রমজান মাসে এশার পর বিতরের আগে যে নামাজ পড়া হয়, সেটাই হলো- তারাবির নামাজ। এই নামাজ নারী-পুরুষ সবার জন্য সুন্নত। নবী কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিয়মিত তারাবির নামাজ পড়েছেন এবং অন্যদেরকে উৎসাহ দিয়েছেন। তার ইন্তেকালের পর সাহাবা-তাবেইনও গুরুত্বের সঙ্গে তারাবির নামাজ আদায় করেছেন।
তারাবির নামাজ রমজানুল মোবারকের অন্যতম নিদর্শন বা প্রতীক। মুসলিমদের হৃদয়ে রয়েছে তারাবির অনেক মর্যাদা ও মহত্ত্ব এবং আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের নিকটও আছে এর বিশেষ সম্মান ও শ্রেষ্ঠত্ব। হাদিস শরিফে এসেছে, নবী কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি ঈমানের সঙ্গে সওয়াবের আশায় রমজানের রাতে ইবাদত করবে তার অতীতের গোনাহ মাফ করে দেওয়া হবে।’ -সহিহ বোখারি: ৩৭
হাদিসটির উদ্দেশ্য হচ্ছে, যে ব্যক্তি আল্লাহর প্রতি ঈমান রেখে এবং আল্লাহর দরবারে আজর (প্রতিদান) ও সওয়াবের আশা পোষণ করে রমজানের রাতে নামাজ, জিকির, তেলাওয়াত ইত্যাদি ইবাদতের মধ্যে মশগুল থাকবে, আল্লাহ তার পেছনের যাবতীয় সগিরা গুনাহ মাফ করে দেবেন। অন্য কবিরার ক্ষমার জন্য খালেস নিয়তে তওবা করতে হবে। অনেক আলেম এ বিষয়ে স্পষ্ট মতামত ব্যক্ত করেছেন।
তারাবির নামাজ সুন্নতে মোয়াক্কাদা। সর্বপ্রথম রাসূলে কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই নামাজ চালু করেন। বিষয়টি একাধিক হাদিসে বিবৃত হয়েছে।
হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, হজরত রাসূলে কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমজানের কিয়াম তথা রাতের বেলা ইবাদত-বন্দেগির উৎসাহ দিতেন। কিন্তু দৃঢ়তার সঙ্গে নির্দেশ দিতেন না। তিনি বলতেন, যে ব্যক্তি ঈমানের সঙ্গে সওয়াবের আশায় রমজানের রাতে ইবাদত করবে তার অতীতের গোনাহ মাফ করে দেওয়া হবে। -সহিহ মুসলিম: ৭৫৯
হজরত রাসূলে কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তারাবির নামাজ প্রথম পড়েছেন। এরপরও বলা হয়, হজরত উমর (রা.) তারাবির নামাজ চালু করেছেন। এর কারণ হলো, তিনি সর্বপ্রথম হজরত উবাই ইবনে কাব (রা.)-এর পেছনে জামাতের ব্যবস্থা করেছেন। তার নির্দেশে উবাই ইবনে কাব (রা.) লোকদের নিয়ে তারাবির জামাত শুরু করেছেন। হজরত আবদুর রহমান ইবনে আবদুল কারি (রহ.) বলেন, রমজানের এক রাতে হজরত উমর (রা.)-এর সঙ্গে বের হলাম। দেখি, লোকজন বিক্ষিপ্তভাবে ছোট ছোট জামাত করে নামাজ পড়ছে। কেউ একা একা পড়ছে আর কেউ ইমামতি করছে, কিছু লোক তার ইক্তিদা করছে। হজরত উমর (রা.) বললেন, মনে হচ্ছে, সবাইকে যদি এক ইমামের পেছনে জমা করিয়ে দিই তাহলে ভালো হবে। এরপর এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে নেন এবং সবাইকে উবাই ইবনে কাব (রা.)-এর পেছনে দাঁড় করিয়ে দেন।
আরেক রাতে তার সঙ্গে বের হলাম। লোকজন উবাই ইবনে কাব (রা.)-এর পেছনে জামাতের সঙ্গে নামাজ পড়ছেন। হজরত উমর (রা.) তখন বললেন, এটা উত্তম বিদআত।
সাহাবায়ে কেরাম রাতের প্রথমাংশে (তারাবির) নামাজ পড়তেন। হজরত উমর (রা.) বললেন, এই নামাজ থেকে ওই নামাজ উত্তম, যার সময় তারা ঘুমিয়ে থাকে। অর্থাৎ শেষ রাতের নামাজ। -সহিহ বোখারি: ২০১০
এসব হাদিস থেকে স্পষ্ট বুঝে আসে যে, সর্বপ্রথম তারাবির নামাজ পড়েছেন রাসূলে কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। তিনি সাহাবিদের নিয়ে তিন বা চার রাতে তারাবির জামাত করেছেন। এরপর তাদের প্রতি দয়াপরবশ হয়ে আর জামাত করেননি। কেননা, তিনি আশঙ্কা করেছেন, তিনি নিয়মিত জামাতের সঙ্গে তারাবির নামাজ পড়লে তারাবির নামাজ ফরজ হয়ে যেতে পারে। ফলে নিয়মিত আদায় করতে না পারলে কবিরা গুনাহ হবে।
তারাবির রাকাত-সংখ্যা
তারাবির নামায সুন্নতে মোয়াক্কাদা। এর রাকাত সংখ্যা বিশ এবং বিতিরসহ তেইশ। মুসলিম উম্মাহর আমল এভাবেই চলে আসছে। ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হজরত উমর ইবনে খাত্তাব (রা.)-এর যুগ থেকে পূর্বসূরী ও উত্তরসূরী সব মুসলিম এ বিষয়ে একমত। চার মাজহাবের কোনো ইমাম এতে দ্বিমত পোষণ করেননি। হ্যাঁ, মদিনার মুজতাহিদ ইমাম মালেক (রহ.) থেকে এক বর্ণনা আছে যে, তারাবির নামাজ ছত্রিশ রাকাত। এ মতের পক্ষে তার দলিল হলো, তখনকার মদিনাবাসীর আমল। নাফে (রহ.) থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, তিনি বলেছেন, আমি মদিনার লোকদের দেখেছি, তারা রমজানে (ছত্রিশ রাকাত তারাবি ও তিন রাকাত বিতর মিলে মোট) ঊনচল্লিশ রাকাত নামাজ পড়েন। -মুখতাসারু কিয়ামিল লাইল: ২০১
তবে, ইমাম মালেক (রহ.) থেকে প্রসিদ্ধ বর্ণনা শাফেঈ, হাম্বলি ও হানাফি মাজহাবের মতোই। অর্থাৎ তারাবির নামাজ বিশ রাকাত। সুতরাং বিশ রাকাতের ওপর চার মাজহাবের ইমামরা একমত এবং এর ওপর ইজমা প্রতিষ্ঠিত।