ছেলেকে বিদায় জানাতে এসে চির বিদায় নিলেন বাবা

  • স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, ঢাকা
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

রাজধানীর গুলশান থানার শাহজাদপুরে সৌদিয়া হোটেলে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় চারজন নিহত হয়েছেন। এ ঘটনায় আহত হয়েছেন আরও দুইজন। আহতদের উদ্ধার করে নিকটস্থ হাসপাতালে পাঠানো হয়। তবে আহতদের পরিচয় সম্পর্কে বিস্তারিত কোনো তথ্য পাইনি পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিস। তবে নিহতদের মধ্যে একজনের পরিচয় পাওয়া গেছে। সৌদি আরবে যাওয়ার জন্য ছেলেকে বিদায় দিতে ঢাকায় এসে এই হোটেলটিতে ওঠেন তিনি।

বিজ্ঞাপন

সোমবার (৩ মার্চ) বেলা ২ টায় ঘটনাস্থলে উপস্থিত পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিসের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা যায়।

ঘটনাস্থলের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে এবং মরদেহের সুরতহাল শেষে পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিসের প্রাথমিক ধারণা ভিকটিম চারজন আগুনে সৃষ্ট ধোঁয়ায় দম বন্ধ হয়ে মারা যান।

বিজ্ঞাপন

সরেজমিনে দেখা যায়, যে ভবনটিতে আগুন লাগে সে ভবনটি সার তলা বিশিষ্ট। নিচ তলায় তিনটি দোকান রয়েছে, দুইতলায় মেয়েদের একটি বিউটি পার্লার ও তিনতলা থেকে ছয় তলা পর্যন্ত সৌদিয়া হোটেল। তবে ভবনটির ছয় তলার অর্ধেক হোটেল রুম আর বাকি অর্ধেক ছাদ। ভিতরে দেখা যায় শুধুমাত্র দুই তালায় বিউটি পার্লার আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। এছাড়া ভবনের নিচ তলা আংশিকভাবে আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে তৃতীয় তলা থেকে ছয় তলা পর্যন্ত যেখানে হোটেল অবস্থিত সেখানে আগুনের ক্ষয়ক্ষতির চিহ্ন পাওয়া যায়।

ভবনের নিচ তলায় আছে রুমা ডিজিটাল নামে একটি স্টুডিও। এছাড়া রয়েছে মা ডোর সেন্টার এন্ড ফার্ণিচার ও মুন্নি এন্টারপ্রাইজ নামে দুইটি দোকান ও দ্বিতীয় তলার পার্লারটির নাম গোল্ডেন টিইউলিপ। এরপর তিন তলা থেকে ছয় তলার অর্ধেক পর্যন্ত রয়েছে হোটেল সৌদিয়া।

আরও দেখা যায়, ভবনটির চারতলায় হোটেল রুমের সামনে একটি মরদেহ পড়ে রয়েছে। অন্যদিকে ভবনের ছয় তলার ছাদের সামনের গেটের সামনে বাকি তিনটি মরদেহ পড়ে রয়েছে। ভবনের ভিতরে বিভিন্ন ফ্লোরে কাঁচের ভাঙ্গা টুকরো দেখা যায়। তবে দ্বিতীয় তালার পার্লারটি পুড়ে ছাই হয়ে যায়।

পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিস বলছে, ভবনের চারতলায় যে মরদেহটি পাওয়া যায় সেটি আসলে একটি রুমের বাথরুম থেকে পাওয়া যায়। বাকি তিনটি মরদেহ ছয় তলার ছাদের গেটের সামনে ছিল পরে। তবে গেটটি তালা বন্ধ ছিল।

এ বিষয়ে ডিএমপির গুলশান থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মোখলেছুর রহমান বলেন, ভবনটির চারতলা থেকে একজনের ও ছয় তলার ছাদের গেট থেকে তিনজনের মরদেহ পাওয়া গেছে। মরেদেহগুলো আগুনের তাপে কিছুটা পুড়ে গেছে তবে বাকি শরীর ঠিক ঠাক রয়েছে। আমাদের প্রাথমিক ধারণা এ চার জন আগুনের সৃষ্ট ধোঁয়ায় দম বন্ধ হয়ে মারা গেছেন। আমরা এখন পর্যন্ত একজনের পরিচয় নিশ্চিত করতে পেরেছি। বাকি তিনজনের মরদেহ জানা যায়নি। আমাদের ধারণা এ চারজন হোটেলের গেস্ট ছিলেন।

