষ্টের প্রতিদান আল্লাহ দেবেন।
প্রথম রোজায় মসজিদে হারাম প্রাঙ্গণে ইফতারের দৃশ্য, ছবি: সংগৃহীত
ইসলাম
পবিত্র রমজান সওয়াব অর্জনের প্রতিযোগিতার মাস। হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, বান্দার সওয়াব অর্জনের এ প্রতিযোগিতা মহান আল্লাহ দেখেন। তাই মুমিনদের উচিত, এ মাসে ভালো কাজের প্রতিযোগিতা বেশি বেশি করা। রোজাদারকে ইফতার করানো রমজানের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ভালো কাজ।
রোজাদারকে ইফতার করানো অত্যন্ত সওয়াবের কাজ। হাদিসে ইফতার করানোর অনেক ফজিলত বর্ণিত হয়েছে। হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো রোজাদারকে ইফতার করাবে, তার গুনাহ মাফ হয়ে যাবে, সে জাহান্নাম থেকে মুক্তি লাভ করবে, ওই রোজাদারের সওয়াবের সমপরিমাণ সওয়াব সে লাভ করবে। তবে ওই রোজাদারের সওয়াবে কোনো কম করা হবে না।’
সাহাবায়ে কেরাম এ কথা শুনে বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসুল! আমাদের অনেকেরই রোজাদারকে ইফতার করানোর সামর্থ্য নেই।’ হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, ‘পানিমিশ্রিত এক কাপ দুধ বা একটি শুকনো খেজুর অথবা এক ঢোক পানি দিয়েও যদি কেউ কোনো রোজাদারকে ইফতার করায়, তাতেও আল্লাহ তাকে সেই পরিমাণ সওয়াব দান করবেন। আর যে ব্যক্তি কোনো রোজাদারকে তৃপ্তিসহকারে আহার করাবে, আল্লাহতায়ালা তাকে হাউজে কাউসার থেকে এমন পানীয় পান করাবেন, যার ফলে সে জান্নাতে প্রবেশ করার আগ পর্যন্ত তৃষ্ণার্ত হবে না।’ -মিশকাত
অন্য হাদিসে এসেছে, নবীজি (সা.) ইরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো রোজাদারকে ইফতার করাবে, সে ওই রোজাদারের সমপরিমাণ সওয়াব পাবে এবং রোজাদারের সওয়াবও কমানো হবে না।’ -জামে তিরমিজি
অনেকে মনে করেন, ইফতার করালে দাওয়াতকারী ব্যক্তি রোজার পুরো সওয়াব পেয়ে যাবেন। এটি একটি ভুল ধারণা। উল্লিখিত উভয় হাদিসে এ ব্যাপারে বলা হয়েছে, দাওয়াতকারী ব্যক্তি রোজাদারের সমপরিমাণ সওয়াব পাবেন। এবং রোজাদারের সওয়াবও বিন্দু পরিমাণ কমানো হবে না। সুতরাং সামর্থ্য অনুযায়ী রোজাদারকে ইফতার করানোর মাধ্যমে সওয়াব অর্জনের চেষ্টা করা আমাদের সবার কর্তব্য।
ইফতারের আদব নিয়মিত খাওয়াদাওয়া করার সময় যেসব আদব অনুসরণ করতে হয়, তা ইফতারের সময়ও অনুসরণ করা চাই। তবে ইফতারের রয়েছে বিশেষ কিছু সুন্নত ও আদব। যেমন-
সময় হওয়ার পরপরই ইফতার করা: সূর্যাস্তের ব্যাপারে নিশ্চিত হয়ে কিংবা মাগরিবের আজানের সঙ্গে সঙ্গে ইফতার শুরু করে দেওয়া সুন্নত। নবী কারিম (সা.) বলেন, ‘লোকেরা তত দিন পর্যন্ত কল্যাণের মধ্যে থাকবে, যত দিন তারা ইফতার দ্রুত সম্পন্ন করবে।’ -সহিহ বোখারি
সম্মিলিত ইফতার করা: একা একা ইফতার করা অনুচিত। হাদিসে এসেছে, ‘যে ব্যক্তি কোনো রোজাদার ভাইকে ইফতার করাবে, সে ওই ব্যক্তির রোজার সওয়াব লাভ করবে। এবং তার রোজার সওয়াবের মধ্য থেকে কমানো হবে না।’ -জামে তিরমিজি
ইফতারের আগে দোয়া করা: হাদিসে এসেছে, ‘ইফতারের সময় সাধারণত রোজাদারের দোয়া ফেরত দেওয়া হয় না।’ -ইবনে মাজাহ
