জাবি: বন্ধ ঘোষণা সমস্যার সমাধান নয়
জাবি উপাচার্য অপসারণ আন্দোলন-
-
|

ছবি: বার্তাটোয়েন্টিফোর.কম
ছবি: বার্তাটোয়েন্টিফোর.কম
ছবি: সংগৃহীত
ইউক্রেনের জন্য পুতিনের কাছে ডোনাল্ড ট্রাম্পের আত্মসমর্পণ একটি নমুনাই প্রকাশ করে। যা থেকে তাকে চিত্রিত করা যায় সবচেয়ে লোভী হিসাবে, যিনি সবকিছু ত্যাগ করে বিনিময়ে খুব সামান্যই অর্জন করেন! তিনি একজন শক্তিশালী ব্যক্তি হিসেবে নিজেকে প্রচার করেন বটে, কিন্তু বাস্তবে তিনি দুর্বল, দুর্বল এবং দুর্বল। আমেরিকার প্রতিপক্ষদের সামনে ডোনাল্ড ট্রাম্প নেহায়েৎই লোভী ও বিবেচনাহীন বাতিকগ্রস্ত। বলা যায়, তিনি কেবল একজন মানুষের দরজার সামনে পরাজিত।
এই সপ্তাহে ভ্লাদিমির পুতিনকে তিনি যে উপহার দিয়েছেন তা একবার বিবেচনা করা যেতে পারে। ২০২২ সালে মস্কোর ইউক্রেন আক্রমণের পর তিন বছরে একঘরে থাকার পর যুদ্ধের বর্ষপূর্তির প্রাক্কালে তিনি রাশিয়াকে কূটনৈতিক শীতলতা থেকে বের করে এনেছেন। পুতিনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভকে অবাঞ্ছিত ব্যক্তি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল; তিনি আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞার আওতায় রয়েছেন। তবুও, এই সপ্তাহে রিয়াদে তিনি তথাকথিত শান্তি আলোচনায় ট্রাম্পের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিওর সাথে দেখা করেছেন।
এই বৈঠকের ঘটনা পুতিনের দীর্ঘদিনের আকাঙ্খাকে পূর্ণতা দিয়েছে, তা হচ্ছে আমেরিকার সাথে সমতা। এটি ইঙ্গিত দেয় যে ওয়াশিংটন মস্কোকে তার সমান বলে মনে করে। এটি এও প্রমাণ করে যে রাশিয়া একটি বিবেকহীন আগ্রাসী রাষ্ট্র নয়, বরং একটি সহযোগী বৃহৎ পরাশক্তি যা তার মর্যাদাকে সমুন্নত রাখে। সৌদি আরবে যাই হোক না কেন, পুতিন এটিকে জয় হিসাবেই গ্রহণ করবেন।
কিন্তু ট্রাম্পের উদারতা এখানেই শেষ হয়নি। রিয়াদের বৈঠকে কে ছিল না? উত্তর: ইউক্রেনীয়রা। মনে রাখবেন, এই আলোচনাগুলি ইউক্রেনের ভবিষ্যত নিয়ে আলোচনার জন্য ছিল; ইউক্রেন আক্রমণের পর দেশটিতে যুদ্ধের অবসান ঘটানোর জন্য। তাদের নিজস্ব ভবিষ্যত নির্ধারণের জন্য আলোচনা থেকে ইউক্রেনীয়দের বাদ দেওয়া স্পষ্টতই পুতিনের জন্য একটি বিশাল ছাড়: এটি নিশ্চিত করে যে তিনি তার শর্তে যুদ্ধ শেষ করেন। তবে এটি তাদের আরও বড় অর্জন হিসাবেই বিবেচিত হতে পারে। এটি পুতিনের দাবিকে পরোক্ষভাবে সমর্থন করে যে, ইউক্রেন একটি বাস্তবসম্মত দেশ নয়; এটি কেবল মহান রাশিয়ান মাতৃভূমির একটি প্রদেশ ছিল, যার নিজস্ব কোনও সার্বভৌমত্ব নেই।
সৌদি আরবে অন্য অংশীজনদের অগ্রাহ্য করা হয়েছিল এবং তাদের বাদ দেওয়া রাশিয়ান স্বৈরশাসকের প্রতি আরেকটি ঔদার্য হিসাবেই বিবেচিত হতে পারে। ইউরোপের দেশগুলোকে এই গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকের অংশ করা হয়নি যদিও তাদের পূর্ব সীমান্তে যা ঘটে তাতে তাদের সরাসরি ভূমিকা রয়েছে। নিশ্চিতভাবেই তারা কিয়েভের মিত্র ছিল এবং ইউক্রেনের প্রতিরক্ষায় সহায়তাও দিয়েছিল এবং তাদের উপস্থিতি রাশিয়ানদের কাছে খুব অপ্রীতিকর বলে মনে করা হতো হয়ত-তাই তাদের আমন্ত্রণ জানানো হয়নি।
তবে এই উপেক্ষার মধ্যে আরও একটি বৃহত্তর লক্ষ্য ছিল। পুতিনের কৌশলগত লক্ষ্য কী, যা সাম্প্রতিক বছরগুলিতে তার কর্মকাণ্ডের অনেক ব্যাখ্যা দেয়, যার মধ্যে বিদেশী নির্বাচনে হস্তক্ষেপও অন্তর্ভুক্ত? এটি হল পশ্চিমা জোটের ভাঙন। তিনি ব্রেক্সিটকে ভালোবাসতেন, ইউরোপে অতি ডানপন্থীদের উত্থানে উল্লাস করেছিলেন এবং ট্রাম্পকে সমর্থন করেছিলেন কারণ তিনি তার বিরুদ্ধে দৃঢ়ভাবে দাঁড়িয়ে থাকা পশ্চিমা ব্লকের ভেঙে পড়া দেখতে চাইতেন। একজন মার্কিন রাষ্ট্রপতির জন্য এই স্ক্রিপ্ট অনুসরণ করা, আমেরিকার সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী মিত্রদের বিচ্ছিন্ন করা, ক্রেমলিনের জন্য একটি বিশাল জয়।