তিনি আরো বলেন, আমরা ঘটনাস্থলে এসে বিউটি পার্লারের এবং হোটেলের কাউকে পাইনি। আমরা অনেক খোঁজাখুঁজির পরও এই দুই প্রতিষ্ঠানের কোনো কর্তৃপক্ষ বা কর্মচারীকে পাওয়া যায়নি।

ছেলেকে বিদায় জানাতে এসে চির বিদায় নিলেন বাবা

পুলিশ জানিয়েছেন নিহত যে ব্যক্তির পরিচয় জানা গেছে তার নাম মিরন জম্মাদার (৬০)। তার বাড়ি পিরোজপুর জেলায়। তিনি আজ সকাল আটটায় হোটেলটিতে উঠেন।

নিহতর আত্মীয়স্বজনদের সাথে কথা বলে জানা যায়, মিরনের ছেলে মুবিন জমাদ্দার আগামীকাল সন্ধ্যার একটি ফ্লাইটে পড়ে সৌদি আরবে যাওয়ার কথা রয়েছে। মুবিন হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কাছাকাছি এলাকায় একটি হোটেলে উঠেছেন। আর বাবা মিরন বিমানবন্দরে যেতে যাতে সুবিধা হয় তাই নতুন বাজারের পরে শাহজাদপুরের এই হোটেলটিতে ওঠেন। নিহত মিরন আজ তার বোনের স্বামী হিরন তালুকদারের সঙ্গে পিরোজপুর থেকে ঢাকায় আসেন। ঢাকায় এসে তিনি সকাল আটটায় হোটেলটিতে ওঠেন। হোটেলে ওঠার পর তিনি আবার বাহিরে বের হয়ে নাস্তা করেন একটি দোকানে। নাস্তা শেষে হোটেলে যান বিশ্রাম নিতে। এরই মধ্যে লাগে এই ভয়াবহ আগুন। আগুন লাগার পর কোথাও বের হতে না পেরে জীবন বাঁচানোর জন্য ফোন দেন বোনের স্বামী হিরনকে। হিরন কে ফোন দিয়ে কাঁদতে কাঁদতে মিলন বলেন আমি বাঁচার কোন পথ পাচ্ছি না চারদিকে ধোঁয়া দম বন্ধ হয়ে আসছে। এই কথা বলার পরে ফোন কেটে যায় মিলনের। পরে ফায়ার সার্ভিস আগুন নিয়ন্ত্রণের পর মিলনের মরদেহ চারতলা থেকে উদ্ধার করে।

নিহতের বোনের স্বামী হিরন তালুকদার বলেন, আমরা সকালে এসে হোটেলটিতে উঠি‌। মিরন জমাদ্দারের ছেলে মুনিব জমাদ্দার আগামী সন্ধ্যার ফ্লাইটে কাল সৌদি আরবে যাবে। তাকে বিদায় দিতে আমরা আজ সকালে ঢাকা আসি। আসার পর মিরন হোটেলের পাশে একটি রেস্টুরেন্ট থেকে নাস্তা করে হোটেলে যান এবং আমাকে বলেন আপনি নাস্তা করে আসেন আমি একটু রেস্ট নেই। এর কিছুক্ষণ পরে আগুন দেখে হোটেলের নিচে দৌড়ে আসে। এসে দেখি সারা হোটেল আগুনে ধোঁয়ছন্ন। তখনই মিরন আমাকে ফোন দিয়ে বলে চারদিকে ধোঁয়া উনি কোথাও যাওয়ার জায়গা পাচ্ছেন না। এসময় তখন তিনি কান্না করছেন। তিনি হোটেলের চারতলার রুমে ছিলেন। রুম নাম্বার ৪০২ নাম্বার।

আগুনের সূত্রপাত নিয়ে যা বলছে প্রত্যক্ষদর্শীরা

এদিকে প্রত্যক্ষদর্শী ও ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা বলছেন, আগুনের সূত্রপাত ঘটে দ্বিতীয় তলার বিউটি পার্লার থেকে। পরে বিউটি পার্লার থেকে আগুন বাড়তে থাকে আর প্রচন্ড ধোঁয়ার সৃষ্টি হয়।

