অফিসে কাদের-চুন্নু, গুরুত্ব দিচ্ছেন না আল্টিমেটাম
-
-
|

ছবি: বার্তা ২৪.কম
বিক্ষোভের দিনে অফিসে না এলেও দ্বিতীয় দিন অফিস করেছেন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদের ও মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু। চেয়ারম্যান দুপুরের দিকে ঘণ্টা খানেক সময় আর মহাসচিব ঘণ্টা দু’য়েক অফিসে অবস্থান করেন।
এদিনও বিপুল সংখ্যক পুলিশ সদস্য মোতায়েন দেখা গেছে। বিকেল বেলাতেও ২৮ জন পুলিশ সদস্য ও বিভিন্ন গোয়েন্দা বাহিনীর সদস্যদের তৎপরতা লক্ষ্য করা গেছে। জাতীয় ছাত্র সমাজ সভাপতি আল-মামুনের নেতৃত্বে বেশকিছু কর্মীর সরব উপস্থিতি দেখা গেছে। পাশাপাশি উত্তরাসহ বিভিন্ন এলাকা থেকেও লোকজন আনা হয় অফিসে। তাদের জন্য দুপুরে প্যাকেটে বিরিয়ানী সরবরাহ করা হয়।
দিনের সবচেয়ে চমক হচ্ছে গতকাল বিক্ষোভ প্রকাশের সময় যারা উপস্থিত ছিলেন তাদের মধ্যে দু’জন প্রেসিডিয়াম সদস্য ও দু’জন যুগ্ম মহাসচিব আজও উপস্থিত ছিলেন। বনানী অফিসে এলে তারাই নাকি চেয়ারম্যানকে স্বাগত জানান। তাদের মধ্যে ছিলেন জাতীয় পার্টির নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সদস্য সচিব প্রেসিডিয়াম সদস্য জহিরুল ইসলাম জহির। তিনি ১০ জানুয়ারি বিক্ষোভের সময় বক্তৃকা দিয়ে নির্বাচনকালীন অব্যবস্থাপনা তুলে ধরেছিলেন।
জাতীয় পার্টির ইতিহাসে গত ১০ জানুয়ারি নজিরবিহীন ঘটনার সাক্ষী হয়েছে নেতাকর্মীরা। পার্টির চেয়ারম্যানের কার্যালয় বনানীতে দিনভর বিক্ষোভ করেন কয়েক শতাধিক নেতাকর্মী। তাদের মধ্যে কো-চেয়ারম্যান, বেশ কয়েকজন প্রেসিডিয়াম সদস্যসহ সিনিয়র অনেক নেতা অংশ নেন। পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদের ও মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নুর পদত্যাগের দাবিতে বিক্ষোভ করেন। বিক্ষুব্ধ নেতারা আসতে শুরু করেছিলেন বেলা ১১টা থেকে। বিকেল ৩টার দিকে ৪৮ ঘণ্টার আল্টিমেটাম দিয়ে ফিরে যান। তাদের আগমনের খবরে আগেই মূল ফটক বন্ধ করে দেওয়া হয়।
বেলা সোয়া ১১টার দিকে ঢাকা মহানগর উত্তর জাতীয় পার্টির সভাপতি শফিকুল ইসলাম সেন্টু, প্রেসিডিয়াম সদস্য ও অতিরিক্ত মহাসচিব সাইদুর রহমান টেপা, প্রেসিডিয়াম সদস্য জহিরুল আলম রুবেল, যুগ্ম মহাসচিব ফখরুল ইসলাম শাহজাদা পুলিশের নিরাপত্তা বেষ্টনী ভেদ করে মূল ফটকের ভেতরে প্রবেশ করেন। পরে পুলিশ তাদের সঙ্গে কথা বলে বাইরে নিয়ে যান। গেটের বাইরে রাস্তার উপর বিক্ষোভ করেন বিক্ষুব্ধ নেতাকর্মীরা।
বিক্ষোভ ও আল্টিমেটাম প্রসঙ্গে জাতীয় পার্টির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু সাংবাদিকদের বলেছেন, তাদের আল্টিমেটাম কোন গুরুত্ববহন করে না। আমরা আল্টিমেটাম নিয়ে ভাবছি না।
অন্যদিকে জাতীয় পার্টির বিক্ষুব্ধ নেতারা ১৪ জানুয়ারি তৃণমূল নেতাদের সভা আহ্বান করেছেন। রাজধানীর আইডিইবি ভবনে ওই সভা আহ্বানে তথ্য বার্তা২৪.কমকে নিশ্চিত করেছেন প্রেসিডিয়াম সদস্য সুনীল শুভরায়।
তিনি বার্তা২৪.কমকে বলেন, আমরা ৪৮ ঘণ্টার আল্টিমেটাম দিয়েছি, এই আল্টিমেটামের মেয়াদ শেষ হবে ১২ জানুয়ারি। আমরা চেয়েছিলাম ১৩ জানুয়ারি পরবর্তী সভা করে সিদ্ধান্ত নিতে। কিন্তু হলরুম না পাওয়ায় সভাটি ১৪ জানুয়ারি করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। সেখান থেকেই পরবর্তী করণীয় নির্ধারণ করা হবে।
জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য ও অতিরিক্ত মহাসচিব লিয়াকত হোসেন খোকা বার্তা২৪.কমকে বলেছেন, জাতীয় পার্টির ইতিহাসে এমন বিক্ষোভ নজিরবিহীন। পার্টির চেয়ারম্যান ও মহাসচিবের বিরুদ্ধে আগে কখনও এমন বিক্ষোভের ঘটনা ঘটেনি। গত নির্বাচনে পার্টির কোন ভূমিকা দেখা যায় নি। এ কারণে নির্বাচনে দলের ভরাডুবি ঘটেছে।
তিনি বলেন, ভোটের সময় আমি নিজে দফায় দফায় ফোন দিলেও পার্টির চেয়ারম্যান রিসিভ করেনি। অনেক কো-চেয়ারম্যানের সঙ্গে একই আচরণ করেছে। প্রার্থীদের কোন রকম সহযোগিতা করা হয়নি। তাদের ব্যর্থতার জন্য পার্টির এই ভরাডুবি। যে কারণে আমরা তাদের পদত্যাগ চাই।
এবারের নির্বাচন নিয়ে শুরু থেকেই ধোঁয়াশাচ্ছন্ন ছিল জাতীয় পার্টির ভূমিকা। নির্বাচনে অংশগ্রহণ প্রসঙ্গে দলটির অবস্থান ছিল রহস্যজনক। ইলেকশন কমিশন ১৫ নভেম্বর তফসিল দিলেও নির্বাচন প্রশ্নে পার্টির অবস্থান ঝুলে রাখা হয় ১৯ নভেম্বর পর্যন্ত। ২০ নভেম্বর দলীয় মনোনয়ন ফরম বিতরণ শুরু করলেও নির্বাচনে অংশগ্রহণের বিষয়টি তখনও অন্ধকারে রাখা হয়।
মনোনয়ন ফরম বিক্রির দিনগুলোতে পার্টির পক্ষ থেকে বলা হয় নির্বাচন প্রক্রিয়া এগিয়ে রাখা হচ্ছে, জাপা নির্বাচনে অংশ নেবে কিনা পরে জানানো হবে। অবশেষে ২২ নভেম্বর নির্বাচনে অংশ নেওয়ার কথা জানান দলটির মহাসচিব। ২৭ নভেম্বর ২৯৪ আসনে দলীয় প্রার্থীদের তালিকা প্রকাশ করে। অন্যদিকে ছেলে সাদ এরশাদসহ অনুসারিদের আসন নিশ্চিত না হওয়ায় জাতীয় পার্টির প্রধান পৃষ্ঠপোষক রওশন এরশাদ ২৯ নভেম্বর নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ান।
মনোনয়ন দাখিলের পর আওয়ামী লীগের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করে দলটির নেতারা। আসন ভাগা-ভাগি নিয়ে নানা রকম গুজব ছড়তে থাকে। ওই দিনগুলোতে নির্বাচনে অংশগ্রহণ প্রসঙ্গে আবার ধোঁয়াশা ছড়িয়ে দেয় দলটির নেতারা। রটে যায় নির্বাচন বর্জণের গুজব, বিষয়টি পার্টির পক্ষ থেকেও রহস্যবৃত্ত রাখা হয়। এ কারণে দলটির প্রার্থীরা নির্বাচনী মাঠ থেকে হাত গুটিয়ে বসে থাকে ১৭ ডিসেম্বর (মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার) পর্যন্ত। এতে করে অনেকেই নির্বাচনী দৌঁড় থেকে পিছিয়ে পড়ে যান।
মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষ মুহুর্তে আওয়ামী লীগের সঙ্গে ২৬আসনে সমঝোতা করে জাতীয় পার্টি। ওই আসনগুলো থেকে নৌকা সরিয়ে নেয় আওয়ামী লীগ। ওই ঘোষণার পর থেকেই ক্ষুব্ধ হয়ে পড়েন ২৬ আসনের বাইরে থাকা সাধারণ প্রার্থীরা। ৩০ডিসেম্বর পর্যন্ত অনেক প্রার্থী পার্টির চেয়ারম্যানের কার্যালয়ে ঘোরাঘুরি করেছিলেন দলীয় ফান্ডের বিষয়ে। কিন্তু সাড়া না পেয়ে ক্ষোভ হতাশা নিয়ে নির্বাচনী মাঠ থেকে নিষ্কিয় হয়ে পড়েন। ভোটের দিনেও অনেক প্রার্থী সরে দাঁড়ান। নির্বাচন পরিচালনায় পার্টির সমন্বয়হীনতা ছিল চোখে পড়ার মতো।
অনেকে মনে করছেন জাতীয় পার্টি আরেকবার ভাঙ্গনের মুখে পড়তে যাচ্ছে। নির্বাচন কেন্দ্রীক ক্ষুব্ধ নেতাদের একত্র করার চেষ্টা চলছে। এখন পেছনে থাকলেও শেষ পর্যন্ত এই বলয়টি সামনে আনতে পারেন রওশন এরশাদকে। জাতীয় পার্টির কমিটির মেয়াদ যেহেতু শেষ তারা একটি একতরফা কাউন্সিল করতে পারেন। আবার কো-চেয়ারম্যানদের স্বাক্ষর নিয়ে নতুন চেয়ারম্যানও ঘোষণা দিতে পারেন। বাংলাদেশের ইতিহাসে সম্ভবত সবচেয়ে বেশি দফায় ভাঙ্গনের শিকার এরশাদের প্রতিষ্ঠিত জাতীয় পার্টি। বর্তমানে জাপা, জেপি, বিজেপি, জাপা (জাফর) নামে ৪টি পার্টি রাজনীতিতে সক্রিয়।