একটি নারকীয় ঘটনা ও আন্তর্জাতিক নারী দিবস?

  • ড. মাহফুজ পারভেজ, অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

মাগুরায় ধর্ষণের শিকার শিশুটির জ্ঞান ফেরেনি এখনও। দুই দিন ধরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (পিআইসিইউ) রাখা হয়েছে তাকে। বৃহস্পতিবার বেলা ১১টা থেকে শিশুটি অচেতন অবস্থায় রয়েছে। শুক্রবার রাতে তাকে লাইফ সাপোর্টে নেওয়া হয়। শনিবার, ঘটনাচক্রে যেদিন আন্তর্জাতিক নারী দিবস, সেদিনও জীবন ও মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে রয়েছে শিশুটি।

৮ মার্চ যখন বাংলাদেশসহ বিশ্বজুড়ে আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালিত হচ্ছে, তখন চিকিৎসকদের বরাত দিয়ে ভুক্তভোগীর একজন স্বজন জানান, শিশুটি এখনও অচেতন। তার জ্ঞান ফেরেনি। চিকিৎসকেরা বলেছেন, আগামী ২৪ ঘণ্টা তাকে পর্যবেক্ষণে রাখা হবে। আট বছরের ছোট্ট এই শিশুটি বুধবার গভীর রাতে বোনের বাড়ি বেড়াতে গিয়ে বাড়িতে ধর্ষণের শিকার হয়। নারকীয় ঘটনায় ক্ষত-বিক্ষত আট বছরের শিশুর চিকিৎসা চলছে হাসপাতালের বিছানায় ।

বিজ্ঞাপন

একাধিক গণমাধ্যম সরেজমিন তথ্য ও পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে জানাচ্ছে, বর্বরোচিত নির্যাতনের শিকার শিশুটি কথা বলছে না। নড়াচড়াও নেই তার। অচেতন অবস্থায় শুয়ে আছে ধর্ষণের শিকার শিশুটি। আর তার পাশে বসে কাঁদছেন মা। সন্তানের এই অবস্থায় তিনি যেন পৃথিবীর সবচেয়ে অসহায় মানুষ। এক হাত দিয়ে মেয়ের মাথা স্পর্শ করছেন, আরেক হাতে নিজের চোখের পানি মুছছেন। মেয়ের করুণ অবস্থা দেখে বারবার মূর্ছা যাচ্ছেন তিনি।

কাকে বিচার দেবে এই অবোধ শিশু ও তার স্তম্ভিত মা? যখন ধর্ষণের প্রধান অভিযুক্ত হলো শিশুটির বোনের শ্বশুর ও স্বামী, যাদের বাড়িতে বেড়াতে গিয়ে অমানবিক বর্বরতার মুখোমুখি হতে হয়েছে শিশুকে। এই জঘন্যতম ঘটনার প্রতিবাদে ফুঁসে উঠেছে সাধারণ মানুষ। অভিযুক্তের শাস্তির দাবিতে বিশাল বিক্ষোভ মিছিল হয়েছে। পরে মাগুরা সদর থানা ঘেরাও করে জনতা।

বিজ্ঞাপন

এমন পাশবিক ঘটনা কেন ঘটলো? আইনের শৈথিল্যের কারণে? নীতি-নৈতিকতার অভাবে? মানবিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ে? নাকি অন্যকোনো কারণে? বিপ্লবোত্তর একটি পরিস্থিতিতে একের পর এক এমনই অগ্রহণযোগ্য ও অকল্পনীয় ঘটনাসমূহ কেন ঘটছে তার অন্তর্নিহিত কারণ চিহ্নিত হওয়া দরকার। তা না হলে আমরা এক অপরাধমূলক সমাজের চৌহদ্দির মধ্যে বন্দি হয়ে পড়বো। আর অকল্পনীয়, পাশবিক, বর্বর, নৃশংস ঘটনাগুলো প্রতিদিনই আমাদের চোখের সামনে ঘটতে থাকবে। আমরা অসহায়ের মতো দেখবো যে, শিশু বা বৃদ্ধা কিংবা নববধূও ধর্ষণের কবল থেকে বাঁচতে পারছে না। স্বামী-সন্তানদের আটক কিংবা জিম্মি করে পালাক্রম ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। ধর্ষণ ছাড়াও চলছে উত্তেজিত মব কর্তৃক গণপিটুনিতে জ্যান্ত মানুষকে প্রকাশ্য দিনেদুপুরে পিটিয়ে মেরে ফেলার ঘটনা। এসব অভাবনীয় ঘটনাগুলো কিসের আলামত? এগুলো কি আইন-শৃঙ্খলার পতন নাকি মনুষ্যত্বের পতন? নাকি সামগ্রিক পরিস্থিতির পতন ও অবক্ষয়ের ফল?