এ বিষয়ে ভবনটির নিচ তলার মা ডোর সেন্টার এন্ড ফার্ণিচারের মালিক ফারুক হোসেন বলেন, আগুন লাগে ১২টা ১৫ মিনিটের দিকে। আগুন লাগার সঙ্গে সঙ্গে দোকানের ক্যাশ বক্স নিয়ে বের হয়ে যাই। আল্লাহর রহমতে আমার দোকানে তেমন ক্ষতি হয় নাই। তবে জানতে পেরেছি দুই তালার বিউটি পার্লার থেকে আগুনটা সৃষ্টি হয়। সেখানে এসি থেকে আগুনের সূত্রপাত ঘটেছে। এরপর ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা আসেন আগুন নিয়ন্ত্রণে আনেন। কিন্তু আগুনে প্রচন্ড ধোঁয়া সৃষ্টি হয় যা উপরের দিকে চলে যায়।

পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিসের ধারণা, চারতলার বাথরুমে যে মরদহটি পাওয়া যায় সেই ব্যক্তি হয়তো জীবন বাঁচাতে বাথরুমের ভিতরে আশ্রয় নিয়েছিল নয়তবা বাথরুমের ভিতরে ছিল। তিনি আগুনে সৃষ্ট ধোঁয়ার কারণে দম বন্ধ হয়ে মারা যান। আর বাকি তিনজন জীবন বাঁচাতে ছাদে যেতে চেয়েছিলেন কিন্তু ছাদ বন্ধ থাকায় তারা আর যেতে পারেনি সেখানেই ধোঁয়ার কারণে দম বন্ধ হয়ে মারা যান।

একই ভবনে পূর্বেও লেগেছিল আগুন, ছিল না কোনো নিরাপত্তা ব্যবস্থা

প্রত্যক্ষদর্শীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ভবনটিতে ছয় সাত মাস আগে আবারও একবার আগুন লেগেছিল। তখন কোনো প্রাণহানি না ঘটলেও আগুনে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল ভবনটিতে।

স্থানীয় বাসিন্দা মুন্না রহমান বলেন, এই ভবনটিতে ৬-৭ মাস আগেও একবার আগুন লেগেছিল। এই ভবনটির অবস্থা খুব খারাপ। এখানে এমন চিপা সিঁড়ি যে আগুন লাগলে দ্রুত বের হয়ে প্রাণ বাঁচানোর কোনো ব্যবস্থাও নাই।

এদিকে ভবনটিকে সরেজমিনে দেখে ও ফায়ার সার্ভিসের কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ভবনটিতে কো্নো ধরনের অগ্নি নির্বাপন ব্যবস্থা ছিল না। ভবনটিকে মডিফাই করে হোটেল ভাড়া দেওয়া হয়। ‌ এছাড়া নিচতলায় ও দ্বিতীয় তলায় চারটি প্রতিষ্ঠানকে ভাড়া দেওয়া হয়। ভবনটির সিঁড়ি একদম ছোট এবং চাপাচাপি। দুজন মানুষ একসঙ্গে এই সিঁড়ি দিয়ে উঠানামা করতে পারবেন না। এছাড়া ভবনে কোনো ধরনের ফায়ার এক্সিট ছিল না, দেখা যায়নি ‌কোনো ফ্লোরে অগ্নি নির্বাপন ব্যবস্থা।

উল্লেখ্য সোমবার দুপুরে আগুন লাগার সংবাদ পায় ফায়ার সার্ভিস। বিষয়টি নিশ্চিত করে সার্ভিসের মিডিয়া সেলের কর্মকর্তা তালহা বিন জসিম বলেন, বেলা ১২ টা ১৭ মিনিটের দিকে আমাদের কাছে সংবাদ আসে রাজধানীর ভাটারা থানাধীন শাহজাদপুরে সৌদিয়া হোটেলে আগুনের ঘটনার। পরে আমাদের দুইটি ইউনিট প্রায় আধা ঘন্টা কাজ করে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে।

তিনি বলেন, হোটেল ভবনটি ছয়তলা ছিল কিন্তু আগুন লাগে দুই তালায়। আগুন নিয়ন্ত্রণের পর আমাদের তল্লাশি দল হোটেলের ভিতরে চারজনের মরদেহ পায়। নিহতরা সবাই পুরুষ । প্রাথমিকভাবে তাদের নাম পরিচয় পাওয়া যায়নি।