বিশেষ করে মার্কিন ভাইস-প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্সের মিউনিখ ভ্রমণের ঠিক পরেই - যে শহরটির নাম চিরকাল স্বৈরশাসকদের তোষণের সাথে যুক্ত থাকবে ইউরোপের গণতন্ত্রকে তিরস্কার করার জন্য। বাকস্বাধীনতা ও রাশিয়ার সমস্ত ভিন্নমত দমনের কোনও উল্লেখ না করে পুতিনের অভ্যন্তরীণ সমালোচকদের মৃত্যুর দুর্ভাগ্যজনক প্রবণতাকেও সচেতনভাবে তুলে ধরে এটি।
ট্রাম্পের অযোগ্য প্রতিরক্ষা সচিব পিট হেগসেথ এর আগে ইউক্রেনকে সতর্ক করেছিলেন যে রাশিয়া কর্তৃক অধিকৃত ভূমি তারা কখনই পুনরুদ্ধার করতে পারবে না এবং ন্যাটোতে যোগদানের সমস্ত স্বপ্ন ত্যাগ করা উচিত। কিন্তু তদুপরি ট্রাম্প সোশ্যাল মিডিয়ায় ক্ষোভ জানিয়ে যে পোস্ট করেছিলেন তা পুতিনের প্রিয় আলোচনার বিষয় হয়ে ওঠে। ট্রাম্প লিখেছেন, ভলোদিমির জেলেনস্কি হলেন ‘অনির্বাচিত একজন স্বৈরশাসক’, যিনি তার নিজের জনগণের কাছে ব্যাপকভাবে অজনপ্রিয়। যিনি দুর্নীতির মাধ্যমে ইউক্রেনের কোটি কোটি ডলার গ্রাস করেছেন। ট্রাম্প এও বলেন যে, ‘আপনার কখনই এ যুদ্ধ শুরু করা উচিত ছিল না।’ যেন তিন বছর আগে রাশিয়ায় আক্রমণকারী ইউক্রেনই ছিল!
গত সপ্তাহে ট্রাম্প পুতিনকে বিষয়ে যে অবস্থান তুলে ধরেছেন তা এই ধারণাই প্রকট করে। আর বিনিময়ে ট্রাম্প কী পেয়েছেন? তোষামোদ এবং মস্কোর সাথে লাভজনক জ্বালানি চুক্তির ঝুলন্ত প্রতিশ্রুতি ছাড়া কিছুই নয়। প্রকৃতপক্ষে, তিনি বিনিময়ে কিছুই চাননি। বলা বাহুল্য যে, কথিত শক্তিশালী এই ব্যক্তি হাঁটু গেড়ে রাশিয়ান স্বৈরশাসকের পায়ে চুম্বন করেছিলেন তারা আলোচনা কক্ষে প্রবেশ করার আগেই। অবাক হওয়ার কিছু নেই, ২০১৯ সালে ইউক্রেনের বিষয়ে ট্রাম্পের পয়েন্ট ম্যান হিসেবে পদত্যাগকারী কার্ট ভলকার, সর্বশেষ পলিটিক্স উইকলি আমেরিকা পডকাস্টে আমাকে বলেছিলেন যে প্রেসিডেন্টের ‘পুতিনের প্রতি অন্ধ সমর্থন’ রয়েছে।
এমন বাস্তবতায় ট্রাম্পের পক্ষে ‘যুদ্ধের অবসানের জন্য সফলভাবে আলোচনা’ করার দাবি করা হাস্যকর বললেও অত্যুক্তি হবে না, যা কেবল তিনিই করতে পারেন। যদি আপনি এক পক্ষকে তারা যা চায় তা দেন, যা তারা স্বাভাবিকভাবেই গ্রহণ করে এবং অন্য পক্ষকে তাদের যা প্রয়োজন অস্বীকার ও প্রত্যাখ্যান করে। তবে এটি একটি শান্তি চুক্তি নয়, একে জোরপূর্বক আত্মসমর্পণ ছাড়া আর কিছুই বলা যায় না। এটি মোটেও কোনও অর্জন নয়।
এবং এই ক্ষেত্রে ট্রাম্পের ক্ষেত্রে বলাবাহুল্য যে, চুক্তির কথিত কর্তা বারবার সবকিছু ত্যাগ করে বিনিময়ে কিছুই অর্জন করতে পারেন না। ২০১৮ সালে কিম জং-উনের সাথে তার বৈঠকের কথা মনে করা যেতে পারে। উত্তর কোরিয়ার অত্যাচারী এবং দাস রাষ্ট্রের শাসক একজন মার্কিন রাষ্ট্রপতির সাথে শীর্ষ সম্মেলনের বৈধতা এবং তার প্রবল প্রশংসার পুরষ্কার পেয়েছিলেন। কিম কোরীয় উপদ্বীপে মার্কিন সামরিক মহড়া স্থগিত করার মাধ্যমেও জয়লাভ করেছিলেন। এগুলি মূল্যবান অর্জনই বটে! বিনিময়ে, কিম পারমাণবিক অস্ত্রবিহীন বিশ্বের জন্য কিছু অস্পষ্ট আকাঙ্ক্ষা ছাড়া আর কিছুই স্বীকার করেননি। তিনি ট্রাম্পকে একটি স্লট মেশিনের মতো খেলেছেন।
স্পষ্ট করে বলতে গেলে, রাষ্ট্রপতির দুর্বলতা এখানে সবচেয়ে গুরুতর পাপ নয়। আরও গুরুতর হল একজন স্বৈরশাসকের কাছে আত্মসমর্পণ, আক্রমণে সম্মতি এবং এর স্থায়ী নজির স্থাপন। জীবনের জন্য লড়াই করা একটি মিত্রকে পরিত্যাগ করা এবং আট দশক ধরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সহ পশ্চিমে আপেক্ষিক শান্তি ও সমৃদ্ধি এনে দেওয়া একটি জোট ভেঙে ফেলার স্পষ্ট সিদ্ধান্ত।
ট্রাম্প নিয়ে ব্যাখ্যাকারীরা বলছেন যে, তিনি এটি একটি কঠোর কারণে এসব করছেন। এমনকি তার নিজস্ব শর্তে বিচার করলেও, এই পদক্ষেপ ব্যর্থতার ইঙ্গিতবাহী। কারণ একটি ভঙ্গুর পশ্চিমের ভবিষ্যতে চীনের আধিপত্যকে আরও বেশি প্রবল করে তোলে।
