উপমাতুল্য কর্মবীর: প্রকৌশলী শেখ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ
-
-
|

শুভ কিবরিয়া, ছবি: বার্তাটোয়েন্টিফোর
খুলনার দৌলতপুরে ১৯৩১ সালের ৩১ জুলাই তাঁর জন্ম। বাবার নাম শেখ মুহাম্মদ হানিফ। বাবা দৌলতপুর মুহসীন উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতেন। মায়ের নাম মরিয়ম খাতুন। ছয় ভাই এক বোন। দৌলতপুর মুহসীন উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ১৯৪৬ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় আরবিতে লেটারসহ প্রথম শ্রেণীতে উত্তীর্ণ ।
১৯৪৮ সালে তৎকালীন ব্রজলাল একাডেমী (পরে যার নাম হয় বিএল কলেজ) থেকে ইন্টারমিডিয়েট (সায়েন্স) পরীক্ষায় পূর্ব পাকিস্তান বোর্ডে সম্মিলিত মেধা তালিকায় ১৯তম স্থান অধিকার করেন। ১৯৫০ সালে একই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে ডিসটিংশনসহ বিএসসি পাস কোর্সে উত্তীর্ণ হন। বিএসসি পাস কোর্সে সমগ্র পূর্ব পাকিস্তান বোর্ডের মধ্যে ২য় স্থান লাভ করেন। ওই একই বছর ভর্তি পরীক্ষায় প্রথম হয়ে আহসান উল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ভর্তি হন। ১৯৫৪ সালে আহসান উল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ (বর্তমান বুয়েট) থেকে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ৭৯ শতাংশ মার্কস পেয়ে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হয়ে গোল্ড মেডেলিস্ট হিসেবে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন।
পরবর্তীতে দেশের খ্যাতিমান প্রকৌশলী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন।
প্রকৌশলী শহীদুল্লাহ একজীবনে দুই জীবন যাপন করেছেন। এক তার পেশাগত প্রকৌশলী জীবন। সেখানে তিনি অনন্য মেধায়, অসাধারণ দক্ষতায়, সততা, নিষ্ঠা ও শ্রমে দেশের প্রকৌশলী সমাজের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে নিজেকে আসীন করেছেন। ঢাকা মহানগরসহ দেশের নানা প্রান্তে গুরুত্বপূর্ণ অনেক বৃহৎ সরকারি ও বেসরকারি স্থাপনার স্ট্রাকচারাল স্ট্রেন্থ গড়ে উঠেছে প্রকৌশলী শহীদুল্লাহর মেধা ও মননে। আজও দেশের যে কোনো জায়গায় যে কোনো ভবনে, যে কোনো বড় স্থাপনায় ফাটল ধরলে, বিপন্ন হলে তার প্রকৌশলগত সুরক্ষায় শেষ ভরসার দেশি মানুষ হলেন প্রকৌশলী শহীদুল্লাহ।
তাঁর প্রতিষ্ঠিত প্রকৌশল উপদেষ্টা প্রতিষ্ঠান ‘শহীদুল্লাহ অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটস’ এক সময় দেশের শীর্ষ প্রকৌশল প্রতিষ্ঠানের মর্যাদা পেয়েছে। রেট্রোফিটিং কৌশল উদ্ভাবন করে শহীদুল্লাহ অ্যান্ড এসোসিয়েটস দেশজুড়ে এক নির্ভরতার অগ্রপথিক হয়ে দাঁড়িয়ে গেছে। যে কোনো পুরানো বিল্ডিংয়ের পরিসর বাড়াতে হবে, অথচ বিল্ডিং ভাঙা পড়বে না, বিল্ডিংয়ের স্থাপনাগুলোর কোনো ক্ষতি করা যাবে না, ব্যবহারকারীদের অসুবিধা ঘটানো যাবে না- এর জন্য অন্যতম ভরসা দেশের সেরা প্রকৌশলীদের একজন শেখ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ। ঢাকা স্টেডিয়ামসহ দেশের অনেক ছোট বড় স্থাপনায় শেখ মুহম্মদ শহীদুল্লাহ এ কৌশল প্রয়োগ করেছেন সফলতার সঙ্গেই। পরবর্তীতে তাঁর বানানো নতুন প্রতিষ্ঠান ‘শহীদুল্লাহ অ্যান্ড নিউ অ্যাসোসিয়েটস’। আজও সেই প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার তিনি।
