নিরবতা ভেঙে চরমপন্থীদের উত্থান, ঝিনাইদহে ফের ৩ হত্যা

  • এম বুরহান উদ্দীন, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, ঝিনাইদহ
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

দীর্ঘ ২২ বছর পর একই স্থানে একসঙ্গে একাধিক ব্যক্তিকে হত্যার ঘটনায় আতঙ্ক আবারও দানা বাঁধছে ঝিনাইদহে। আবারও অশান্ত হয়ে ওঠার শঙ্কা দেখা দিয়েছে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের এক সময়কার চরমপন্থী অধ্যুষিত জেলা ঝিনাইদহ। ২২ বছর আগে ফাইভ মার্ডারের পর আবারও ট্রিপল মার্ডারের ঘটনা ঘটল একই স্থানে। এতে এখানকার বাসিন্দারা বলছেন, দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা না নিলে নতুন করে আবারও মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে চরমপন্থী সংগঠনগুলো।

শুক্রবার (২১ ফেব্রুয়ারি) রাত ৮ টা থেকে ১১টার দিকে শৈলকূপা উপজেলার রামচন্দ্রপুর গ্রামের শ্মশান ঘাট এলাকায় ৩ চরমপন্থী সন্ত্রাসীকে গুলি করে হত্যার ঘটনা ঘটেছে।

বিজ্ঞাপন

নিহতদের পরিচয় 

ঘটনায় নিহতদের পরিচয় শনাক্ত করেছে পুলিশ। তারা হলেন- হানেফ আলী (৫৬) ঝিনাইদহের হরিণাকুণ্ডু উপজেলার আহাদনগর গ্রামের রাহাজ উদ্দীনের ছেলে, তার শ্যালক লিটন (৩৫) শ্রীরামপুর গ্রামের উন্মাদ আলীর ছেলে ও কুষ্টিয়া দৌলতপুর এলাকার আরজেদ আলীর পুত্র রাইসুল ইসলাম রাজু (২৫)। এদের মধ্যে হানেফ আলী নিষিদ্ধ চরমপন্থী সংগঠন পূর্ববাংলা কমিউনিস্ট পার্টির (জনযুদ্ধ) আঞ্চলিক কমান্ডার। নিহত চরমপন্থী নেতা হানিফের বিরুদ্ধে কমপক্ষে ১৩টি হত্যাসহ বিভিন্ন মামলা রয়েছে।

বিজ্ঞাপন

যে তিনজনকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে তারা সবাই চরমপন্থী দলের এক সময়ের নেতাকর্মী। এদের মধ্যে হানেফ আলী একটি মামলায় মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্ত আসামি ছিলেন। অপর দুই জনের একজন হানেফ আলীর শ্যালক লিটন হোসেন অপরজন হানেফ আলীর আরেক সহযোগী রাইসুল ইসলাম রাজু।

খুদে বার্তায় ‘দায় স্বীকার’

তিনজনকে হত্যার দায় স্বীকার করে জাসদ গণবাহিনীর কালু পরিচয় দিয়ে ঝিনাইদহের স্থানীয় সাংবাদিকদের কাছে শুক্রবার রাতে যে মেসেজ পাঠানো হয়েছে সেখানে উল্লেখ করা হয়েছে, হয় ‘এতদ্দ্বারা ঝিনাইদহ, চুয়াডাঙ্গা, মাগুরা, কুষ্টিয়া, যশোর ও খুলনাবাসীর উদ্দেশে জানানো যাইতেছে যে, পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট পার্টি নামধারী কুখ্যাত ডাকাত বাহিনীর শীর্ষ নেতা অসংখ্য খুন, গুম, দখলদারি, ডাকাতি, ধর্ষণের অভিযোগে অভিযুক্ত হরিনাকুন্ডু নিবাসী মো. হানিফ তার দুই সহযোগীসহ জাসদ গণবাহিনীর সদস্যদের হাতে নিহত হয়েছেন। তাদের লাশ রামচন্দ্রপুর ও পিয়ারপুর ক্যানালের পাশে রাখা আছে। অত্র অঞ্চলের হানিফের সহযোগীদের শুধরে যাওয়ার নির্দেশ দেয়া হলো অন্যথায় আপনাদের একই পরিণতির মুখোমুখি হতে হবে। কালু জাসদ গণবাহিনী।’ তবে ক্ষুদেবার্তাটির প্রেরক সত্যিকারের কালু কিনা তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। পুলিশের পক্ষ থেকে বিষয়টি নিয়ে তদন্ত হচ্ছে বলেও জানানো হয়েছে।

