অন্ধকারে মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন
-
-
|

ছবি: সংগৃহীত
`বনলতা সেন’ছাড়াও মহত্তম কবি জীবনানন্দ দাশের কবিতায় আরও অনেক নায়িকার দেখা পাওয়া যায়। তবে বনলতা সেনের মতো এতো বহুল পঠিত ও আলোচিত আর কেউ হন নি। জীবনানন্দ দাশ আর বনলতা সেন একাকার হয়ে আছেন। কল্পিত নাটোরের কল্পিত এই নারী কুহেলিকার মতো বিচ্চুরিত জীবনানন্দের কাব্যজগতের নানা বাঁকে।
জীবনানন্দের স্মরণীয় কবিতা ‘বনলতা সেন’ (এই নামেই রয়েছে তাঁর কাব্যগ্রন্থ) খুব দীর্ঘ নয়, মাত্র আঠারো লাইনের। ছয় লাইনের তিনটি স্তবকের পরিসীমায় রচিত কবিতায় তিন বার বনলতা সেনের কথা উল্লেখ হয়েছে: ১. ‘আমারে দুদণ্ড শান্তি দিয়েছিলো নাটোরের বনলতা সেন’, ২. ‘পাখির নীড়ের মত চোখ তুলে নাটোরের বনলতা সেন’, ৩. ‘থাকে শুধু অন্ধকার, মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন’। প্রতিটি স্তবকের শেষে বনলতা সেন উদ্ধৃত হয়েছেন কবির কাব্যভাষ্যে।
বনলতা সেন" কবিতাটি প্রথম প্রকাশ করেছিলেন কবি বুদ্ধদের বসু তাঁর 'কবিতা' পত্রিকায়। ১৯৩৫ সালের ডিসেম্বরে প্রকাশিত কবিতা পত্রিকার পৌষ, ১৩৪২ সংখ্যার মাধ্যমে বনলতা সেন সর্বপ্রথম পাঠকের হাতে এসে পৌঁছায়। জীবনানন্দ দাশ বাংলা ১৩৪৯, ইংরেজি ডিসেম্বর ১৯৪২ সালের প্রকাশিত তাঁর বনলতা সেন নামক তৃতীয় কাব্যগ্রন্থে কবিতাটি অন্তর্ভুক্ত করেন। কবিতা-ভবন কর্তৃক প্রকাশিত "এক পয়সায় একটি" গ্রন্থমালার অন্তর্ভুক্ত হিসেবে। প্রকাশক ছিলেন জীবনানন্দ দাশ নিজেই। ১৬ পৃষ্ঠার প্রথম সংস্করণে কবিতা ছিল মোট ১২টি। প্রথম সংস্করণের প্রচ্ছদ করেছিলেন শম্ভু সাহা। পরবর্তীকালে জীবনানন্দ দাশ ১৯৪৪ সালে প্রকাশিত তাঁর চতুর্থ কাব্য 'মহাপৃথিবী'তে উক্ত বনলতা সেন কাব্যগ্রন্থের সকল কবিতাই অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন। অর্থাৎ ‘‘মহাপৃথিবী’’ কাব্যগ্রন্থেরও প্রথম কবিতা ছিল ’বনলতা সেন’
কবির জীবদ্দশায় বাংলা শ্রাবণ, ১৩৫৯, ইংরেজি ১৯৫২ সালে কলকাতার সিগনেট প্রেস থেকে বনলতা সেন কাব্যগ্রন্থের দ্বিতীয় সংস্করণটি প্রকাশিত হয়। ৪৯ পৃষ্ঠার বর্ধিত কলেবরে প্রকাশিত সংস্করণে আগের ১২টি কবিতার সাথে আরও ১৮টি কবিতা যোগ করে মোট ৩০টি কবিতা প্রকাশিত হয়। এই সংস্করণের প্রচ্ছদ করেছিলেন সত্যজিৎ রায় ও মূল্য ছিল ২ টাকা। সিগনেট সংস্করণের প্রকাশক ছিলেন দিলীপকুমার গুপ্ত।
