কোথায় দাঁড়িয়ে বাংলা ধারাভাষ্য?
-
-
|

এআই-য়ে তৈরি ছবি
সুন্দরভাবে কথা বলতে পারা শিল্প! সেই শিল্পের সঙ্গে যখন সুমিষ্ট কণ্ঠে যোগ হয় নানা তথ্য-উপাত্ত আর প্রিয় খেলার ধারাবিবরণী তখন ইথারে ভেসে আসা শব্দ, নিছক শব্দ থাকে না! মন্ত্রমুগ্ধতা ছড়িয়ে পড়ে! একটা সময় যখন বিনোদনের এত-শত মাধ্যম ছিল না, তখন গুলিয়েলমো মার্কোনির আবিষ্কার ছোট্ট বেতার ছিল অনেকের প্রিয় সঙ্গী। আর সেই রেডিও থেকেই ভেসে আসা শব্দের খেলায় জীবন্ত হয়ে উঠত মাঠ আর মাঠের কত কিছু!
বেতারে বাংলা ধারাভাষ্যের গল্পটাও এমনই মিষ্টিমধুর স্মৃতি হয়ে আছে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে। যার শুরুটা হয়েছিল বাংলাদেশ নামের দেশটির জন্মের আগেই! তারপর একাত্তরে একসাগর রক্তের বিনিময়ে একটা লাল-সবুজ পতাকা পেতেই দারুণ গতি পেয়েছিল বাংলা ধারাভাষ্য। শুরুতেই ফুটবলই ছিল মূল আকর্ষণ; এরপর যোগ হলো ক্রিকেট। কিন্তু স্বাধীনতার ৫৪ বছর পেরিয়ে কোথায় দাঁড়িয়ে বাংলা ধারাভাষ্য? কতটা এগিয়েছে এই গল্পের চেয়ে সমৃদ্ধ ইতিহাসের গল্প সোনালি অতীত হয়ে যাচ্ছে কি না, সেই প্রশ্নটাও আহত পাখির মতো ঘুরপাক খাচ্ছে চারপাশে!
অথচ বেতারের সেই জগতে বাংলা ধারাভাষ্য যুক্ত করতেও রীতিমতো যুদ্ধ করেছেন অনেক অগ্রজ। প্রয়াত আব্দুল হামিদ তাদের একজন। ষাটের দশকে রেডিওতে দেশি-বিদেশি খেলার ধারাবিবরণী ইংরেজি আর উর্দুতেই প্রচার করা হতো। পাকিস্তানি শাসনের সেই সময়ে গুরুত্ব ছিল না বাংলার। শুধু খেলার বিরতি চলার সময় বাংলায় সংক্ষিপ্ত বিবরণী প্রচার হতো।
বাংলার প্রতি সেই অবজ্ঞার জবাবটা দিতে গিয়ে লড়তে হয়েছে আব্দুল হামিদদের। নিজের বাড়িতে নিজেকেই অতিথি হয়ে থাকার মতো কষ্টকর সেই পথ পাড়ি দিয়ে ১৯৬৩ সালে এসে জয় হয় বাংলার, বাংলা ভাষার। ওই বছরের আগস্টে প্রথমবারের মতো সেই আব্দুল হামিদেরই ভরাট কণ্ঠে বাংলায় সম্প্রচারিত হয় খেলার ধারাবিবরণী। এরপর গত শতাব্দীর শেষ দিকে এসে ক্রিকেটের উত্থানের সময়টাতে আরও বেশি রঙিন হয়েছে ধারাভাষ্য। আব্দুল হামিদদের গড়ে দেওয়া পথে যুক্ত হয়েছে আরও অনেক নাম। আরও অনেক কথার জাদুকর!
কিন্তু লম্বা সেই পথ পেরিয়ে এসে এখন কেমন যেন সব রঙহীন। রেডিও-টেলিভিশন দুই জায়গা থেকেই হারিয়ে যেতে বসেছে বাংলা ধারাভাষ্য! অবস্থাটা এখন এমন হয়েছে, ম্যাচের কখনও যদি বাংলায় ধারাভাষ্য শুরু হয় তখন রিমোটের মিউট বাটনে চাপ দিয়ে বসেন অনেকে!
আব্দুল হামিদ, আলফাজ আহমেদ, আতাউল হক মল্লিক, মঞ্জুর হাসান মিন্টু, তৌফিক আজিজ খান, খোদাবক্স মৃধা, মোহাম্মদ মুসা, নিখিল রঞ্জন দাস সঙ্গে তুমুল জনপ্রিয় নতুন এক ধারা তৈরি করা চৌধুরী জাফরউল্লাহ শারাফত। এমন শিল্পী অগ্রজ ধারাভাষ্য যে দেশের সেখানেই কি না, বেতার-টিভি থেকে হারাতে বসেছে বাংলা!