মিষ্টিজাতীয় খাবার দিয়ে ইফতার শুরু: বিশেষত খেজুরের মাধ্যমে ইফতার শুরু করা সুন্নত। মিষ্টিজাতীয় কিছু পাওয়া না গেলে পানি দিয়ে ইফতার করলেও সুন্নত আদায় হয়ে যাবে।
ইফতারের বিশেষ দোয়া পড়া: ইফতার শুরু করার সময় যে দোয়াটি পড়বেন, তা হলো- (উচ্চারণ): ‘আল্লাহুম্মা লাকা সুমতু ওয়ালা রিজকিকা আফতারতু।’
অর্থ: হে আল্লাহ! আমি আপনার জন্যই রোজা রেখেছি এবং আপনার দেওয়া রিজিক দিয়েই ইফতার করছি।’ -সুনানে আবু দাউদ
এ ছাড়া ইফতার শেষ করার পর আরেকটি দোয়া পড়ার কথা এসেছে। দোয়াটি হলো- উচ্চারণ: জাহাবাজ্জামাউ ওয়াবতাল্লাতিল উরুকু ওয়াসাবাতাল আজরু ইনশা আল্লাহ।
অর্থ: পিপাসা মিটেছে, শিরাগুলো সিক্ত হয়েছে এবং আল্লাহ চান তো সওয়াব সাব্যস্ত হয়েছে। -সুনানে আবু দাউদ
সৌদি আরবে রমজান মাস শুরু হলে ছোট মেয়েরা হাতে মেহেদি দিয়ে রোজা পালন করে, এটা তাদের ঐতিহ্য, ছবি: সংগৃহীত
ইসলাম
পবিত্র রমজানের আগমনের সঙ্গে সঙ্গে নারীরা হাতে মেহেদি দিয়ে অল্পবয়সী মেয়েদের রোজা পালনে উৎসাহ দেন। এভাবে রমজান মাসকে স্বাগত জানানোর ঐতিহ্য চলে আসছে দীর্ঘদিন ধরে। সৌদি আরবের উত্তর সীমান্ত অঞ্চলের এই রীতির কথা এখন সৌদিজুড়ে প্রশংসিত। এমনকি দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এটা অনেকেই পালন করে থাকেন।
সৌদি সংবাদ সংস্থা এসপিএ জানিয়েছে, অনেক পরিবার রমজানের প্রথম রাতে তাদের মেয়েদের হাতে মেহেদি লাগানোর ব্যবস্থা করে। মেয়েরা মেহেদির সুন্দর সুন্দর নকশা দিয়ে তাদের হাত সাজায়। এই রীতি কোনো ধরনের চাপ ছাড়া শিশুদের রোজা পালনে সাহায্য করে।
আরার শহরের এক নারী উইজদান আল-আনজি বলেন, গত বেশ কয়েক বছর ধরে তিনি রমজানের শুরুতে তার মেয়েদের হাতে মেহেদি লাগিয়ে আসছেন। এটি একটি সুন্দর ঐতিহ্য, যা মেয়েদের মনে করিয়ে দেয় যে; তারা প্রাপ্তবয়স্কদের সঙ্গে রমজানের পরিবেশের অংশবিশেষ।
আরেকজন নারী আফাফ আল-থাওয়াইনি বলেন, এই ঐতিহ্যের প্রভাব কেবল নান্দনিক দিক দিয়েই সীমাবদ্ধ নয়, বরং এটি মেয়েদের হৃদয়ে ধর্মীয় ও সামাজিক মূল্যবোধকে উৎসাহিত করে। এই ইতিবাচক পদ্ধতি শিশুদের কোনো চাপ ছাড়া রোজা রাখতে সাহায্য করে, যা তাদের এই বরকতময় মাসে রোজার জন্য আগে থেকেই প্রস্তুত করে।
এক শিশু আরেক শিশুকে হাতে মেহেদি লাগিয়ে দিচ্ছে, ছবি: সংগৃহীত
তিনি আরও বলেন, এই সুন্দর ঐতিহ্য সৌদি আরবের উত্তর সীমান্ত অঞ্চলের মানুষের সাংস্কৃতিক ও সামাজিক পরিচয়ের অংশ। হাতের মেহেদি মেয়েদের মনে করিয়ে দেয় যে, তারা রোজা রাখছে এবং তারা খাবার বা পানীয়ের জন্য হাত বাড়াতে পারে না।
প্রসঙ্গত একটি মাসয়ালা বলে রাখা ভালো, রোজা অবস্থায় বড়রাও মাথায় মেহেদি ব্যবহার করতে পারবেন। অনেকেই বলেন যে, রোজা অবস্থায় মাথায় ঠান্ডা কোনো কিছু দেওয়া নিষেধ; এতে নাকি রোজা হালকা হয়ে যায়। এগুলো ভিত্তিহীন কথা।
মাসয়ালা হলো, রোজা রেখে মাথায় মেহেদি, তেল, শ্যম্পু ইত্যাদি দেওয়া যাবে। এতে রোজার কোনো ক্ষতি হবে না। হাদিস শরিফে এসেছে, হজরত কাতাদাহ (রহ.) বলেন, রোজাদারের তেল ব্যবহার করা উচিত, যাতে রোজার কারণে সৃষ্ট ফ্যাকাশে বর্ণ দূর হয়ে যায়। -মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক: ৭৯১২