ব্রিটেন সহ বাকি পশ্চিমাদের খুব দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এবং তা স্পষ্টতার সঙ্গে আবির্ভূত নতুন বিশ্বকে কীভাবে পরিচালনা করা যায়। যুদ্ধোত্তর যুগ শেষ হয়ে গেছে। ১৯৪৫ সালে নির্মিত বৈশ্বিক স্থাপত্য ট্রাম্পের দ্বারা পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে। ইউরোপীয়দের এমন একটি ভবিষ্যতের পরিকল্পনা করা এবং বিনিয়োগ করা দরকার যেখানে তাদের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ছাড়াই নিজেদের রক্ষা করা যাবে। সেই ভবিষ্যৎ খুব বেশি দূরে নয়। এটি ইতিমধ্যেই দৃশ্যমান।
আপাতত, একটি রাজনৈতিক কাজ করা যেতে পারে। এটি হল ট্রাম্প যে ভাবমূর্তি গড়ে তোলার জন্য অনেক কিছু করেছেন এবং যার উপর তিনি দেশে এবং বিদেশে অন্যদের ভয় দেখানোর চেষ্টা চালাচ্ছেন। ডেমোক্র্যাটিক সিনেটর রিচার্ড ব্লুমেন্থাল এই সপ্তাহে বলেছিলেন, ‘রাষ্ট্রপতির আত্মসমর্পণ করুণ এবং দুর্বল।’ এটিই সঠিক উপমা। ট্রাম্প সর্বশ্রেষ্ঠ প্রচারসর্বস্ব ব্যক্তিত্ব হতে পারেন, কিন্তু তিনি বিশ্বের দেখা সবচেয়ে দুর্বলতম শক্তিশালী ব্যক্তি।
জোনাথন ফ্রিডল্যান্ড দ্য গার্ডিয়ান’র কলামিস্ট। দ্য গার্ডিয়ান থেকে ভাষান্তর: আশরাফুল ইসলাম
ভাষাসৈনিক ডা. এ. এ. মাজহারুল হক। বার্তা২৪.কম
বাঙালি জাতিসত্তার আলোকস্তম্ভ একুশে। সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক অধিকারের ঐক্যবোধ এনেছিল একুশে। একাত্তর–উত্তর রাষ্ট্র গঠনের মৌলিক এবং অন্যতম অনুপ্রেরণা একুশে। ব্যক্তিগতভাবে এক আত্মিক সম্পর্ক রয়েছে আমার একুশের সঙ্গে। আমার পিতা একজন ভাষাসৈনিক। আমার পিতা ডা. এ.এ. মাজহারুল হক ১৯৫২ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজের একজন তরুণ ছাত্র। ভাষা আন্দোলনে রয়েছে তাঁর সরাসরি অংশগ্রহণের অবদান। কিশোরগঞ্জে বসবাসের দিনগুলোতে তিনি ভাষা আন্দোলনের স্মৃতি ও সংগ্রামকে বার বার তুলে ধরেন মানুষের কাছে। সমাজের পক্ষ থেকেও তাঁকে জানানো হয় সম্মান।
একাধিক সাক্ষাতকারে তিনি জানিয়েছেন ছাত্ররা যে এক রাতে তৈরি করেন প্রথম শহীদ মিনার, সেই প্রত্যক্ষ স্মৃতি। সাংবাদিক আশরাফুল ইসলাম (কিশোরগঞ্জ) তাঁর সঙ্গে আলাপের ভিত্তিতে জানান, ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারির মতো ২২শে ফেব্রুয়ারিও ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে অমর একটি দিন। এ দিনেই হোস্টেলের পার্শ্বে ঢাকা মেডিকেলের প্রাঙ্গণে প্রথম শহীদ মিনার নির্মাণের প্রাথমিক কাজটি সম্পন্ন হয়। সে দিন নির্মিত ‘শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ’টিই পরবর্তীকালের শহীদ মিনার।
আজকে যে শহীদ মিনার, সেটা শুরুতে নির্মিত হয়েছিল মাত্র এক রাত্রের মধ্যে। সেই স্মৃতিস্তম্ভ তৈরি হতে শুরু করে নির্মাণ পর্যন্ত সবটুকু কৃতিত্ব যারা সে সময়ের ঢাকা মেডিকেলের ছাত্র, তাদের। তাদের মধ্যে ছিলেন মাতৃভাষা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়ে বিভিন্ন কর্মসূচির সঙ্গে সঙ্গে শহীদদের স্মরণে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের ছাত্রদের নির্মিত প্রথম ইটের শহীদ মিনার তৈরিতে অংশ নেয়া ঢাকা মেডিকেল কলেজের আদিপর্বের ছাত্র ডা. এ.এ. মাজহারুল হক।
ডা. এ.এ. মাজহারুল হক মাতৃভূমির প্রায় প্রতিটি বিজয়-সংগ্রামেই, বিশেষ করে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন, ভাষা আন্দোলন এবং একাত্তরের মহান মুক্তিসংগ্রামে প্রত্যক্ষভাবে সক্রিয় অবদান রাখেন। ১৯৪৬-৪৭ সালে ছাত্রাবস্থায় ব্রিটিশ হটাও আন্দোলনে প্রবলভাবে যুক্ত থেকে তিনি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা প্রতিরোধে কাজ করেন। ভাষা আন্দোলনে সংক্ষিপ্ত কারাবাসসহ সরাসরি অংশগ্রহণ করেন। ১৯৭১ সালে তিনিই প্রথম মুক্তিকামী কিশোরগঞ্জবাসীকে স্বাধীনতার ঘোষণা অবহিত ও প্রচার করেন এবং তাঁর নেতৃত্বে নিজ বাসভবনেই আত্মসমর্পণের অনুষ্ঠান সম্পন্ন করেন রক্তপাতহীনভাবে কিশোরগঞ্জের পতন ঘটিয়ে সেখানে সর্বপ্রথম স্বাধীনতার পতাকা উড্ডীন করেন।
