নির্বাচন ঘিরে রাজনীতির বাগযুদ্ধ কি সংঘাতে গড়াচ্ছে?

, রাজনীতি

নিউজ ডেস্ক, বার্তা২৪.কম | 2025-03-08 15:16:27

দেড় দশকের শাসন ক্ষমতার পালাবদল ঘটাতে জুলাই-আগস্টের আন্দোলনে তৎকালীন ক্ষমতাসীনদের বাইরে বাকী রাজনৈতিক শক্তির এক নিরঙ্কুশ ঐক্য সৃষ্টি হয়েছিল। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনে পর অন্তর্বর্তী সরকারের সাত মাসে সেই ঐক্য এখন অনেকটাই ফিঁকে হয়ে গেছে।

দ্রুত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রশ্নে কেবল বিভক্তিই নয়, দাবি আদায়ে প্রতিক্রিয়াশীল রাজনৈতিক শক্তির সঙ্গে ভিন্ন মেরুতে থাকা দলের বাগযুদ্ধ এখন অনেকটাই সংঘাতে পর্যবসিত। বর্তমানে দৃশ্যপটে থাকা দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি সংস্কারের নামে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কোন রকম বিলম্ব মানতে রাজি নয়। নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণার দাবির প্রতি কর্ণপাত না করে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টাদের অস্পষ্ট বক্তব্য এবং আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া তরুণদের নতুন জাতীয় নাগরিক পার্টি ও জামায়াতে ইসলামী সংস্কারের প্রশ্নে অনড় থাকায় রাজনৈতিক বিভক্তি এখন দিনকে দিন প্রকট হচ্ছে।

রমজানে ইফতার রাজনীতিতে অন্য কর্মসূচি সীমিত থাকলেও ঈদের পর বিএনপি ও সমমনা দলগুলির রাজপথে কঠোর আন্দোলনে সরব হওয়ার আভাস দিয়েছে। বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আবদুল মঈন খান গণমাধ্যমকে বলেছেন, অবিলম্বে নির্বাচন দিতে হবে। সংস্কার একটি চলমান প্রক্রিয়া। সেজন্য সংস্কার সংস্কার বলে সময়ক্ষেপণ করে নির্বাচন দীর্ঘায়িত করা বিএনপি মানবে না।

সরকারকে নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণায় এক মাসের আলটিমেটাম দিয়ে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেছেন, এ সময়ের মধ্যে দাবি মানা না হলে জোটসঙ্গীদের নিয়ে পরবর্তী করণীয় ঠিক করা হবে।

নির্বাচন ঘিরে সরকারের কর্মকাণ্ডে সন্দেহ তৈরি হচ্ছে জানিয়ে বিএনপি নেতারা বলছেন, সংস্কারের কথা বললেও তারা নির্বাচন পেছানোর পাঁয়তারা করছে। সরকার নতুন দলের (এনসিপি) এজেন্ডা বাস্তবায়নে ব্যস্ত। ‘কম সংস্কার হলে ডিসেম্বরে ভোট আর বেশি সংস্কার হলে জুনে ভোট’-প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনুসের এমন মন্তব্যকেও বিবেচনায় নিচ্ছেন তারা।

নির্বাচন নিয়ে গড়িমসি গ্রহণযোগ্য নয়-মন্তব্য করে গতকাল এক অনুষ্ঠানে বিএনপি’র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, নির্বাচন কমিশন যদি সঠিকভাবে কাজ করে তবে ডিসেম্বর কেন জুন-জুলাইয়ের মধ্যে নির্বাচন সম্ভব। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যাতে সরকারের বাহিনী হয়ে জনগণের ওপর অত্যাচার করতে না পারে সেই সংস্কারগুলো করতে কতক্ষণ সময় লাগে।