পরবর্তীতে ১৯৫৪ সালের মে মাসে প্রকাশিত জীবনানন্দ দাশের শ্রেষ্ঠ কবিতাগ্রন্থটিতেও কবিতাটি সংকলিত হয়। এছাড়া আবু সায়ীদ আইয়ুব এবং হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের যৌথ সম্পাদনায় ১৯৩৯ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত আধুনিক বাঙলা কবিতা শীর্ষক গ্রন্থেও কবিতাটি সঙ্কলিত হয়েছিল। কলকাতার জাতীয় সুরক্ষিত পাণ্ডুলিপিসমূহের ১৯৩৪ সালে চিহ্নিত ৮ নং খাতায় এ কবিতাটি আছে। তাই, পাণ্ডুলিপির হিসেবে, ১৯৩৪ সালে কবিতাটি লিখিত হয়েছিল বলে প্রতীয়মান হয়।
আপাত দৃষ্টিতে 'বনলতা সেন' একটি প্রেমের কবিতা যার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে বনলতা সেন নাম্নী কোনও এক রমণীর স্মৃতি রোমন্থন। শুরু থেকেই পাঠকের কৌতূহল বনলতা সেন কী বাস্তবের কোনো নারী নাকি সম্পূর্ণ কল্পিত একটি কাব্যচরিত্র। এমত প্রশ্নও উঠেছে যে, ‘কে এই বনলতা সেন?’
কোনও কোনও গবেষকের মতে, ‘তিনি জীবনানন্দের এক খুড়তুতো বোন ছিলেন। তাঁর প্রতি দুর্বল ছিলেন উনি। কিন্তু সম্পর্ক গড়ার সাহস পাননি। তাঁর ছায়াতেই তিনি বনলতা সেন লিখেছিলেন।’ আবার জীবনানন্দের ডায়রিতে ‘ওয়াই’ বর্ণ সংকেতে এক নারীর প্রসঙ্গ পাওয়া যায়। এ তথ্যের টীকায় সম্পাদক কবি-গবেষক ভূমেন্দ্র গুহ জানিয়েছিলেন, ‘এই ‘ওয়াই’ জীবনানন্দের খুড়তুতো বোন বুলুর (কমলা দাশগুপ্তের) বান্ধবী। বরিশালেই তাঁকে চিনতেন জীবনানন্দ। অন্তত ১৯৩১-৩২ পর্যন্ত তিনি অনেকখানি মন জুড়ে আছেন জীবনানন্দের।’
তবে বনলতা কে, সে বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে সব সময়েই মুচকি হেসেছেন জীবনানন্দ। কোনও উত্তর দেননি। বোধহয় জীবনানন্দ চাইতেন না তাঁর ভিতরের নির্জন স্থানটি বা নিভৃত চরিত্রটি কোনও ভাবে উপদ্রুত হোক। কারণ তাঁর অন্তঃস্থলে যেখানে আস্তে আস্তে জন্ম নিচ্ছে ‘ঝরা পালক’, ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’, ‘বনলতা সেন’, ‘মহাপৃথিবী’, ‘রূপসী বাংলা’র কবিতারা। তখনই জীবনানন্দের মধ্যে জন্ম নিয়েছিল ধানসিড়ি নদী, নীল হাওয়ার সমুদ্র, শব্দহীন জ্যোৎস্নারা! আর জন্মেছিলেন বনলতা সেন।