দীর্ঘ ৭০ বছর তিনি কিশোরগঞ্জে নিরবিচ্ছিন্নভাবে চিকিৎসা-সমাজসেবা-রাজনীতির মহানব্রত পালনের মাধ্যমে মানুষের কল্যাণে নিরন্তর ভূমিকা রেখে ২০২৩ সালের ২১শে সেপ্টেম্বর তিনি পরলোকগমন করেন। কিশোরগঞ্জের সমাজ ও মানুষের কাছে তিনি কিংবদন্তীতুল্য চিকিৎসক ও ভাষাসৈনিকের মর্যাদায় আসীন।
ভাষা আন্দোলনে ডা. মাজহারুল হকের ব্যক্তিগত সংযোগ স্মৃতির ঘটনাটি ২০০৭ সালে জাতীয় প্রেস ক্লাব প্রকাশিত ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’ সংকলনে আলী হাবিব বিস্তারিত লিখেছেন: ‘‘ঢাকা মেডিকেলের ছাত্ররা এক রাতের মধ্যে এ প্রশংসনীয় কাজটি করেছিলেন।” ডা. মাজহারুল হকসহ মেডিকেলের শিক্ষার্থীদের সরাসরি ও প্রত্যক্ষ অংশ গ্রহণের সেসব কথা শহীদ মিনার নির্মাণের কাজে জড়িত অপর এক ছাত্র সাঈদ হায়দার তাঁর স্মৃতিকথায় লিখেছেন: “মেডিকেল কলেজের ছাত্ররা শহীদ মিনার তৈরির সিদ্ধান্ত নেয়। এটাকে স্বতঃস্ফূর্ত একটা পরিকল্পনা বলা চলে। বিকেল থেকে কাজ শুরু হয়। শেষ হয় ভোরে।”
জীবদ্দশায় ডা. মাজহারুল হক সাংবাদিক আশরাফুল ইসলামকে জানান: “আমরা এক প্রকার গেরিলার মত গোপনে নির্মাণ কাজ চালিয়ে ছিলাম। ইট, বালি, সিমেন্ট সংগ্রহ করেছিলাম। ঘোষণা দিয়ে ঘটা করে তা নির্মাণ করা হয় নি কৌশলগত কারণে। পূর্বাহ্নে জানতে পারলে পাকিস্তানপন্থীরা সেটা গড়তেই দিত না। আমরা নির্মাণ-সংক্রান্ত যোগার-যন্ত্র ও অন্যান্য আয়োজন নির্ধারণ করে পালাক্রমে স্বেচ্ছাশ্রমে কাজ চালিয়ে গভীর রোমাঞ্চ ও উত্তেজনায় দেখতে পেলাম যে, আমাদের কাঁচা হাতে শহীদদের রক্তদানের পবিত্র স্থানে মাথা উঁচু করা স্মৃতিস্তম্ভ দাঁড়িছে আছে। সেই দিনের উত্তেজনা আজও মনে আছে। শহীদ শফিউরের পিতাকে সঙ্গে নিয়ে আমাদের নির্মিত প্রথম শহীদ মিনার উদ্বোধন করেন দৈনিক আজাদ সম্পাদক আবুল কালাম শামসুদ্দীন সাহেব। পরপরই আমরা ফুল ও শ্রদ্ধার মালায় শহীদ মিনার ভরে তুললাম। সারা দিনই বিপুল ছাত্র-জনতা এভাবে শ্রদ্ধা নিবেদন করল। সেদিনই শেষ বিকালের দিকে সরকারের পক্ষ হতে শহীদ মিনারের উপর আক্রমণ চালানো হল। তছনছ করে দেওয়া হল স্মৃতি ও শ্রদ্ধার মিনার। পুলিশ অকস্মাৎ হামলা চালিয়ে আদি শহীদ মিনারটি সম্পূর্ণরূপে গুড়িয়ে নিশ্চিহ্ন করে দিল এবং আমাদের মেডিকেল হোস্টেলে আক্রমণ করল। জীবনে প্রথমবারের মত পুলিশী নির্যাতনের শিকার হলাম। আহত অবস্থায় আমাদেরকে থানায় নিয়ে গিয়ে শাসিয়ে দেওয়া হল। বিপুল সংখ্যক ছাত্রকে আটক করে রাখার মত স্থান হয়তো থানা-পুলিশের ছিল না। গণগ্রেফতার করে আন্দোলনকে আরও বেগবান করার পথে তারা অগ্রসর হল না। কয়েক ঘণ্টার আটকাবস্থা, জেরা ও খবরদারীর পর আমাদেরকে ছেড়ে দেওয়া হল। হলে ফিরে এসে দেখলাম উদ্বিগ্ন বন্ধু-বান্ধব অপেক্ষমাণ। আমাদেরকে অতি দ্রুত প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়া হল।”
ডা. মাজহারুল হক জানান, ঢাকা মেডিকেলে অধ্যয়নের সময় ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের মত জাতীয় রাজনীতির ঐতিহাসিক ঘটনাবলীর সরাসরি সম্মুখীন হন তিনি এবং ব্যক্তিগতভাবে নিজে ও তাঁর সহপাঠীগণ তাতে অংশ গ্রহণ করেন। তিনি ব্যারাক নামে পরিচিত মেডিকেল হোস্টেলে তখন থাকতেন। ইত্যবসরে রাজনীতিতে নানারূপ পরিবর্তন সাধিত হল। ভাষার জন্য লড়াইয়ের ক্ষেত্রও তৈরি হয়ে গেল।
ডা. মাজহারুল হকের ভাষায়, ফেব্রুয়ারির ২০ তারিখের দিকে ছাত্র আন্দোলন সুতীব্র হল। অনেকে গ্রেফতার বরণ করলেন। সরকার এক মাসের জন্য ১৪৪ ধারা বহাল করল। সভা-সমাবেশ-হরতাল নিষিদ্ধ করা হল। কিন্তু সবাই তখন সংগ্রামমুখর। বাংলার ছাত্র সমাজ তখন অকুতোভয়। কে তাদেরকে রুখবে! এমন সাধ্য কার!! রাত্রি বেলাতেই সিদ্ধান্ত জানা গেল যে, ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করা হবে। সমাবেশ হবে। মিছিল হবে। প্রতিবাদ-প্রতিরোধ চলবেই।
