উৎকোচে বাধা আসায় জুলাই যোদ্ধাদেরও ছাড়ছে না নিটোর চক্র!

  • রুহুল আমিন, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

'টাকা না দিলে কাজই করে না, ৩০০ টাকা দিছি, নিবো না, পরে আবার ১০০ টাকা দিছি তাও নিবো না। ৫০০ টাকা দিয়া ব্যান্ডেজ করছে'।

কথাগুলো বলছিলেন জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতালে ভাইকে ডাক্তার দেখানোর জন্য নিয়ে আসা মুক্তা। তার ভাই সিরাজ। বাড়ি মানিকগঞ্জ। সিরাজের দারিদ্রের ছাপ লেগে আছে চোখে মুখে। দেখেই বুঝা যাচ্ছে অপুষ্টি ও শারীরিক শ্রমে শরীরের মাংসপেশীগুলো চাপ্টে ধরে আছে হাড়গুলোকে। পরনে পুরনো একখান টি-শার্ট ও ট্রাউজার। প্রাকৃতিক কাজ সারতে গিয়ে টয়লেটের কমোডের ভিতর 'পা' পরে ব্যথা পান তিনি।

বিজ্ঞাপন

পায়ের চোট মারাত্মক না হওয়ায় ডাক্তার ১৪ দিন আগে ব্যান্ডেজ করে ওষুধ দিয়ে দেন। তবে পা এখনো পুরোপুরি সেরে না উঠায় আসছিলেন ফলোআপ করতে। ডাক্তার দেখে ব্যান্ডেজ করতে বললে বাধে এমন বিপত্তি। টাকা সরাসরি চায় না তবে টাকা না দিলে কাজও হয় না তাই বাধ্য হয়েই ৫০০ টাকা উৎকোচ দিয়েই তাকে ব্যান্ডেজ করাতে হয়েছে।

মুক্তা বার্তা২৪.কম কে আরও বলেন, এক্সরে রিপোর্ট দ্রুত বের করতে চাইলেও লাগে ৩০০ টাকা। ট্যাকা দিছি সঙ্গে সঙ্গে বের কইরা দিছে, ট্যাকা দিমু না, সারাদিন বসায় রাখবো। ডাক্তার দেখাইতে কোন ট্যাকা লাগে নাই, সিরিয়াল দিতেও লাগে নাই। ১০ ট্যাকায় দাঁড়াইয়া সিরিয়াল কাটছি। তুই তাড়াতাড়ি করতে চাইলে ট্যাকা দিয়ে করা যায়।

বিজ্ঞাপন

এখানে আসা প্রায় প্রত্যেকেরই সামর্থ্য ও প্রত্যাশার মাত্রা সিরাজ ও মুক্তার মতই। কোন দুর্ঘটনা বা দূরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত এসব নিম্ন আয়ের মানুষের শেষ আশ্রয় এই সরকারি হাসপাতাল। যেখানে প্রত্যাশা বলতে কেবল একটু চিকিৎসা, একটু ডাক্তারের আশ্বাস তবে সেখানেও বড় ভোগান্তি হয়ে আসে লম্বা লাইন।

সরেজমিনে দেখা যায়, শত শত মানুষে পরিপূর্ণ হাসপাতালটির বহির্বিভাগে। এমন ভিড় পার হয়ে প্রবেশ করাও কঠিন। হাসপাতালের কোথাও তিল ধারণের ঠাঁই নেই। এখানে আসা বেশিরভাগ রোগীই সড়ক দুর্ঘটনায় আহত। একা হাঁটাচলা করতে পারছেন না কেউই। তাই সঙ্গে নিয়ে এসেছেন স্বজনদের। এতো মানুষের ভিড় ঠেলে, টিকেট কেটে ডাক্তার পর্যন্ত পৌঁছাতে গলদঘর্ম হতে হয় রোগীদের, তারপরও মেলে না কাঙ্ক্ষিত সেবা।

