৫০০ বছরের সুলতানি স্থাপত্যের নিদর্শন ‘ছোট সোনা মসজিদ’
-
-
|

৫০০ বছরের সুলতানি স্থাপত্যের রত্ন ‘ছোট সোনা মসজিদ’
ছোট সোনা মসজিদ। কথিত আছে, মসজিদের গম্বুজ ছিল সোনায় মোড়ানো। সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহের শাসনামলে ওয়ালি আহমেদ নির্মিত ইসলামের ঐতিহ্য ধারণ করে গত প্রায় ৫০৬ বছর ধরে দাঁড়িয়ে আছে দেশের অন্যতম প্রাচীন এই ছোট সোনা মসজিদ।
মসজিদের সোনায় চোখ যায় চোরের দলের। চুরিও করে নিয়ে যায় সেই সোনা। সোনায় মোড়ানো গম্বুজের কারণেই নামকরণ হয় সোনা মসজিদ। যদিও এই মতের পক্ষে ঐতিহাসিক কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তবে স্থানীয়দের মধ্যে বেশিরভাগ মানুষেরই এই মতে বিশ্বাসী। যদিও লেখক ও গবেষকরা এ বিষয়ে দ্বিমত। ছোট সোনা মসজিদের পাশেই বাংলাদেশের সীমানা পেরিয়ে ভারতের অভ্যন্তরে রয়েছে আরও একটি মসজিদ। যার নাম বড় সোনা মসজিদ। একই সময়ে তৈরি হওয়ায় মসজিদ দুটির নাম ছোট ও বড় সোনা মসজিদ।
হোসেন শাহ স্থাপত্য রীতিতে তৈরি মসজিদটি মুসলিম স্থাপত্যের অন্যতম নিদর্শন। প্রাচীন বাংলার রাজধানী গৌড় নগরীর উপকণ্ঠে পিরোজপুর গ্রামে এই মসজিদটি নির্মিত হয়েছিল, যা বর্তমানে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তবর্তী চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার শিবগঞ্জ উপজেলার শাজবাজপুর ইউনিয়নে অবস্থিত। সুলতান আলাউদ্দিন হুসেন শাহের শাসনামলে (১৪৯৪-১৫১৯ খ্রিস্টাব্দে) ওয়ালি মোহাম্মদ আলি নামে এক ব্যক্তি এই মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন।
মসজিদের মাঝের দরজার ওপর প্রাপ্ত এক শিলালিপি থেকে এসব তথ্য জানা যায়। তবে শিলালিপিতে নির্মাণের সঠিক তারিখ সম্বলিত অক্ষরগুলি মুছে যাওয়ায় সঠিক নির্মাণকাল জানা যায়নি। ইতিহাসবিদ ও গবেষকদের মতে, সুলতানি স্থাপত্যের রত্ন হিসেবে পরিচিত ছোট সোনা মসজিদের বাইরের দিকে সোনালি রংয়ের আস্তরণ ছিল, সূর্যের আলো পড়লে এই রং সোনার মতো ঝলমল করত। এই থেকেই এর নামকরণ হয় সোনা মসজিদ। তবে অনেকের মতে, সুলতানের স্ত্রীর নাম ছিল সোনা বিবি, সেই থেকেও এই নামকরণ হতে পারে। গম্বুজের ওপরে সোনার প্রলেপ দেয়া ছিল বলেও এই নাম হতে পারে বলে অভিমত অনেকের। ভারতের পশ্চিমবঙ্গে আরও একটি মসজিদ রয়েছে, যেটি বড় সোনা মসজিদ নামে পরিচিত।

জানা যায়, অষ্টম থেকে দ্বাদশ শতাব্দীতে পাল বংশের রাজাদের সময় থেকে প্রাচীন বাংলার রাজধানী ছিল গৌড়। ১১৯৮ খ্রিস্টাব্দে মুসলিম শাসকরা গৌড় অধিকারের পরেও বাংলার রাজধানী ছিল এটি। পরে ১৩৫০ খ্রিস্টাব্দের দিকে বাংলার রাজধানী বছর তিনেকের জন্য স্থানান্তর করা হয় পাণ্ডুয়ায়। পরে ১৪৫৩ খ্রিস্টাব্দে আবার ফিরে আসে তা গৌড়ে। প্রাচীন এ জনপদ বাংলার রাজধানী ছিল বলে বহু অবকাঠামো গড়ে উঠেছিল এই অঞ্চলে। সুলতানি ও মুঘল আমলে নির্মিত মসজিদ, মাদ্রাসাসহ নানা মুসলিম স্থাপত্যশিল্পের মধ্যে ছোট সোনা মসজিদ এক অপূর্ব নিদর্শন।
মসজিদটি উত্তর-দক্ষিণে ৮২ ফুট লম্বা ও পূর্ব-পশ্চিমে ৫২.৫ ফুট চওড়া। উচ্চতা ২০ ফুট। এর দেয়ালগুলো প্রায় ৬ ফুট পুরু। দেয়ালগুলো ইটের কিন্তু মসজিদের ভেতরে ও বাইরে এরা পাথর দিয়ে ঢাকা। তবে ভেতরের দেয়ালে যেখানে খিলানের কাজ শুরু হয়েছে, সেখানে পাথরের কাজ শেষ হয়েছে। মসজিদের খিলান ও গম্বুজগুলো ইটের তৈরি। মসজিদের অভ্যন্তরের ৮টি স্তম্ভ ও চারপাশের দেয়ালের উপর তৈরি হয়েছে মসজিদের ১৫টি গম্বুজ। মাঝের মিহরাব ও পূর্ব দেয়ালের মাঝের দরজার মধ্যবর্তী অংশে ছাদের উপর যে গম্বুজগুলো রয়েছে সেগুলো বাংলা চৌচালা গম্বুজ। এদের দুপাশে দুসারিতে তিনটি করে মোট ১২টি গম্বুজ রয়েছে। এরা অর্ধ-বৃত্তাকার গম্বুজ। এ মসজিদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল, বাইরের যে কোনো পাশ থেকে তাকালে কেবল পাঁচটি গম্বুজ দেখা যায়, পেছনের গম্বুজগুলো দৃষ্টিগোচর হয় না।