নির্বাচনের বাইরে যারা এসব অপ্রয়োজনীয় ইস্যুকে সামনে এনে নির্বাচনে দীর্ঘসূত্রতার সৃষ্টি করতে চায়, তাদের ঘিরেই সন্দেহ বিএনপির নীতিনির্ধারক মহলে। এ জন্যই দ্রুত নির্বাচন ও নির্বাচনি রোডম্যাপ দাবি করেছে তারা। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকারের কার্যক্রমে জাতীয় নির্বাচন দীর্ঘায়িত করার চেষ্টা দেখছেন বিএনপির নীতিনির্ধারকরা। কতিপয় উপদেষ্টার কথাবার্তায়ও নির্বাচনবিরোধী গন্ধ ছড়াচ্ছে বলেও মনে করেন তারা।

নির্বাচন ও বিএনপিবিরোধী এসব ষড়যন্ত্র যাতে কোনোক্রমেই সফল হতে না পারে, সে জন্য বিএনপি যৌক্তিক সময়ে নির্বাচনের দাবিতে ধীরে ধীরে হার্ডলাইনে যাবে বলে জানান তারা।

ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের ইফতার অনুষ্ঠানে গতকাল দলটির আমির ও চরমোনাই পীর মুফতি সৈয়দ মুহাম্মাদ রেজাউল করীম বলেছেন, সংবিধান, নির্বাচন কমিশন, জনপ্রশাসন, পুলিশ, দুদক ও বিচার বিভাগের সংস্কার জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এসব ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সংস্কার না হলে আগের তিমিরে ফেরত যাওয়ার আশঙ্কা থেকে যাবে। তাই এসব ক্ষেত্রে সংস্কার হতেই হবে।

তিনি মনে করেন, জাতীয় নির্বাচনে সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতি অনুসরণ করা হলে রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তন আসবে এবং কার্যকর ও যথাযথ প্রতিনিধিত্বশীল পার্লামেন্ট গঠিত হবে।

অন্যদিকে, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)-এর আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম শুক্রবার দলের অস্থায়ী কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর মানুষের মধ্যে পরিবর্তন এবং ন্যায়বিচারের আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছে। মানুষের এ দুই আকাঙ্ক্ষা পূরণের নিশ্চয়তা তৈরি করে নির্বাচনের পথে হাঁটতে হবে। সংস্কার এবং ন্যায়বিচারের দৃশ্যমান অগ্রগতির ওপর নির্ভর করছে নির্বাচন কবে হবে।

বিএনপি ও সমমনাদের সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকার ও ছাত্র নেতৃত্বের মতানৈক্য কতটা তীব্র তা আঁচ করা যাবে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সাম্প্রতিক এক বক্তব্যে। তিনি বলেছেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকার যদি নিরপেক্ষ না থাকে, তাহলে নির্বাচনের সময়ে একটা নিরপেক্ষ সরকার দরকার হবে।’

মির্জা ফখরুলের এই বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় এনসিপি’র আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেছেন, বিএনপি মহাসচিবের নিরপেক্ষ সরকারের দাবি মূলত আরেকটা ১/১১ সরকার গঠনের ইঙ্গিত বহন করে।

তবে এমন বাদানুবাদের মধ্যেই দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্ষিপ্তভাবে এনসিপি ও তাদের সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদের সঙ্গে বিএনপি’র অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীদের সহিংস সংঘাতের বেশ কিছু ঘটনা ঘটেছে। অবস্থাদৃষ্টে প্রতীয়মান হচ্ছে, চলমান বাগযুদ্ধ ও বিক্ষিপ্ত সংঘাত পরবর্তীতে বৃহৎ সংঘাতে পর্যবসিত হতে পারে।

এমন পরিস্থিতিতে দ্রুত নির্বাচন দেয়াই এ সরকারের কর্তব্য হবে বলে মনে করেন প্রবীণ গবেষক ও সমাজচিন্তক বদরুদ্দীন উমর। তিনি বলেন, ‘তা না হলে এ সরকার যে অবস্থায় আছে, তারা বেশি কিছু করতে পারবে না। আর যতই দিন যাবে, তাদের জনপ্রিয়তা হ্রাস হবে।’

এ সম্পর্কিত আরও খবর