হাসপাতালটি একদিকে যেমন বিপুল রোগীর চাপ সেই সঙ্গে রয়েছে লোকবলের সংকট। এক হাজার শয্যার এই হাসপাতালটিতে রোগী ভর্তির পরিমাণও তাই অধিকাংশ সময়েই থাকে ধারণের চেয়েও বেশি। এই সুযোগে বিভিন্ন পরীক্ষা, স্ট্রেচারে আনা-নেওয়া ও বিভিন্ন সেবাকে কেন্দ্র করে অসহায় রোগীদের কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে কিছু অসাধু কর্মচারী।

এমন বিভিন্ন বাহানায় হাসপাতাল কর্মচারীদের রোগী থেকে টাকা হাতিয়ে নেয়ার পথে বাধা হয়ে দাঁড়ানোই গত সোমবার মারামারির ঘটনা ঘটে বলে অভিযোগ জুলাই গণঅভ্যুত্থানে আহতদের। জুলাই গণঅভ্যুত্থানে আহতদের সঙ্গে হাসপাতাল কর্মচারীদের সংঘর্ষে সেদিন চিকিৎসা বন্ধ থাকে প্রায় ৪ ঘণ্টারও বেশি সময়।

এমন সংঘর্ষের কারণ কি জানতে চাইলে জুলাই যুদ্ধা তানভীর হোসেন বার্তা২৪.কম কে বলেন, এখানে ৫০০ টাকার ব্লাড ৫/৭ হাজার টাকা পর্যন্ত বিক্রি করে। আমাদের কারণে তারা বেশি টাকা নিতে পারে না সেজন্যই ঝামেলা করছে। আমি থেরাপি রুমে আসছি, আমায় আটকে দেছে দালালরা। আমরা যে কারণে জুলাই-আগস্টে রক্ত দিয়েছি সেখানে কিভাবে অন্যায় করতে পারি?

প্রায় একই অভিযোগ করেন মোবারক হোসেন নামের আরেক জুলাই যুদ্ধা। চারতলার এ ওয়ার্ডের আহত এই যুদ্ধা বার্তা২৪.কম কে বলেন, আমরা তো অন্যায়ের বিরুদ্ধেই জুলাই-আগস্টে রক্ত দিয়েছি, এখন আবার সেই একই অন্যায় যদি চোখের সামনে দেখি তাহলে প্রতিবাদ না করে পারি না। আমাদের প্রতিবাদের কারণে হাসপাতালের কিছু স্টাফ ও দালালদের ঘুষ নেয়া বন্ধ হয়ে গেছে তাই তারা পরিকল্পিতভাবে মুখে মাস্ক লাগিয়ে আমাদের ওপর হামলা করে। আমরা এর সুষ্ঠু তদন্ত চাই, এর বিচার চাই।

পাশের বেডে থেকে প্রায় ৬ মাস যাবত চিকিৎসা নিচ্ছেন আরেক জুলাই আহত শাহাদাৎ হোসেন। ভাইকে সাহায্য করতে মাদারীপুরের শিবচরে ব্যবসা রেখে পাশে থাকতে হচ্ছে শাওনকেও।

ঐদিনের ঘটনা বর্ণনা করে শাওন বার্তা২৪.কম কে বলেন, সেদিন একটার দিকে হঠাৎই বিদ্যুৎ চলে যায়। প্রায় ১০ মিনিট আমরা এখানে বিদ্যুৎবিহীন অবস্থায় ছিলাম। এর পরপরই পরিকল্পিতভাবে তাদের ওপর হামলা করা হয়, কিন্তু এই ঘটনায় কেউ এগিয়ে আসেনি। আহতদের উপর যে হামলা হলো সেটা নিয়েও কেউ গুরুত্ব দেয়নি। আমাদের সঙ্গে কেউ এখনো পর্যন্ত যোগাযোগও করেনি।