রাত্রি শেষে এলো ২১ ফেব্রুয়ারি। সেদিন সকাল হতেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও পার্শ্ববর্তী এলাকার পরিস্থিতি আপাত দৃষ্টিতে শান্তই ছিল। ২১ ফেব্রুয়ারি ছাত্ররা ৫জন ৫জন করে ১৪৪ ধারার ভেতরেও মেডিকেল হোস্টেল, যা ব্যারাক নামে পরিচিত ছিল, তার সম্মুখে সমবেত হতে লাগল। আজিমপুর ও সলিমুল্লাহ হলের দিক হতেও লোকজন আসতে লাগল। মধুর ক্যান্টিনের দিকেও ছাত্ররা সংগঠিত হল। অবিরাম ছাত্রস্রোত রুদ্ধ করতে প্রথমে পুলিশের পক্ষ হতে শুরু হয় লাঠিচার্জ। এর পর শুরু হল টিয়ার গ্যাস নিক্ষেপ। কিন্তু কোনওভাবেই বিক্ষোভ দমন করা সম্ভব হল না। বেলা যতই বাড়তে লাগল, ততই বিক্ষোভ তীব্রতর হতে লাগল; প্রতিবাদ-বিক্ষোভে জনসমাগমও হু হু করে বৃদ্ধি পেল। বিশ্ববিদ্যালয় মাঠ, মেডিকেল কলেজ গেইট প্রভৃতি এলাকায় ছাত্র-জনতার বিক্ষোভ সমাবেশ পুঞ্জিভুত হতে লাগল। ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সাথে সংহতি জানাতে হাসপাতালের ওয়ার্ড বয় হতে শুরু করে হল বয় পর্যন্ত এসে মিছিলে একাত্ম হল। এরই মধ্যে পুলিশের সঙ্গে তাঁদের সংঘর্ষ আরম্ভ হল।
এমন অবস্থায় বেলা তিন ঘটিকার দিকে রাজপথে দাঁড়িয়েই ডা. মাজহারুল হক অতি নিকটেই পুলিশের বন্দুক হতে হঠাৎ গুলি বর্ষণের আওয়াজ শুনতে পান। প্রচণ্ড উত্তেজনা ও হৈ চৈ-এর মধ্যে আন্দোলনরত ছাত্রদেরকে সঙ্গে নিয়ে তিনি সন্নিকটে অবস্থিত মেডিকেল হোস্টেলে এসে আশ্রয় গ্রহণ করেন। বহুজন আহত হল। আহত ও নিহতদের ইমার্জেন্সিতে নেওয়া হল। তিনিসহ মেডিকেলের ছাত্ররা ইমার্জেন্সিতে ছুটে গিয়ে বহু আহতকে কাতরাতে দেখলেন। স্বাধীন দেশে পুলিশের নির্মম অত্যাচারের চিত্র যে এত ভয়াবহ হতে পারে, তা দেখে সবাই বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। হাসপাতালে গুলিবিদ্ধ আবুল বরকতকে দেখতে পেলেন তিনি। বরকতের তলপেটে গুলি লেগেছিল। মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ে ভাষা আন্দোলনের প্রথম শহীদ হিসাবে তিনি সকলের চোখের সামনে দিয়ে পরপারের পথে চির বিদায় নিলেন। শহীদ আবুল বরকতের পর গুলিবিদ্ধ হন রফিকুদ্দিন। তিনি ছিলেন মানিকগঞ্জের দেবেন্দ্র কলেজের ছাত্র। তাঁর পিতা ছিলেন বাদামতলীর কমার্শিয়াল আর্ট প্রেসের মালিক। ২১ ফেব্রুয়ারির আরেক শহীদ আবদুল জব্বার। তাঁর বাড়ি ময়মনসিংহে। বৃহত্তর ময়মনসিংহের কিশোরগঞ্জের কুলিয়ারচরে লক্ষ্মীপুরে ডা. মাজহারুল হকের গ্রামের বাড়ির সম্মুখ দিয়ে প্রবাহিত পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদের পশ্চিম পার্শ্বে গফরগাঁও থানার পাঁচুয়া গ্রামের এই ভাষা-শহীদ ঢাকা মেডিকেল কলেজের হাসপাতালে এক আত্মীয়-রোগী ভর্তি করতে এসেছিলেন। তিনি মেডিকেল কলেজ হোস্টেলেই নিজ এলাকার একজন ছাত্রের কক্ষে এসে উঠেছিলেন। গত কয়েকদিন যাবত তাঁকে কলেজ ক্যান্টিন ও হাসপাতালে দেখেছিলেন ডা. মাজহারুল হক। অদৃষ্টের ইঙ্গিতে তিনিও শহীদের তালিকায় নাম লিখালেন। তিনি চোখের সামনে রক্ত, মৃত্যু আর আহতদের আহাজারি দেখে ক্ষণকালের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেলেন বটে। কিন্তু সেই সুতীব্র আঘাত ও আক্রমণ তাঁদের মধ্যকার একটি ঘুমন্ত-ক্ষত-বিক্ষত বাঘকে জাগিয়ে দিল। বন্ধু-সহপাঠীদের মধ্যেও তিনি লক্ষ্য করলেন অভিন্ন ক্ষোভের লেলিহান অগ্নিশিখা প্রজ্বলিত হয়েছে।
ভাষা আন্দোলনের স্মৃতি তিনি জীবনভর লালন করেছেন। বাঙালি জাতির অধিকার ও সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছেন। একুশের চেতনাকে ছড়িয়ে দিয়েছেন পরবর্তী প্রজন্মে। এভাবেই একুশের সঙ্গে নির্মিত হয়েছে আমার নিবিড় আত্মিক সম্পর্ক। ভাষা, সংস্কৃতি, সমাজ ও শিক্ষা বিস্তারে তাঁর আদর্শে কিশোরগঞ্জে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে মাজহারুন-নূর ফাউন্ডেশন। আঞ্চলিক ইতিহাস, ঐতিহ্য, শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি নিয়ে কাজ করছে এই সংস্থা ভাষাসৈনিক ডা. এ. এ. মাজহারুল হকের স্মৃতিময় প্রেরণায়।