যারা রাষ্ট্র ও সমাজের কর্তাব্যক্তি, তাদেরকে এসব সমস্যার কারণ জানতে হবে। তাহলেই প্রতিকারের ব্যবস্থা নেওয়া যাবে। মানুষ ও সমাজকে বাঁচাতে ও নিরাপদ রাখতে হলে এহেন বর্বরদশা কাটিয়ে উঠতেই হবে। নৃশংসতার অবসান ঘটাতেই হবে। প্রয়োজনে কঠোরতম পন্থায় হলেও এই পাশবিক পরিস্থিতির অবসান ঘটাতেই হবে।

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস যথার্থভাবে বলেছেন, সম্প্রতি নারীদের ওপর যে জঘন্য হামলার খবর আসছে, তা গভীরভাবে উদ্বেগজনক। এটি ‘নতুন বাংলাদেশ’এর যে স্বপ্ন আমরা দেখছি তার সম্পূর্ণ বিপরীত। আমরা এই ‘নতুন বাংলাদেশে’ নারী-পুরুষ সবার সমান অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে অঙ্গীকারাবদ্ধ। আমরা আমাদের সব শক্তি প্রয়োগ করে এই অধিকার প্রতিষ্ঠা করব।

ড. মুহাম্মদ ইউনূস আরো বলেন, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে অংশ নেওয়া নারীরা বিভিন্ন সময়ে আমাকে তাদের সংগ্রাম ও আশা-আকাঙ্ক্ষার কথা জানিয়েছে। আমরা যে নতুন বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন দেখছি, নারীদের অংশগ্রহণ ও তাদের অধিকার নিশ্চিত করা ছাড়া তা সম্ভব হবে না। এই অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য নারীদের সঙ্গে পুরুষদেরও সহযোদ্ধা হয়ে কাজ করতে হবে।

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রধানের এই প্রত্যয় সরকারের সকল সংস্থা ও বিভাগে অনুরণন জাগাতে পারবে বলে আমরা আশা করি এবং এর মাধ্যমে নারকীয় অপরাধের বিরুদ্ধে সরকারি ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের জোরালো পদক্ষেপ দেখা যাবে। অপরাধপ্রবণ মানুষ কিছুটা হলেও ভীত ও সতর্ক হবে। সমাজের অপরাধমুখী গতি কিছুটা হলেও স্তিমিত হবে। প্রয়োজনে কঠোর শাস্তির দৃষ্টান্ত স্থাপন করে অপরাধী ও অপরাধে ইচ্ছুকদের লাল কার্ড দেখাতে হবে।

এইসব জঘন্য অপরাধ আইনের শাসনের জন্য হুমকি। নীতি ও নৈতিকতা ভিত্তিক সমাজ নির্মাণের জন্য প্রতিবন্ধকতা স্বরূপ। নারী ও পুরুষের সম্মিলিত মানবসম্পদ বিকাশের মাধ্যমে দেশকে এগিয়ে নেওয়ার পরিপন্থী। বর্তমানের রোমহর্ষক নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনাগুলোর সঙ্গে সঙ্গে সাম্প্রতিক সময়ের অপরাধের ধারাগুলোকে পর্যালোচনা করা জরুরি। যেমন, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের মতে, ২০২৪ সালে ২,৩৬২ জন নারী ও মেয়ে সহিংসতার শিকার হয়েছে, যার মধ্যে ১,০৩৬ জন শিশু। তাদের মধ্যে ৪৮৬ জনকে হত্যা করা হয়েছে। ২০২৪ সালের প্রথম ১১ মাসে ১৮৬ জন নারী ও মেয়েকে ধর্ষণ করা হয়েছে, গণধর্ষণের শিকার হয়েছে ১৩ জন এবং ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ৩ জনকে।

বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসেই যৌন সহিংসতা ও হয়রানিসহ ১৮৬টি ঘটনা নথিভুক্ত হয়েছে। তবে প্রকৃত সংখ্যা আরও বেশি হতে পারে, কারণ অনেক ঘটনাই রিপোর্ট করা হয় না।

৮ মার্চ বিশ্বজুড়ে আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালিত হয়। ২০২৫ সালের নারী দিবসের প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে, “অধিকার, সমতা, ক্ষমতায়ন: নারী ও কন্যার উন্নয়ন”। কিন্তু বাস্তবতা হলো, বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে প্রতিনিয়ত নারীরা এখনো সহিংসতা, বৈষম্য ও নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান ও ঘটনা পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতার মাত্রা আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে।

আমরা কি নারী ও শিশু নির্যাতনকে সারা বছরের বারোয়ারী ঘটনায় পরিণত করবো এবং আন্তর্জাতিক নারী দিবসকে পর্যন্ত চিহ্নিত করবো নারকীয়, নৃশংস, রোমহর্ষক নানা অপরাধ সংঘটিত হওয়ার দিনে? পতন ও অবক্ষয়ের কোন্ অতলে তলিয়ে যাওয়ার পর আমাদের বোধোদয় হবে, বিবেক জাগবে, মানবিকতা সমুন্নত হবে?

ড. মাহফুজ পারভেজ: অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম; প্রফেসর ও চেয়ারম্যান, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও নির্বাহী পরিচালক, চট্টগ্রাম সেন্টার ফর রিজিওনাল স্টাডিজ, বাংলাদেশ (সিসিআরএসবিডি)।