দেশের পার্বত্য এলাকার অনসোর ব্লকের গ্যাসের জন্য পিএসসির (উৎপাদন ও সরবরাহ চুক্তি) খসড়া চূড়ান্ত করে এনেছে পেট্রোবাংলা। এতে প্রতি হাজার ঘনফুট গ্যাসের দাম ৮ ডলারের মতো পড়তে পারে বলে ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। যা
আমদানিকৃত এলএনজির দরের চেয়ে মাত্র ২ ডলারের মতো কম। আর বহুজাতিক কোম্পানির (শেভরন ও টাল্লো) সঙ্গে ইতিপূর্বে সম্পাদিত চুক্তির আওতায় যে দরে গ্যাস পাওয়া যাচ্ছে তার চেয়ে প্রায় ৫ ডলার বেশি।
শেভরন বাংলাদেশকে প্রতি হাজার ঘনফুট গ্যাসের দাম দেওয়া হয় ২.৭৬ ডলার, আর টাল্লোর সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী এই গ্যাস মিলছে ২.৩১ ডলারের মতো দরে।
বহুজাতিক কোম্পানির পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় ৩টি কোম্পানির কাজ থেকে গ্যাস কেনে পেট্রোবাংলা। সিলেট গ্যাস ফিল্ড কেম্পানি ও বাংলাদেশ গ্যাস ফিল্ড কোম্পানিকে প্রতি হাজার ঘনফুটের দাম দেওয়া হয় ২৮ টাকার মতো, যা ডলারের হিসেবে মাত্র ২৫ সেন্ট। আর বাপেক্সকে দেওয়া হয় ১১২ টাকার মতো, বা ১ ডলারের কাছাকাছি ।
একটি হিসাব দেখাচ্ছে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম ৭ মাসে কাতার থেকে আমদানি করা এলএনজির দাম পড়েছে প্রতি হাজার ঘনফুচে ১০.৬৬ ডলার এবং ওমান থেকে আনা এলএনজির দাম পড়েছে ১০.০৯ ডলার।
কনসালটেন্ট প্রতিষ্ঠানের খসড়া পিএসসি এরইমধ্যে যৌথসভায় পর্যালোচনা করা হয়েছে। এতে পেট্রোবাংলার কর্মকর্তাদের পাশাপাশি জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ ও বাপেক্সের কর্মকর্তারা অংশ নেন।
ওই বৈঠকে অংশ নেওয়া একজন কর্মকর্তা নাম না প্রকাশ করার শর্তে বার্তা২৪.কমকে বলেছেন, খসড়ায় ৩ ধরণের দরের ফর্মূলা উপস্থাপন করা হয়। এতে ব্রেন্ট ক্রুড অয়েলের দামের সঙ্গে সামানযশ্য রাখার প্রস্তাব করা হয়। অর্থাৎ ব্রেন্ট ক্রুডের দাম বেড়ে গেলে গ্যাসের দাম বাড়বে, আর কমে গেলে দাম কমে আসবে। কনসালট্যান্ট প্রতিষ্ঠান এই দর ক্রুডের দরের ৯ শতাংশ করার প্রস্তাবনা দিলেও যৌথসভায় ক্যাপিং করে দেওয়ার বিষয়ে আলোচনা হয়। অপর একটি সূত্রের কথাও বলা হচ্ছে যে, ক্রুডের দাম অনেকে বেড়ে গেলেও গ্যাসের দাম ৮ ডলারের বেশি হবে না।
অন্যদিকে অফসোর পিএসসিতে এই গ্যাসের দাম রাখা হয়েছে ক্রুডের দরের ১০ শতাংশের সমান। ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে ক্রুড অয়েলের ব্যারেল প্রতি দাম ১৪০ ডলারে গিয়ে ঠেকেছিল। যা বর্তমান ৭০ ডলারের কাছাকাছি রয়েছে।
পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান রেজানুর রহমান বার্তা২৪.কমকে বলেছেন, মূলত পাবর্ত্য এলাকাকে টার্গেড করে অনসোর পিএসসি করা হচ্ছে। তিনি বলেন, কনসালট্যান্ট প্রতিষ্ঠান উডম্যাকেঞ্জির খসড়ার ওপর কিছু পর্যবেক্ষণ দেওয়া হয়েছে। সেগুলো আপডেট করে খসড়া জমা দেবে। আমরা চেষ্টা করছি খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে বিষয়টি চূড়ান্ত করতে।
গ্যাসের দাম কতো ধরা হচ্ছে এমন প্রশ্নের জবাবে পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান বলেন, এখনই সুনির্দিষ্ট দাম বলা যাচ্ছে না। তবে অফসোর পিএসসির চেয়ে কম হবে।