একজীবনে শেখ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ ৬৫ বছরের পেশাগত অভিজ্ঞতা সমৃদ্ধ, তার ফিল্ডে দেশের সেরা প্রকৌশলী। অন্য জীবনে শেখ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ দেশের তেল-গ্যাস-খনিজসম্পদ বিদ্যুৎবন্দর রক্ষার আন্দোলনে উৎসর্গীকৃত। দেশের সক্ষমতায় জনগণের মালিকানায় এ সম্পদ রক্ষা পাবেÑ সেই আন্দোলনের নিবেদিতপ্রাণ-কর্মী , নেতাও তিনি।
বামপন্থি দলগুলো আদর্শগত, রাজনৈতিক নানা মত-পার্থক্যে নিজেদের মধ্যে নানা দূরত্ব তৈরি করলেও শেখ মুহম্মদ শহীদুল্লাহকে কেন্দ্র করে তেল-গ্যাস খনিজ সম্পদ রক্ষার আন্দোলনে নিজেদের সংঘবদ্ধ রেখেছে। দেশের বৃহত্তর স্বার্থে শেখ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ সেই ঐক্য এবং সংগ্রামের দিকচিহ্ন হয়ে আছেন।
নিজে এখনো কোনো রাজনৈতিক দলের প্রত্যক্ষ সদস্য নন। কিন্তু বামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি সহানুভূতিশীল। এ সহানুভূতি শুধু দার্শনিক, আদর্শিক, বুদ্ধিবৃত্তিক নয়, আর্থিকও বটে। এখনও প্রতি মাসে তিনি নিজে যা আয় করেন, তার তিন ভাগের দুই ভাগ এ কাজে ব্যয় করেন। বহু বছর ধরেই এ আর্থিক প্রণোদনা জুগিয়ে আসছেন সমাজ পরিবর্তনের কাজে নিবেদিত রাজনৈতিক ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক দল, ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠানগুলোকে।
দুই.
প্রকৌশলী শহীদুল্লাহকে একবার জিজ্ঞেস করেছিলাম আপনার শক্তির জায়গাটা কি? প্রকৌশলী শেখ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ হাসতে হাসতে বললেন, আমি বিবেকানন্দের সেই লাইনটাকে খুব পছন্দ করি, ‘জীবে প্রেম করে যেই জন, সেই জন সেবিছে ঈশ্বর’।
পাল্টা প্রশ্ন করলাম পুনর্জন্ম হলে আবার কি প্রকৌশলী শহীদুল্লাহ-ই হতে চান? খুব জোর দিয়েই বললেন ওসবে বিশ্বাস নেই। তবে আমি বিশ্বাস করি পেশাগত জীবনে যা করেছি তা ট্যানজিবল, দেখা যায়। সেদিক দিয়ে পেশা হয়ত ওটাই নিতাম। আর রাজনৈতিক ধ্যান-ধারণায় এখন যে অবস্থানে আছি সেটায় জীবনে আরও আগে থেকে আসা উচিত ছিল। একটু দেরি হয়ে গেছে। ১৯৬৫ সালে আমি যখন কমিউনিস্ট ভাবধারায় দীক্ষিত হই তখন আমার বয়স ৩৪ বছর।
ছাত্ররাজনীতি করিনি। কিন্তু আমাদের সময় যারা যারা কমিউনিস্ট ছাত্র ছিলেন তারা যে আমাকে রাজনীতির কথা বলেননি তা নয়। আমি তো ভালো ছাত্র ছিলাম। তাই রাজনীতিতে দেরিতে এসেছি! পরের বার জন্মালে এই ভুল আর হবে না। আরও কম বয়সেই রাজনীতিতে জড়াবো। কনস্ট্রাকশন বিজনেসে গিয়ে পেশাগত জীবনেও কিছু পণ্ডশ্রম হয়েছে। ওটাতে যদি না যেতাম তাহলে খুব ভালো হতো। সে বিবেচনায় সিভিল ইঞ্জিনিয়ারই হতে চাইতাম। রাজনৈতিক ধ্যান-ধারণায় এখন যা আছি তাই থাকতাম। তবে আরও আগে জড়াতাম।