এমন দিন দেখতে হবে ভাবতেও পারেননি আলফাজ আহমেদ। যিনি চার দশকেরও বেশি সময় জড়িয়ে আছেন বাংলা ধারাভাষ্যে। একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের আগের দিন দুঃখ নিয়ে এই প্রবীণ ক্রীড়াব্যক্তিত্ব বলছিলেন, বায়ান্ন বছর দেশ স্বাধীন হয়েছে এতদিনেও এখনও বাংলা ভাষায় ক্রিকেটে ধারা বর্ণনা হয় না। এটার জন্য দায়ী কারা, ধারাভাষ্যকাররা নাকি অন্য যারা তারাও। কবে হবে? এই দেশটার মানুষ তো বাংলাদেশিরা, এখানকার মালিক তো ইংরেজরা না।
বেতারের চিত্রও একই। টেনেটুনে চলছে বাংলা ধারাভাষ্য। আলফাজ আহমেদদের পথ ধরে যারা এসেছেন ধারাভাষ্যের জগতেও তাদের মনেও একরাশ হতাশা। তরুণ কুমার কল্যান বলছিলেন, বেতারে বাংলা ভাষার চর্চাটা হয়। তবে এফএম রেডিও আসার পর বাংলা নয়, বাংলিশের চর্চাটা বেশি হচ্ছে। যারা সত্যিকারের বাংলা ধারাভাষ্যকার, হামিদ ভাই থেকে শুরু করে আলফাজ ভাই যখন ধারাভাষ্য দেন তখন প্রমিত বাংলা উচ্চারণ সঠিক ব্যাকরণ মেনে তারা কথা বলেন। কিন্তু এখন যারা আসছে তারা একশর মধ্যে ৯৫টাই বলেন ইংরেজি। এটা তো বাংলা ধারাভাষ্য হয় না! আমি কলকাতার অজয় বসুর টিপস নিয়েছিলাম, তিনি বলেছিলেন, শুধু বাংলা নয়, যে যেই ভাষায় ধারাভাষ্য দেবে তার কথায় সেই ভাষার ব্যবহার থাকতে হবে ৮৫ থেকে ৯০ ভাগ। কিন্তু এখন সেটা দেখা যায় না!
ভারতের প্রসঙ্গ টেনে কুমার কল্যান আরও বলছিলেন, ভারতের চ্যানেলগুলোতে দেখুন তাদের জাতীয় দল যখন খেলে তখন তাদের জাতীয় ভাষায় ধারাভাষ্য হয়। পশ্চিমবঙ্গে বাংলায় ধারাভাষ্য হয়। কিন্তু আমরা উল্টো পথে হাঁটছি। সবশেষ সাফ অনূর্ধ্ব-২০ যে নারী ফুটবল হয়ে গেল, সেখানে বিটিভি খেলা দেখাল। যেখানে এক দিন শুধু বাংলায় ধারাভাষ্য হলো। বাকি সব দিন ইংরেজিতে। অথচ দেখুন এই দেশটাই কিন্তু ভাষার জন্য রক্ত দিয়েছে। যারা শহীদ হয়েছেন তাদের প্রতি শ্রদ্ধাটা কি শুধু একুশে ফেব্রুয়ারি এলে হাতে ফুল নিয়ে শহীদ মিনারে যাওয়া? শ্রদ্ধাবোধটুকু আসতে হবে সব পর্যায় থেকে। বিটিভি যখন খেলা দেখায়, তখন কেন বাংলা ধারাভাষ্যে নয়? এটা এই দেশের বাংলা ভাষাভাষি মানুষই দেখে?
ঢাকার বাইরে থেকে যারা খেলার ধারাভাষ্যে জড়িয়ে তারা আছেন আরও বিপাকে। জীবনযাত্রায় ব্যয় যখন হু হু করে বাড়ছে তখন বেতারে ধারাভাষ্যের সম্মানীটা যে বলার মতোও নয়। কিংবদন্তি ধারাভাষ্যকার নিখিল রঞ্জন দাস; যিনি চট্টগ্রামে থাকেন। তিনি প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলছিলেন, আমি চট্টগ্রাম আছি, এখানে কমেন্ট্রি করি; এখানে সবচেয়ে বেশি অসুবিধা হলো ট্রান্সপোর্ট। এখানে শহর থেকে স্টেডিয়াম আট-দশ কিলোমিটার। আমি উবারে যাই, আসা-যাওয়া মিলে প্রায় হাজার টাকা দিতে হয়। ওনারা আমাকে যে রেমুনারেশন দেয় সেখানেই অর্ধেক চলে যায়।
অথচ এই দেশেই ইংরেজি ধারাভাষ্যকারদের অর্থের কমতি থাকছে না। স্বাধীনতার আগ থেকে কমেন্টির সঙ্গে জড়িয়ে থাকা নিখিল রঞ্জন দুঃখ নিয়ে বলছিলেন, এখানে যা সম্মানী তাতে আমার ফুল টাইম জব হবে না। এটা আমার হতেও পারে না। ইংরেজিতে সম্ভব, কারণ ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ফ্র্যাঞ্চাইজি থেকে পাচ্ছে, ভালো সম্মানী পাচ্ছে, আমি আপনাকে বলে দিলাম এক হাজার ডলার আর এক হাজার টাকার পার্থক্য।
এই যখন বাংলা আর ইংরেজি ধারাভাষ্যকারদের সম্মানীর ব্যবধান, তখন শহীদ বরকত, জব্বারদের এই দেশে বাংলা ধারাভাষ্যের ভবিষ্যৎ যে বিবর্ণ তা আঁচ করা যাচ্ছেই! বাংলা ধারাভাষ্যে এভাবে পথ হারিয়ে চলতে থাকলে তা কেবলই সোনালি অতীতের স্মৃতি হয়ে থাকবে। যে স্মৃতি সুখ নয়, দুঃখ রাগিণীর সুর শোনাবে।