ড. মাহফুজ পারভেজ, ভাষাসৈনিকের জেষ্ঠ্যপুত্র। লেখক, শিক্ষাবিদ, গবেষক।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প
১৯৯৪ সালে অবরুদ্ধ বসনিয়ায় সিনেটর হিসেবে জো বাইডেনের সফর এবং সার্বিয়ান কর্তৃপক্ষ কর্তৃক নিরস্ত্র বসনিয়ানদের উপর চালানো নৃশংসতার প্রতি আপাতদৃষ্টিতে তার উদ্বেগ, তাকে ডেটন শান্তি চুক্তির আয়োজনকারীদের তুলনায় বসনিয়ানদের মধ্যে বেশি জনপ্রিয় করে তুলেছিল। তিনি একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব হিসেবে আবির্ভূত হন এবং বলকান অঞ্চলে, বিশেষ করে বসনিয়ায় জটিল রাজনৈতিক ও মানবিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় তার প্রতিশ্রুতির জন্য বসনিয়ান এবং কসোভারদের মধ্যে প্রশংসিত হন। তিনি যে কয়েকটি প্রধান চ্যালেঞ্জ সমাধান করেছিলেন তার মধ্যে ছিল জাতিগত সহিংসতা ও গণহত্যা বন্ধ করা এবং শান্তির জন্য ন্যাটো এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে হস্তক্ষেপ করা।
বাইডেন কেবল পশ্চিম বলকান দেশগুলির পক্ষে তার সমর্থনের জন্যই নয়, বরং সিনেটর এবং পরে ভাইস-প্রেসিডেন্ট হিসেবে বলকান অঞ্চলে তার ঘন ঘন সফরের মাধ্যমেও বলকান রাজনীতির বিস্তৃত ধারণা সম্পন্ন কয়েকজন মার্কিন রাজনীতিবিদদের একজন হিসেবে পরিচিতি পেয়েছিলেন। বলকান দেশগুলির দীর্ঘমেয়াদী স্থিতিশীলতা এবং গণতন্ত্রীকরণের জন্য তার প্রচেষ্টা বলকানদের মধ্যে প্রত্যাশা জাগিয়ে তুলেছিল এ কারণে যে তিনি রাষ্ট্রপতি হিসেবে বলকান অঞ্চলের প্রতি সহানুভূতির সঙ্গে বিবেচনা করবেন।
কিন্তু গত তিন দশক ধরে সেখানে ব্যাপক রূপান্তর ঘটেছে, যা নতুন দেশীয় এবং বিদেশী অগ্রাধিকারকে সামনে এনেছে। বাইডেন বলকান অঞ্চলকে অবহেলা করেছেন এবং তাদের দুর্দশায় নীরব থেকেছেন বলে মনে করা হয়। সেকারণে তিনি সমালোচনার মুখেও পড়েন। নিরপরাধ মুসলমানদের সুরক্ষায় ব্যর্থতার কথা জোর দিয়ে উল্লেখ করে পশ্চিমাদের পূর্বের অবস্থান থেকে আকস্মিক পরিবর্তনকে অনেকেই বাইডেনের বিশ্বাসঘাতকতা বলে মনে করেন। বসনিয়ার সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রাখার পরিবর্তে, বাইডেন প্রশাসন নিজেকে দূরে সরিয়ে নিয়েছিল, যা বলকান অঞ্চলের প্রতি মার্কিন পররাষ্ট্র নীতিতে একটি আশ্চর্যজনক পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয়।
ত্রিশ বছর আগে, জাতিসংঘের আরোপিত অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার না করার জন্য বিরোধীদের উপর বাইডেন তীব্র সমালোচনা করেছিলেন, যা বসনিয়ার আত্মরক্ষার ক্ষমতাকে উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস করেছিল। বিপর্যস্ত বসনিয়ার জন্য কিছু গুরুতর নীতি বিবেচনায় নিয়ে এসেছিল। এর মধ্যে রয়েছে ১৯৯৫ সালের বসনিয়া ও হার্জেগোভিনা আত্মরক্ষা আইন, যা বসনিয়ার আত্মরক্ষার অধিকারের পক্ষে ছিল। সেইসাথে স্রেব্রেনিকা গণহত্যা স্মরণে একটি প্রস্তাব। এই উদ্যোগগুলি দুটি গুরুত্বপূর্ণ দিক তুলে ধরে: প্রথমত, সংবেদনশীল আন্তর্জাতিক বিষয়গুলি মোকাবেলায় বাইডেনের বাস্তবসম্মত দৃষ্টিভঙ্গি এবং দ্বিতীয়ত, একটি সদ্য স্বাধীন বলকান দেশের সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তার প্রতি তার অটল সমর্থন।
মানবাধিকার, আইনের শাসন এবং গণতন্ত্র রক্ষার জন্য পূর্ববর্তী মার্কিন প্রতিশ্রুতি থেকে সরে আসা ইতিমধ্যেই গুরুতর প্রশ্ন উত্থাপন করেছে। যদিও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই অঞ্চলে সামরিক, রাজনৈতিক এবং আর্থিকভাবে বিনিয়োগ করেছে, তবুও দেশজুড়ে অতি-জাতীয়তাবাদী এবং বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের কারণে এটি এখনও মনোযোগের দাবি রাখে। তবে এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র রচিত ডেটন চুক্তির কল্পনা করার জন্য একজন উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধি নিয়োগ করা সত্ত্বেও, বলকান অঞ্চল জাতিগত উত্তেজনা, দুর্নীতি, গণতান্ত্রিক পশ্চাদপসরণের ঘটনা ঘটেঠে। চীন, রাশিয়া এবং তাদের প্রতিনিধিদের দ্বারা ক্রমবর্ধমান বহিরাগত প্রভাবের মতো গভীর রাজনৈতিক এবং নিরাপত্তা উদ্বেগের দ্বারা জর্জরিত। প্রকৃতপক্ষে, এই অঞ্চলটি ইউরোপের পরবর্তী সম্ভাব্য ভূ-রাজনৈতিক বিপর্যয় হিসাবে ব্যাপকভাবে বিবেচিত হয়।