জানতে চাইলাম, এই যে এত কিছুর মধ্যে জড়িয়ে আছেন, হতাশা আসে না? প্রকৌশলী শহীদুল্লাহ তার বিখ্যাত হাসিটা ধরে রেখেই বললেন, হতাশা জিনিসটা যে কোনো মানুষেরই পুরোপুরি ত্যাগ করা উচিত। এরপর মহাভারতের কাহিনী টেনে বললেন, অর্জুন শ্রীকৃষ্ণকে জিজ্ঞেস করছে , ‘আমরা কি এই কুরুপাণ্ডবের যুদ্ধে জিতব? আপনি কি আশাবাদী?’ শ্রীকৃষ্ণ বলল, ‘বাছা কর্মে তোমার অধিকার। ফলে অধিকার নাই।’
আমি মনে করি যে, কর্ম করে যাওয়াতেই আমার আনন্দ। ফল কতদূর লাভ হলো, কি হলো না, সে সম্পর্কে পুরোপুরি নিস্পৃহ, উদাসীন থাকা উচিত। একজন মানুষ সৎকর্মে নিয়োজিত থাকলে তা থেকেই সে আনন্দ পাবে। এটাই তার ফল লাভ। অন্য কি কি লাভ হলো তার হিসেবের কোনো দরকার নেই। আনন্দবোধটা আমাদের কর্মের থেকে আসবে, ফলের থেকে নয়। অতএব হতাশার কোনো প্রশ্ন আসবে না।
তিন.
প্রকৌশলী শেখ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ পুরো জীবনে এই বিশ্বাস কর্মে পরিণত করেছেন। সহজ সরল অনাড়ম্বর অথচ কঠিন, কঠোর, আপসহীন দৃঢ়তায় জীবনরথ নিজের হাতে চালিয়েছেন। খুলনার দৌলতপুরের এক শহরতলি থেকে দারিদ্র্য আর কঠোর জীবন সংগ্রামকে উতরে তেল-গ্যাস রক্ষা কমিটির প্রাণপ্রদীপ হয়ে দেশের মানুষের একটা বড় অংশের আশা-আকাঙ্ক্ষার উৎস হয়ে আছেন।
সমাজবদলের আন্দোলনে নিবেদিত. সৎ, পরিশ্রমী যে কোনো অচেনা তরুণ, কিশোর, প্রৌঢ়, বৃদ্ধ মানুষের জন্য অবারিত হৃদয় নিয়ে নিজের দরজা খুলে রেখেছেন বহুকাল।
শেখ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ - সমাজ বদলের লড়াইয়ে রত তরুণ সমাজের একটা বড় অংশের কাছে প্রেরণা আর ভালোবাসাময় শ্রদ্ধার ‘শহীদুল্লাহ ভাই’ হয়ে আছেন।
প্রকৌশলী শহীদুল্লাহর আরেকটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য নিজের চিন্তা এবং বিশ্বাস প্রকাশে তিনি অকপট। কারও কাছে মাথা নোয়াবার মানুষ তিনি নন। প্রয়োজনে মুখের ওপর তাঁর মতো করে সত্য প্রকাশে তিনি কখনই কুণ্ঠিত হন নাই। পাকিস্তানি জমানায় বামপন্থি বিশ্বাসের অপরাধে তাঁকে রিমান্ডে নিয়ে গিয়ে সামরিক গোয়েন্দারা অকথ্য নির্যাতন করেছে কিন্তু তাঁকে একচুলও টলাতে পারে নাই। তিনি জেল খেটেছেন, জেলে থাকা অবস্থায় তাঁর পরিবার অবর্ণনীয় দুর্দশায় পড়েছে কিন্তু তাঁর চিন্তাগত অবস্থানের কোন পরিবর্তন হয় নাই। পরিশ্রমী, জনস্বার্থে নিবেদিত, প্রকৌশল পেশায় সমুজ্জ্বল এই মানুষটির ক্ষুরধার মস্তিষ্ক এখনো সবলভাবেইসক্রিয়। মানুষের অগ্রগতির ধারায়, প্রগতির লড়াইয়ে তাঁর সমর্থন ও সক্রিয়তা এখনো অবিরল।
৩১ জুলাই ২০১৯ তিনি ৮৮ বছর পার করছেন। এই কর্মবীর, অসাধারণ মেধাবী, জনস্বার্থে নিবেদিত মানুষটিকে জানাই জন্মদিনের ভালোবাসা।
শুভ কিবরিয়া: নির্বাহী সম্পাদক, সাপ্তাহিক