বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে সাবেক সরকার পতনের পর সাধারণ জনতার তোপের মুখে পড়ে দেশের সব পর্যায়ের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। বিভিন্ন থানায় চালানো হয় হামলা, ধরিয়ে দেওয়া হয় আগুন, পুড়িয়ে দেওয়া হয় থানা। এই হামলার ফাঁকেই থানার বিভিন্ন আগ্নেয়াস্ত্র ও গোলাবারুদসহ সবকিছু লুটপাট চালায় এক শ্রেণির অপরাধী চক্র।
পুলিশ সদর দফতরের সূত্র মতে, দেশেরে বিভিন্ন থানা থেকে ৫ হাজার ৭৫০টি আগ্নেয়াস্ত্র ও ৬ লাখ ৫১ হাজার ৬০৯টি গোলাবারুদ লুট হয়। এরপর দেশের উচ্চ পর্যায় থেকে সময় নির্ধারণ করে দিয়ে লুট হওয়া অস্ত্র জমা দেওয়ার আহ্বান জানানো হলেও সেই আহ্বানে তেমন সারা মেলে না। পরে লুট হওয়া আগ্নেয়াস্ত্র-গোলাবারুদ উদ্ধারে অভিযান শুরু করে যৌথ বাহিনী। অভিযানে বিভিন্ন সময়ে অস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধার হলেও এখনও ১,৩৯২টি আগ্নেয়াস্ত্রসহ ২ লাখ ৬০ হাজার গোলাবারুদ উদ্ধার করতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
আর এই বেহাত অস্ত্র দিয়েই এখন অপরাধ জগতের নিয়ন্ত্রণ ও খুনের খেলায় মেতে উঠেছে অপরাধী চক্রের সদস্যরা।
এছাড়াও কারা অধিদফতর সূত্র জানায়, গত বছরে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময় দেশের বিভিন্ন কারাগার থেকে ২ হাজার ২০০ আসামি পালিয়ে যান। তাদের মধ্যে ১ হাজার ৫০০ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এখনো ৭০০ আসামি পলাতক। তাদের মধ্যে ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্তসহ অতিঝুঁকিপূর্ণ ৭০ জন আসামি রয়েছেন।
চলতি বছরের জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে পুলিশ চট্টগ্রাম শহরে দুটি অভিযান চালিয়ে অস্ত্র, গুলিসহ ছয় ব্যক্তিকে গ্রেফতার করে। এসব অস্ত্র, গুলিগুলো সব চট্টগ্রামের ডবলমুরিং থানা থেকে লুট করা বলে জিজ্ঞাসাবাদে পুলিশ জানতে পারে।
এর আগে গত বছরের ২৯ আগস্ট বায়েজিদ বোস্তামী এলাকায় মো. আনিছ নামের এক ব্যবসায়ীকে গুলি করে হত্যা করা হয়। ঘটনাস্থল থেকে পুলিশ পাঁচটি গুলির খোসা ও অস্ত্র বহনের একটি ব্যাগ আলামত জব্দ করে। উদ্ধার করা গুলির খোসায় পুলিশ লেখা রয়েছে বলেও জানায় পুলিশ।
গত বছরের ১৪ নভেম্বর গোপন তথ্যের ভিত্তিতে কোস্টগার্ড সদস্যরা কক্সবাজারের মহেশখালী উপজেলার কালারমারছড়া ইউনিয়নের মোহাম্মদ শাহ ঘোনা এলাকায় অভিযান চালিয়ে একটি পিস্তলসহ জিয়াউর রহমান নামের একজনকে গ্রেফতার করেন।
জিজ্ঞাসাবাদে জিয়াউর পুলিশকে বলেন, তিনি ডাকাত সরদার। এর আগে তিনি অস্ত্রসহ আত্মসমর্পণ করলেও চট্টগ্রামে পুলিশের স্থাপনা থেকে পিস্তল লুট করে আবার ডাকাতি করছেন।