সাহায্য, মানবতাবাদ এবং গণতন্ত্রের প্রচারের বাইরে বিস্তৃত দৃষ্টিকোণ থেকে পশ্চিম বলকানকে স্থিতিশীল রাখতে পশ্চিমাদের অক্ষমতা অনেক বিশ্লেষককে হতবাক করেছে। এই সংকীর্ণ পদ্ধতির নেতিবাচক দিক এই অঞ্চলকে আবারও সংঘাত বা এমনকি নৃশংস যুদ্ধের দিকে ঠেলে দিতে পারে। এই পরিস্থিতিতে, চরম জাতীয়তাবাদ এবং ডানপন্থী জনপ্রিয়তা গণতন্ত্রের প্রতিযোগী হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছে। যা রাশিয়া, চীন এবং অন্যান্য মধ্যপন্থী শক্তির সাথে লড়াই করার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তার ইউরোপীয় মিত্রদের প্রচেষ্টাকে কিছুটা জটিল করে তুলছে, যারা এই অঞ্চলে প্রবেশ করছে। এই মধ্যপন্থী শক্তিগুলি ইতিমধ্যেই সার্বিয়ান জাতিগত জাতীয়তাবাদীদের সাথে দীর্ঘমেয়াদী জোট প্রতিষ্ঠা করেছে। নিজেদের নির্ভরযোগ্য অংশীদার হিসেবে উপস্থাপন করেছে।
ইউরোপীয় দেশগুলি অস্থিতিশীল কিন্তু কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ এই অঞ্চলে সক্রিয়ভাবে হস্তক্ষেপ করার জন্য সীমিত ইচ্ছা দেখিয়েছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রত্যাবর্তন বলকান ধাঁধাকে আরও জটিল করে তুলতে পারে। ট্রাম্প প্রশাসনের অধীনে যদি ইউরো-আমেরিকান জোট দুর্বল হয়ে পড়ে, তাহলে বলকানরা আরও বেশি অস্থিতিশীলতার মুখোমুখি হতে পারে।
দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস থেকে ভাষান্তর
ছবি: বার্তা২৪.কম
সঠিক তথ্যের চেয়ে ভুল তথ্য মারাত্মক বিপদের কারণ। অপতথ্য আরও বিপদজনক ও ক্ষতিকর। জুলাই বিপ্লব-পরবর্তী বাংলাদেশে অপতথ্যের তাণ্ডব মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। এই আপদকে মোটেও অবহেলা করা ঠিক হবে না। বরং অপতথ্যের তাণ্ডবকে অবহেলা করা হলে তা অক্টোপাসের মতো প্রকৃত সত্যকে গলাটিপে হত্যা করবে।
বলার অপেক্ষা রাখে না যে, সাম্প্রতিক বাংলাদেশে চলমান যাবতীয় রাজনৈতিক কার্যক্রমের নেপথ্যে মূল প্রেরণা হল গণতান্ত্রিক উত্তরণ এবং স্বৈরতন্ত্র ও ফ্যাসিবাদের চির অবসান। এক্ষেত্রে অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষে নির্বাচিত সরকারের হাতে দায়িত্ব হস্তান্তরে পর আবার নিজেদের কাজে ফিরে যাওয়ার প্রত্যাশা ব্যক্ত করা হয়েছে। বর্তমান সরকারের ঘোষিত অভিপ্রায় হল, `পুরোনো বাংলাদেশ সম্পূর্ণভাবে দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়েছিল, তাই আমরা নতুন বাংলাদেশ নির্মাণ করতে চাই। সেক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সব পর্যায় থেকে আমরা অনেক বড় সহায়তা পাচ্ছি।‘ এই কাজে সফল হলে অন্তর্বর্তী সরকার ইতিহাস সৃষ্টি করবেন এবং নিজেরাও ইতিহাসের সম্মানজনক স্থানে অধিষ্ঠিত হবেন।
এ কথা সত্য যে, অন্তর্বর্তী সরকার গণতান্ত্রিক উত্তরণের পথে তথ্য ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার পূর্ণ মূল্য দিচ্ছেন। অতীতের যা কিছু স্বৈরতন্ত্রের ত্রাসে চাপা পড়েছিল এবং ফ্যাসিবাদের তাণ্ডবে রক্তাক্ত হয়েছিল, সেসব তথ্য ও সত্য ক্রমেই উন্মোচিত হচ্ছে। সংবাদমাধ্যমে প্রশ্ন উচ্চারিত হচ্ছে, `জুলাই বিপ্লবের খুনিরা কোথায়?‘ এমন প্রশ্ন সদ্য বিগত বাংলাদেশে অকল্পনীয় ছিল। অনেক ক্ষেত্রে ক্ষতিগ্রস্তরা প্রতিকার চাইছেন। মামলা করছেন। বিচার প্রক্রিয়া স্বাভাবিক গতিতে এগিয়ে চলেছে। গণতন্ত্রের আরেক গুরুত্বপূর্ণ পূর্বশর্ত ন্যায়বিচার বা আইনের শাসনের আবহ আবার ফিরে আসছে, যা অতীতে দল, ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর করায়ত্ত ছিল।