কবির সেই নির্জন ভূমিই প্রথম আক্রান্ত হয় কলকাতা সিটি কলেজে অধ্যাপনাকালে। কর্মজীবনের পাশাপাশি সাহিত্য পত্রপত্রিকায় লেখার শুরু মোটামুটি এই সময়েই। ১৯২৭ সালে প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘ঝরা পালক’ প্রকাশিত হল। শুরু বিতর্কেরও। তাঁর কবিতায় অশ্লীলতা আছে— এই অভিযোগে তাঁর সিটি কলেজের চাকরি যায়, এমন একটা বহুল প্রচারিত মত আছে।
বনলতা সেন কবিতাটি প্রকাশের সময় সিটি কলেজে টিউটরের চাকুরি হারিয়ে বেকার জীবনানন্দ সম্পূর্ণ নিঃস্ব অবস্থায় কলকাতায় দিনাতিপাত করছিলেন। এ ঘটনার মাত্র কয়েক বৎসর আগে তাঁর বিয়ে হয়েছিল। স্ত্রী'র সাথেও ছিল না বনিবনা।
বনলতা সেন ছাড়াও জীবনানন্দের কাব্যে বেশ কিছু নারী চরিত্রের উপস্থিতি আছে; যেমন শ্যামলী, সুরঞ্জনা, সুচেতনা, সরোজনী, শেফালিকা বোস, সুজাতা ও অমিতা সেন। তবে ১৯৩২ সালে লিখিত এবং প্রায় অর্ধশতাব্দীকাল অন্তরালবাসী কারুবাসনা নামীয় উপন্যাসে প্রথম 'বনলতা সেন' নামটি পাওয়া যায়। অধিকন্তু 'হাজার বছর ধরে খেলা করে', 'একটি পুরোনো কবিতা' এবং 'বাঙালি পাঞ্জাবী মারাঠি গুজরাটি' শীর্ষক আরও তিনটি কবিতায় এ নামটি আছে। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যেতে পারে যে কারুবাসনা উপন্যাসটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৮৬ সালে, কবির মৃত্যুর বহুকাল পর। এর ভাষা-ভঙ্গিতে অনবগুণ্ঠিত আত্মজৈবনিকতা সেকালের পাঠক মনে বিশেষ কৌতূহলের উদ্রেক করেছিল। বনলতা সেন রক্ত মাংসের কোনও মানবী না-কি নিছকই কল্পিত কোনও কবিতাশ্রিত নারী এ প্রশ্নটি অবসিত না-হলেও রহস্যের কিনারা হয়েছে কিছু।
২০০৭ সালে জীবনানন্দের পাণ্ডুলিপি উদ্ধারক ডা. ভূমেন্দ গুহ কবির 'লিটেরেরি নোটস' গবেষণা করে জানিয়েছেন যে কবির জীবনে প্রেম এসেছিল সন্দেহ নেই। দিনলিপি বা লিটেরেরি নোটস-এ ওয়াই (Y) হিসেবে উল্লিখিত মেয়েটিই কবির কাঙ্ক্ষিত নারী। বাস্তবে সে শোভনা - কবির এক কাকা অতুলান্ত দাশের মেয়ে -- যার ঘরোয়া নাম বেবী। ১৯৩০ খ্রিষ্টাব্দে লাবণ্য দাশকে বিয়ের আগেই এই বালিকার প্রতি যুবক জীবনানন্দ গভীর অনুরাগ অনুভব করেছিলেন। একটি উপন্যাসে শচী নামেও একে দেখতে পাওয়া যায়। শোভনাকে নিয়ে জীবনানন্দের অনুরাগ উন্নীত হয়েছে অনুক্ত প্রেমে; লাবণ্য দাশের সঙ্গে দাম্পত্যজীবন আদৌ সুখকর না-হওয়ায় এই প্রেম তীব্রতর হয়ে ক্রমশ এক প্রকার অভিভূতিতে পর্যবসিত হয়েছিল। বরং কবির জীবনের পুরোটা ব্যাসার্ধ জুড়ে আলো ও অন্ধকারের রহস্যময় পটভূমিকায় যে নারীকে দেখতে পাওয়া যায়, তিনি অন্য কেউ নন, বনলতা সেন।