এছাড়াও চট্টগ্রামে পুলিশের স্থাপনা থেকে লুট করা পিস্তল দিয়ে ডাকাতির অপরাধে জিয়াউর রহমানকেও গ্রেফতার করা হয়। মুন্সিগঞ্জের শ্রীনগর উপজেলার দোগাছি এলাকায় ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ের সার্ভিসলেন থেকে শাহিদা আক্তার (২২) নামের এক তরুণীর গুলিবিদ্ধ লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। এই ঘটনায় শাহিদার কথিত বন্ধু তৌহিদ শেখ ওরফে তন্ময়কে গ্রেফতার করা হয়। তার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে হত্যায় ব্যবহৃত পিস্তলটি উদ্ধার করা হয়। পিস্তলটি ঢাকার ওয়ারী থানা থেকে লুট করা বলেও জানাযায়।
এছাড়াও রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে একই ধরনের লুট হওয়া অস্ত্র দিয়ে খুন, ডাকাতিসহ আধিপত্য বিস্তারে গোলাগুলি এখন নিত্য দিনের ঘটনায় পরিণত হয়েছে।
পুলিশ সদর দফতর সূত্র জানায়, দেশের বিভিন্ন থানা স্থাপনা থেকে ৫ হাজার ৭৫০টি আগ্নেয়াস্ত্র ও ৬ লাখ ৫১ হাজার ৬০৯টি গোলাবারুদ লুট হয়। লুট হওয়া আগ্নেয়াস্ত্র-গোলাবারুদের মধ্যে আছে বিভিন্ন ধরনের রাইফেল, এসএমজি (স্মল মেশিনগান), এলএমজি (লাইট মেশিনগান), পিস্তল, শটগান, গ্যাসগান, কাঁদানে গ্যাস লঞ্চার, কাঁদানে গ্যাসের শেল, কাঁদানে গ্যাসের স্প্রে, সাউন্ড গ্রেনেড ও বিভিন্ন বোরের গুলি।
লুট হওয়া আগ্নেয়াস্ত্র-গোলাবারুদ উদ্ধারে গত বছরের ৪ সেপ্টেম্বর যৌথ অভিযান শুরু হয়। পুলিশ সদর দফতর বলছে, এ অভিযানে গত ১৬ জানুয়ারি পর্যন্ত ৪ হাজার ৩৫৮টি আগ্নেয়াস্ত্র ও ৩ লাখ ৯১ হাজার ৪৩৮টি গোলাবারুদ উদ্ধার করা হয়। তবে এখনো ১ হাজার ৩৯২টি আগ্নেয়াস্ত্র ও ২ লাখ ৬০ হাজার ৫৩১টি গোলাবারুদ উদ্ধার হয়নি।
এ বিষয়ে পুলিশ সদর দফতরের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশনস) মো. আকরাম হোসেন গণমাধ্যমকে বলেন, পুলিশের লুট হওয়া অস্ত্রের বেশির ভাগ উদ্ধার হয়েছে। পুলিশের খোয়া যাওয়া কিছু অস্ত্র আবার খাল–বিলে ফেলে দেওয়া হয়েছে। বাকি অস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধারে অভিযান চলছে। লুট করা অস্ত্র নিয়ে কেউ যাতে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটাতে না পারে, সে ব্যাপারে পুলিশ তৎপর রয়েছে।
ঝুঁকিপূর্ণ ও অতিঝুঁকিপূর্ণ জেল পালানো আসামিদের বিষয়ে কারা অধিদফতরের মহাপরিদর্শক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সৈয়দ মো. মোতাহের হোসেন গণমাধ্যমকে বলেন, জেল পলাতক ৭০০ আসামিকে এখনো গ্রেফতার করা যায়নি। তাদের মধ্যে ১০০ জন নিরাপত্তার জন্য হুমকি বলে মনে করা হচ্ছে। তবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানে দু-একজন করে ধরা পড়ছেন।
মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগের অধ্যাপক ও ডিন অধ্যাপক মুহাম্মদ উমর ফারুক বলেন, পুলিশের লুট হওয়া অস্ত্র ও গোলাবারুদ এখন ছিনতাই-ডাকাতিতে ব্যবহার করা হচ্ছে। যৌথ বাহিনী অস্ত্র উদ্ধারে বিশেষ মনোযোগ না দিলে জননিরাপত্তা, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় শৃঙ্খলা হুমকির মুখে পড়বে।