তবে এর কিছুক্ষণ পরেই জুলাই আহতদের ওপর হামলার ঘটনায় ঘটিত তদন্ত কমিটির সদস্যদের চার তলার বি ওয়ার্ডে ঢুকতে দেখা যায়। এ সময় তারা প্রত্যক্ষদর্শী ও আহতদের সঙ্গে কথা বলেন ও তাদের বক্তব্য শুনেন। বার্তা২৪.কম প্রতিবেদক তদন্ত কমিটির কাছে ঘটনার ব্যাপারে জানতে চাইলে কোন মন্তব্য করতে রাজি হননি। তদন্ত করে নির্দিষ্ট সময়ে তদন্ত রিপোর্ট জমা দেয়ার কথা জানান তারা।

আহতদের সঙ্গে হাসপাতাল স্টাফদের সংঘর্ষ বিষয়ে জানতে চাইলে জতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুর্নবাসন প্রতিষ্ঠানের পরিচালক অধ্যাপক ডা. মো. আবুল কেনান বার্তা২৪.কম কে বলেন, আমরা এইজন্য তদন্ত কমিটি করেছি, এই সমস্ত বিষয় যেগুলো জুলাই যোদ্ধারা বলছে, সেগুলি দীর্ঘদিন যাবত বিভিন্ন হাসপাতালে সমস্যাগুলো আছে, আমি আসার পর নানাভাবে চেষ্টা করতেছি, এইসমস্ত অনিয়মগুলো কিভাবে দূরীভূত করা যায়। তবে একটি জিনিস গুরুত্বপূর্ণ, সবকিছু রাতারাতি সম্ভব হয়ে উঠে না।

নানা অনিয়মের বিষয়ে সরল স্বীকারোক্তি দিয়ে তিনি আরও বলেন, জুলাই যোদ্ধারা স্বপ্রণোদিত হয়ে যে কাজটা (অনিয়মের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ) করতেছে এটাকে আমি খারাপ চোখে দেখি না। আমি মনে করি, আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলো স্বচ্ছতায় আনার জন্য তাদের ভূমিকা প্রশংসিত। আমি জুলাই যুদ্ধাদের বলছি, যদি এমন কিছু পাওয়া যায় তারা যাতে আইন হাতে না নিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে সোপর্দ করে।

বহির্বিভাগের ভোগান্তির প্রশ্নে অধ্যাপক ডা. মো. আবুল কেনান বলেন, বহির্বিভাগে প্রতিদিন ৬০০ থেকে শুরু করে এক হাজার রোগীর অধিক রোগী হয়। সেই ক্ষেত্রে যেদিন একটু রোগীর পরিমাণ বেশি হয় সঙ্গতকারণেই সেদিন সিরিয়ালটা একটু বেশি হয়। আমাদের বহির্বিভাগে অটোমেটিক পদ্ধতিতে টিকিট দেয়া হয়, সেটা অব্যাহত আছে। আমরা চেষ্টা করতেছি যেনো সিরিয়াল কম হয়, সময় কম লাগে।

আগের চেয়ে সময় কমছে তারপরও মাঝেমধ্যে রোগীর সংখ্যা বেড়ে যায়। যেখানে রোগীর সংখ্যা ৬০০ হবার কথা সেটা যদি এক হাজার হয়ে যায় তখন সিরিয়াল বেশি হয়ে যায়। আমরা ডাক্তারদের সকাল সকাল সময়ের মধ্যে বসতে বলতেছি, টিকেট বিক্রেতা যারা আছে তাদেরও বসতে বলতেছি।

বহির্বিভাগে অনলাইনে টিকেট সিস্টেম করার বিষয়ে সুখবর দিয়ে হাসপাতালটির পরিচালক বলেন, অনলাইনে টিকেট কাটায় রোগীর দুর্ভোগটা কম হয়। সেক্ষেত্রে আমরা চিন্তাভাবনা করতেছি, আমরা ২/১ টি কোম্পানির সঙ্গে কথাও বলেছি যেকোন এপস তৈরি করে সেটা চালু করা যায় কি না।