ঘটনা সম্পর্কে যা বলছে পুলিশ ও এলাকাবাসী

রামচন্দ্রপুর এলাকার স্থানীয় বাসিন্দা আমিরুল ইসলাম জানান, রাতে ৮টার পরে তারা মাঠের দিকে বেশ কয়েকটি গুলির শব্দ শুনতে পান। তবে ভয়ে আর কেউ ঘর থেকে বের হননি। পুরো এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। কিছু সময় পর রাত সাড়ে ১১ টার দিকে এলাকাবাসী একত্রিত হয়ে ঘটনাস্থলে গিয়ে তিনটি মরদেহ ও দুইটি মোটরসাইকেল পড়ে থাকতে দেখেন। এরপর তারা পুলিশে খবর দেন।

পুলিশ ও এলাকাবাসী জানায়, দীর্ঘদিন ধরে কুষ্টিয়া, ঝিনাইদহ ও চুয়াডাঙ্গা আধিপত্য বিস্তার নিয়ে পূর্ববাংলা কমিউনিস্ট পার্টির (জনযুদ্ধ) ও জাসদ গণবাহিনী নামে দুইটি চরমপন্থী দলের মধ্যে বিরোধ চলে আসছে। শুক্রবার রাতে রামচন্দ্রপুর শ্মশানঘাট এলাকায় পূর্ববাংলা কমিউনিস্ট পার্টির নেতাদের গোপন বৈঠকের খবর পেয়ে যায় প্রতিপক্ষরা। জাসদ গণবাহিনীর শীর্ষ নেতা কালুর নেতৃত্বে এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে বলে ধারণা করছেন পুলিশ ও স্থানীয়রা।

শৈলকূপা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মাসুম খান বলেন, ‘সোর্সের মাধ্যমে খবর পাই, গোলাগুলির ঘটনা ঘটেছে। এরপর নিশ্চিত হওয়া যায় ঘটনাস্থলে তিনজনের মরদেহ পড়ে আছে। লাশ উদ্ধার করে রাতেই থানায় আনা হয়েছে।’

চরমপন্থী হানিফ আলীকে নিয়ে যা জানা গেছে

প্রায় ৫৫ বছর বয়সী হানিফ আলী, তার বাড়ি ঝিনাইদহের হরিণাকুণ্ডু উপজেলার আহাদনগর গ্রামে, পিতার নাম রাহাজ উদ্দিন। হানিফ আলী বলেন-পশ্চিমাঞ্চলের শীর্ষ চরমপন্থী সংগঠন পূর্ববাংলা কমিউনিস্ট পার্টি জনযুদ্ধ (লাল পতাকার) আঞ্চলিক কমান্ডার। ৯০ এর দশকে হত্যা ও ডাকাতির মাধ্যমে এলাকায় অপরাধজগতে একক আধিপত্য বিস্তার করে। হানিফের নামে হরিণাকুণ্ডু, ঝিনাইদহ সদর, চুয়াডাঙ্গা, আলমডাঙ্গাসহ দেশের বিভিন্ন থানায় ১৪টি হত্যা, অপহরণ ও ডাকাতির মামলা আছে। গত ৭-৮ বছর ধরে হরিণাকুণ্ডর নারায়নকান্দি কায়েতপাড়া বাঁওড় দখল করে মৎস্য চাষ করে আসছিল। ২০১৪ সালে জেল থেকে বের হয় হানিফ। পরে ২০১৮ সালে ওই বাওড়ের মৎস্যজীবী সমিতির সভাপতি জিয়াউর রহমান জিয়া করে জবাই করে হত্যা করে বাঁওড়ের দখল নেয় হানিফ। সম্প্রতি বাঁওড় দখলকে কেন্দ্র করে এলাকার কয়েকটি নিষিদ্ধ চরমপন্থী সংগঠনের মধ্যে বিরোধ চলে আসছিল। এ কারণেই প্রতিপক্ষ জাসদ গণবাহিনী তাকে হত্যা করেছে বলে ধারণা এলাকাবাসীর। আর ওইসব মামলার মধ্যে উপজেলার কুলবাড়িয়া গ্রামের আব্দুর রহমান নামে এক ব্যক্তিকে হত্যার,অপরাধে তার বিরুদ্ধে ফাঁসির আদেশ হয়েছিল। ওই ব্যক্তিকে গলা কেটে হত্যা করে মাথা নিয়ে ফুটবল খেলেছিল বলে এলাকায় জনশ্রুতি রয়েছে। চরমপন্থী হানিফের এক ভাই হরিণাকুণ্ডু উপজেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি ও আরেক ভাই উপজেলা পরিষদের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান ও উপজেলা সেচ্ছাসেবক লীগের বর্তমান সহ-সভাপতি। হানিফ নিজে হরিণাকুণ্ডু উপজেলা মৎস্যজীবী লীগের সিনিয়র সহসভাপতি ছিলেন ।