পুরো মসজিদের অলংকরণে পাথর, ইট, টেরাকোটা ও টাইল ব্যবহার করা হয়েছে। এদের মাঝে পাথর খোদাইয়ের কাজই বেশি। মসজিদের সম্মুখভাগ, বুরুজসমূহ, দরজা প্রভৃতি অংশে পাথরের উপর অত্যন্ত মিহি কাজ রয়েছে, যেখানে লতাপাতা, গোলাপ ফুল, ঝুলন্ত শিকল, ঘণ্টা ইত্যাদি খোদাই করা আছে৷ সোনা মসজিদে নামাজ পড়ার পাশাপাশি মসজিদের ডান কোনায় আছে উঁচু স্থান, যেখানে বসে ইসলামী ব্যবস্থায় বিচারকাজ করতেন ইমাম।
ছোট সোনা মসজিদের ইমাম মো. হিযবুল্লাহ জানান, মসজিদটি দীর্ঘদিন ধরে জঙ্গল ও জরাজীর্ণ অবস্থায় পড়ে ছিল। পরে ১৯৭৬ সালের দিকে স্থানীয় বাসিন্দারা মসজিদে নামাজ চালু করেন। যা আজ-অব্দি চালু আছে। মসজিদের এক কোনে ইমামের আলাদা উঁচু জায়গা রয়েছে, যেখান থেকে ইমাম বিচারকাজ করতেন। এ থেকেই বোঝা যায়, মসজিদ নির্মাণের সময় এই এলাকায় ইসলামি শাসন ব্যবস্থা চালু ছিল। মসজিদের কারুকাজগুলো অত্যান্ত নিখুঁত এবং আকর্ষণীয়৷ যা দেখতে দূর-দুরান্ত থেকে উৎসুক মানুষ ছুটে আসে।
ঐতিকাসিক এই সোনা মসজিদ দেখতে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ছুটে আসেন শিশু থেকে শুরু করে সব শ্রেণি পেশার মানুষ। এখানে এসে তারা একদিকে যেমন জানতে পারছে ইতিহাস ও ঐতিহ্য সম্পর্কে, তেমনি নামাজ পড়ে প্রশান্তি পাচ্ছে মুসল্লিরা। একই সঙ্গে দেখা সুযোগ হচ্ছে মসজিদের আঙিনায় বীরশ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর ও বীর মুক্তিযোদ্ধা মেজর নাজমুল হকের সমাধি।
পঞ্চগড় থেকে ছোট সোনা মসজিদ দেখতে আসা যুবক ফেরদৌস সিহানুক শান্ত বলেন, অনেক দূর থেকে মসজিদটি দেখতে এসেছি। এসে দেখার পর নামাজও পড়লাম। মসজিদের ভেতরটা অনেক সুন্দর এবং অনেক ঠান্ডা। বাইরে পাথরের ওপরে কেটে কেটে যে কারুকাজ রয়েছে, তা সত্যিই অসাধারণ। দেখে খুবই ভালো লাগলো। এছাড়াও মসজিদের আঙিনায় বীরশ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর ও বীর মুক্তিযোদ্ধা মেজর নাজমুল হকের সমাধিও দেখলাম।
মসজিদের চারদিকে চারটি বুরুজ (স্তম্ভ) রয়েছে। এগুলোর ভূমি অষ্টকোনাকৃতির। বুরুজগুলোতে ধাপে ধাপে বলয়ের কাজ আছে। বুরুজগুলোর উচ্চতা ছাদের কার্নিশ পর্যন্ত। মসজিদের সামনে পাঁচটি এবং ডানে ও বাঁয়ে দুই পাশে তিনটি করে দরজা রয়েছে। প্রতিটি দরজারই কিনারায় আছে বেশ চওড়া করে খোদাই করা কারুকাজ। তবে তা খুব গভীর নয়, দূর থেকে বোঝা যায় না। দরজার পাশের দেয়ালগুলোতেও খোদাই করা কারুকাজ রয়েছে।
মসজিদের প্রবেশপথের পাথরের তোরণটিও সুদৃশ্য কারুকার্যময়। এই তোরণের সামনেই রয়েছে সেই আমলের সারি সারি কবর। সবই বাঁধানো। দুটি কবর বড় কালো পাথর দিয়ে বাঁধানো। এরপরেই মসজিদের দক্ষিণ-পূর্ব দিকে চোখে পড়বে আমবাগান।
বিশেষ করে ডিসেম্বর থেকে মে পর্যন্ত দর্শনার্থীদের ভিড় বেশি থাকে। কোনো কোনো দিন ১০-১২ হাজার দর্শনার্থীর আগমন ঘটে। দেশীয় দর্শনার্থীদের পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, চীন, সুইজারল্যান্ড, কুয়েত, ভারত, পাকিস্তানসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে পর্যটকেরা ঘুরতে আসেন।