তবে জুলাই বিপ্লব-পরবর্তী পরিস্থিতি মোটেও শান্ত নয়, বহুলাংশেই সঙ্কুল। মতলববাজরা ন্যায়বিচার বা আইনের শাসনকে বিকৃত করছে। অর্থের লোভে বা প্রতিহিংসার কারণে শুরু হয়েছে মামলা বাণিজ্য। অতীতের মতোই বর্তমানেও এসব মামলা বাণিজ্যে সরকারি কর্মকর্তা ও অসাধু পুলিশ অফিসারদের যোগসাজশ রয়েছে। প্রবাসী বা পেশাজীবী বা নিরীহ সাধারণ মানুষকে মামলার আসামী করে হয়রানি করা হচ্ছে। হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে বিপুল পরিমাণ টাকা। এতে প্রকৃত অপরাধীদের বদলের সাধারণ মানুষ নাজেহাল হচ্ছে। ক্ষেত্র বিশেষে, প্রতিহিংসা চরিতার্থ হচ্ছে। বহুজনকে স্বৈরাচার ও ফ্যাসিবাদের দোসর আখ্যা দিয়ে অত্যাচার করার বিষয়টি গণতান্ত্রিক সমাজের ন্যায়বিচার ও আইনের শাসনের সম্পূর্ণ পরিপন্থী। আইন ও ন্যায়বিচারকে বিকৃত করে মানুষকে নিগৃহীত করার বিষয়টি গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির সঙ্গে মোটেও মানানসই নয়।
একইভাবে, তথ্য ও মত প্রকাশের স্বাধীনতার ক্ষেত্রেও চলছে চরম বাড়াবাড়ি। অবাধে ছড়ানো হচ্ছে ভুল বা অপতথ্য। গুজবকে সত্য বা তথ্য হিসাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে। তথ্যপ্রযুক্তিকে এক্ষেত্রে কাজে লাগাচ্ছে মতলববাজ গোষ্ঠী। এমন কি, বিভিন্ন নামী-দামী সংবাদপত্র ও গণমাধ্যমের মাস্টহেড বা লগো ব্যবহার করে মিথ্যা তথ্য ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে ফটোকার্ডের মাধ্যমে। এহেন অপতৎপরতা তথ্য ও মত প্রকাশের শত্রু এবং সাইবার ক্রাইম। এমন অপরাধী চক্র বর্তমানে বেশ সক্রিয়। প্রায়শ তারা নানা ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের নাম ভাঙিয়ে অপতথ্য প্রচারের অপকর্ম করছে, যার মধ্যে জনপ্রিয় মাল্টিমিডিয়া নিউজপোর্টাল বার্তা২৪.কম'ও আক্রমণের শিকার হয়েছে। জনপ্রিয় পোর্টালগুলোকেই অপরাধীরা বেছে নেয়। বিবিসি, সিএনএন-সহ বাংলাদেশের পাঠকপ্রিয় সংবাদমাধ্যমগুলো বার বার এমন আঘাতের সম্মুখীন হচ্ছে। সন্দেহ নেই, এসব কুকাজ গণতান্ত্রিক উত্তরণকে বিঘ্নিত করবে এবং জনমনে বিভ্রান্তি ও হতাশার সৃষ্টি করে প্রকারান্তরে স্বৈরতন্ত্র ও ফ্যাসিবাদকেই শক্তিশালী করবে।
ফলে সরকার, রাজনৈতিক দল, গণমাধ্যম ও নাগরিক সমাজকে অত্যন্ত সতর্ক থাকতে হবে মহল বিশেষের অপকর্মের বিরুদ্ধে। 'চিলে কান নিয়েছে' শুনেই দৌঁড় দেওয়া যাবে না। পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে প্রকৃত সত্য উদ্ঘাটন করতে হবে। সবচেয়ে নিরাপদ হলো, মূল পোর্টালের ওয়েবপেজ ও ভেরিফাইড ফেসবুকে পেজে গিয়ে সন্দেহজনক সংবাদ বা তথ্য মিলিয়ে নেওয়া। অসঙ্গতি ধরা পড়লে কর্তৃপক্ষের নজরে আনা। প্রয়োজনে পুলিশের সাইবার ক্রাইম বিভাগকে অপতথ্যের বিষয়টি অবহিত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের সুযোগ দেওয়া।
পুলিশের সাইবার ক্রাইম বিভাগকেও তথ্য মন্ত্রণালয় ও গণমাধ্যমগুলোর সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক ও যোগাযোগ রাখা আবশ্যক। যাতে কোনও গুজব, মিথ্যা, ভুল বা অপতথ্যের উৎপত্তি হলে সঙ্গে সঙ্গে সেসবকে স্বপ্রণোদিত হয়ে আইনের আওতায় এনে দমন করা যায়। পুলিশের সাইবার ক্রাইম বিভাগের দক্ষতায় অপতথ্যের তাণ্ডব রোধ করা সম্ভব হবে বলে আশা করা যায়।
সর্বোপরি, একটি বিপ্লবাত্মক পরিস্থিতি পেরিয়ে গণতন্ত্রে উত্তরণের পথে বিরাজমান শত সঙ্কুলতায় মতলববাজদের দ্বারা উদ্ভূত অপতথ্যের তাণ্ডব নানামুখী বিপদ ও অস্থিরতা সৃষ্টি করতে পারে। আর্থসামাজিক, রাজনৈতিক ক্ষেত্রে আনতে পারে অস্থিতিশীলতার ঝুঁকি। অতএব, এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্টদের সজাগ থাকা অপরিহার্য।
ড. মাহফুজ পারভেজ: অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম; প্রফেসর ও চেয়ারম্যান, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও নির্বাহী পরিচালক, চট্টগ্রাম সেন্টার ফর রিজিওনাল স্টাডিজ, বাংলাদেশ (সিসিআরএসবিডি)।