অপর এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, হ্যাঁ অবশ্যই ক্যাপিং করা যাবে। কারণ এনার্জির আন্তর্জাতিক বাজার খুবই অস্থিতিশীল। কোন কারণে দাম বেশি বেড়ে গেলে যাতে চাপ না পড়ে। আবার অনেক কমে গেলে যাতে বিনিয়োগকারী ক্ষতিগ্রস্ত না হয়।
পেট্রোংলা সূত্র জানিয়েছে, এখানে বাপেক্সের শেয়ার ১০ শতাংশ রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে। বাপেক্স আগে কোন বিনিয়োগ করবে না। গ্যাস পাওয়া গেলে তখন তারা ১০ শতাংশ মূলধন বিনিয়োগ করবে। অর্থাৎ বাপেক্সের কোন ঝুঁকি থাকছে না। গ্যাস পেলে মূলধন বিনিয়োগ করে মুনাফার ভাগ পাবে তারা।
মডেল পিএসসি-২০১৯ থেকে গ্যাসের দাম বৃদ্ধিসহ অনেক ছাড় দিয়ে পিএসসি-২০২৩ চূড়ান্ত করা হয়েছে। প্রতি হাজার ঘনফুট গ্যাসের দাম ধরা হয়েছে ব্রেন্ট ক্রুডের ১০ শতাংশ দরের সমান। অর্থাৎ ব্রেন্ট ক্রুডের দাম ৮০ ডলার হলে গ্যাসের দাম হবে ৮ ডলার। আগের পিএসসিতে যথাক্রমে অগভীর ও গভীর সমুদ্রে ৫.৬ ডলার ও ৭.২৫ ডলার স্থির দর ছিল।
অফসোর পিএসসির পর অনসোর পিএসসির বিষয়টি আলোচনায় চলে আসে। ওই পিএসসির আদলে অনসোর ব্লক ২২ ও ২২(ক) (পার্বত্য এলাকা) এর দরপত্র চূড়ান্ত করা হচ্ছে। যেহেতু পার্বত্য চট্টগ্রামের পর্যাপ্ত তথ্য নেই, তেল গ্যাস উত্তোলন করা কঠিন, রাস্তা তৈরি করা, গ্যাস পেলে পাইপলাইনের নির্মাণ ব্যয়বহুল। তাই স্থলভাগের অতীতের পিএসসির তুলনায় দাম অনেকটা বাড়িয়ে ধরা হচ্ছে বলে জানা গেছে।
বাংলাদেশের পার্বত্য অঞ্চলে ১৯১৪ সালে প্রথম কূপ খনন (সীতাকুণ্ড) করে বার্মা ওয়েল কোম্পানি। এরপর ১৯২২ সালে পাথারিয়ায় কূপ খনন করে। এরপর প্রায় ১২টি কূপ খনন করার হয়েছে, সর্বশেষ কূপ খনন করা হয় হালদা (১৯৯৮ সাল)। এরমধ্যে সেমুতাং ১, ২,৩ ও ৪ এ গ্যাস পেলেও বাণিজ্যিকভাবে উত্তোলনযোগ্য নয় বলে জানানো হয়। আর কোন কূপে সামান্য মজুদ আবার হালদা, সেমুতাং-৫ পটিয়াতে গ্যাসের আলামত পাওয়া যায়নি বলে তথ্য পাওয়া গেছে।
সেমুতান-৪ কূপের রিপোর্টে কেয়ান বলেছে, রিজার্ভ খুবই কম, পাইপলাইনের বিনিয়োগ ব্যয়বহুল হবে। বিনিয়োগ তুলে আনা কষ্টকর হবে। কূপ এলাকায় ৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্র করা যেতে পারে।
বাংলাদেশের গ্যাস সম্পদ নিয়ে নানা রাজনীতি বিদ্যমান। এক সময় বলা হলো গ্যাসের ওপর দেশ ভাসছে, আবার আরেক সময় বলা হলো গ্যাস নেই আমদানি করতে হবে। এই রাজনৈতিক খেলার কারণে অনুসন্ধান কার্যক্রম এখনও তিমিরেই বলা চলে। বাংলাদেশের ভূ-খণ্ডে প্রথম কূপ খনন করা হয় ১৯১১ সালে। ১১৪ বছরে অনুসন্ধান কূপ খনন করা হয়েছে কমবেশি ৯৯টি। আন্তর্জাতিকভাবে ১০টি কূপ খনন করে একটিতে গ্যাস পাওয়া গেলে সফল বলা হয়। সেখানে বাংলাদেশের ৯৯ টি অনুসন্ধান কূপ খনন করে ২৯ গ্যাস ফিল্ড আবিস্কৃত হয়েছে। অর্থাৎ সাফল্যের হার তিন অনুপাত এক। বাংলাদেশের সফলতার হার উচ্চ হলেও এখন তিমিরেই মনে করেন অনেকে।
১৯৯৫ সালের জ্বালানি নীতিমালায় বছরে ৪টি অনুসন্ধান কূপ খনন করার কথা বলা হয়। কিন্তু কোন সরকারেই সেই লক্ষ্যমাত্রার ধারের কাছেও ঘেঁষতে পারেনি। এক সময় ২৮০০ মিলিয়ন পর্যন্ত গ্যাস উত্তোলন করা হয়েছে। মজুদ কমে আসায় অনেক কূপেই উৎপাদন কমে গেছে। বর্তমানে ১৮৭০ মিলিয়নে নেমে এসেছে দেশীয় উৎপাদন।