হানিফের ভাই সাজেদুল ইসলাম ইশা বলেন, ‘গতকাল (শুক্রবার) বিকেলে হানিফের মোবাইল ফোনে একটি কল আসে। এরপর ভাই বাড়ি থেকে বের হয়ে যায়। সন্ধ্যা থেকে তার মোবাইল ফোনে কল দিলেও ধরেননি। পরে রাতে তার মৃতদেহ পাই।’

ভাগনে নিহতের খবর পেয়ে শৈলকূপা থানায় আসা রাইসুল ইসলামের মামা মোহাম্মদ মিল্টন বলেন, ‘লেখাপড়া শেষ করে রাইসুল চাকরি নেওয়ার চেষ্টা করছিল। কুষ্টিয়ার এক সংসদ সদস্যের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতা ছিল। তবে ঠিক কী কারণে তাকে হত্যা করা হয়েছে, তা জানতে পারিনি।’ মোহাম্মদ মিল্টন আরও বলেন, ‘রাইসুল পিয়ারপুর এলাকার নানাবাড়ি থেকে শুক্রবার বিকেল ৫টার দিকে বের হয়ে যায়। সন্ধ্যা থেকে তার মোবাইল ফোনে কল দিয়ে পাওয়া যাচ্ছিল না। পরে রাতে জানতে পেলাম, রাইসুল গুলিতে নিহত হয়েছে।’

এই গ্রামে আগেও ঘটেছিলো হত্যাকাণ্ড

স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছেন, একই স্থানে ২০০৩ সালের ৫ ডিসেম্বর ৫ জনকে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা। তারা হলেন, শৈলকূপা উপজেলার শেখপাড়া গ্রামের শহীদ খা, ত্রিবেনী গ্রামের শাহনেওয়াজ, একই গ্রামের ফারুক, নুরু কানা ও কুষ্টিয়ার ভবানীপুর গ্রামের কটাকে গুলি ও জবাই করে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা।

এই মামলায় ২০২৪ সালের ২৯ অক্টোবর ঝিনাইদহ জেলা জজ আদালতে কুষ্টিয়ার আলী রেজা ওরফে কালু ও জেলার পিয়ারপুর গ্রামের মহসিন আলীকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন। এই অঞ্চলে এক সময় ‘শ্রেণিশত্রু খতম’ করার নামে চরমপন্থী পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি জনযুদ্ধ, লাল পতাকা, জাসদ, এমএল, কমিউনিস্ট পার্টির হক গ্রুপ ভিন্ন ভিন্ন গ্রুপে ভাগ হয়ে একে অন্যকে হত্যা করত। ওই হত্যার পর দায় স্বীকার করে বিবৃতি দিয়েছিলেন চরমপন্থীরা।

সর্বশেষ পরিস্থিতি

নিহতদের মরদেহ শৈলকূপা থানায় রাখার খবর জানতে পেরে শনিবার ভোর থেকে শতশত মানুষ ভিড় করছে থানায়। মরদেহগুলো ময়নাতদন্তের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে পুলিশ । তবে চাঞ্চল্যকর এই ট্রিপল মার্ডারের ঘটনায় এখনো কোনো মামলা হয়নি। নিহতের স্বজনদের দেখা যায়নি মরদেহগুলির কাছে। চাঞ্চল্যকর এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় পুলিশ এখনো আনুষ্ঠানিক বক্তব্য দেয়নি তবে সংবাদ সম্মেলন করে জানানো হবে বলে পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে।