জীবন যুদ্ধে কারো বোঝা নন বাক প্রতিবন্ধী কিরামত আলী
-
-
|

কারো বোঝা নন বাক-শ্রবণ প্রতিবন্ধী কিরামত আলী
ছোটবেলায় কালাজ্বরে আক্রান্ত হওয়ার পর কানে শোনা এবং কথা বলার শক্তি ও সামর্থ্য হারিয়ে ফেলে কিরামত আলী। তারপর থেকে তিনি বাক ও শ্রবণ প্রতিবন্ধী শিশু হিসেবে বেড়ে ওঠে।
কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা উপজেলার পৌরসভার বামনপাড়া এলাকার আকবর আলীর ছেলে কিরামত আলী। জন্মের পর থেকেই আর অন্যান্য শিশুর মতোই ছিলো। চার ভাই চার বোনের মধ্যে চতুর্থ আকবর আলী দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ালেখার সময় জ্বরে আক্রান্ত হয়। তারপর জ্বরের মাত্রা বেড়ে কালাজ্বরে আক্রান্ত হন। ফলে পরবর্তীতে তিনি বাক ও শ্রবণ প্রতিবন্ধী হিসেবে বেড়ে ওঠেন।
বাবা ছিলেন কাঠমিস্ত্রী। তাই বাবার সান্নিধ্যে থেকেই কাঠের কাজের সহায়ক হিসেবে শুরু করেন তিনি। তবে তিনি সমাজের বোঝা হয়ে বাঁচতে চাননি। তাই ছোট থেকেই শিখেছেন কাঠের ডিজাইনসহ বিভিন্ন ফার্নিচার তৈরির কাজ।
তবুও থেমে নেই তার জীবনযুদ্ধ। জীবন যুদ্ধের লড়াইয়ে বেঁচে থাকার তাগিদে সব বাধা বিপত্তিকে পেছনে ফেলে বেছে নিয়েছেন কাঠমিস্ত্রীর এই পেশা।
প্রতিদিন সকালে নিয়ম করে বেরিয়ে পড়তেন কাজের সন্ধানে। বিভিন্ন ফার্নিচারের দোকান ও বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে নিপুণ হাতে তৈরি করেন কাঠের আসবাবপত্র। এভাবেই চলতে থাকার এক পর্যায়ে কৈশোর পেরিয়ে যুবকে পরিণত হওয়া কিরামত আলী পার্শ্ববর্তী মিরপুর উপজেলার মশান গ্রামে ইয়াকুব আলী কুটি শাহর মেয়ের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন তিনি। তারপর কাজের সন্ধানে এ গ্রাম থেকে ও গ্রামে। বিভিন্ন বাড়িতে ফার্নিচারের কাজ করতে চলে আসেন শশুরবাড়ির এলাকা মশানে। সেখানেই তিনি জমি ক্রয় করে বাড়ি করে বসবাস করছেন তিনি। এই ফার্নিচারের কাজ করে যা উপার্জন করেন তা দিয়ে স্ত্রী সন্তান নিয়ে ভালোই কাটে তার জীবন সংসার। বয়সের ভারে ন্যুব্জ হয়ে পড়ায় এখন আর আগের মতো কাজ করতে পারে না, তাছাড়াও শরীরে নানান রকম অসুখে বাসা বেঁধেছে।
কিরামত আলীর দুই মেয়ে এক ছেলে। এভাবে উপার্জন করেই তাদের পড়াশোনা করিয়েছেন। বিয়ে দিয়েছেন দুই মেয়ে ও এক ছেলেকে। প্রতিদিন তার আয় হয় পাঁচ থেকে সাতশ টাকা।
প্রতিবেশী আব্দুল মান্নান জানান, কিরামত আলী ছোট থেকে বাক ও শ্রবণ প্রতিবন্ধী, তবুও কারও দুয়ারে যাওয়া লাগে না তার। নিজে একজন ভালো কাঠমিস্ত্রী। বিভিন্ন ফার্নিচারের ডিজিাইনসহ অনেক কিছু শিখেছেন। এভাবে তিনি জীবিকা নির্বাহ করে থাকেন। সমাজে কারো কাছে তিনি বোঝা নন।
মশান গ্রামের খন্দকার শাহজাহান ওরফে লালু মাষ্টার বলেন, কিরামত আলী (কিরন কাল) এর হাতের কাজের অনেক সুনাম ছিল। আমার বাড়িতে এসে বেশ খাট, আলমারি, ড্রেসিং টেবিলসহ বেশকিছু ফার্নিচার তৈরি করে দিয়েছিলো যা আজও আমার ঘরে রয়েছে। সেই থেকে তার হাতের সুদক্ষ কাজ দেখে আরও প্রতিবেশীরাও তাকে কাজের জন্য বাড়িতে ডেকে নিতো এভাবেই এ গ্রামের নিখুঁত কাঠমিস্ত্রী হিসেবে দিন দিন সুনাম বৃদ্ধি পেতে থাকে।
কাঠমিস্ত্রী শামীম বলেন, কিরামত আলী অনেক দিন ধরে কাঠের কাজ করেন। ভালো ডিজাইনও জানেন। তিনি আমার উস্তাদ। তার কাজ দেখে আমি কাঠের কাজ শিখেছি। আমি ছাড়া আরও অনেকে তার কাছ থেকে কাঠের কাজ শিখেছেন।
কিরামত আলীর স্ত্রী আয়েশা খাতুন বলেন, বাক ও শ্রবণ প্রতিবন্ধী হলেও আমার স্বামী কারও দুয়ারে যান না। নিজে কাঠমিস্ত্রীর কাজ করেন, সেই উপার্জনে চলে আমাদের সংসার। যা আয় করেন তা দিয়ে আমাদের সংসার ভালোই চলে। ছেলে মেয়ে মানুষ করে দুই মেয়ে ও এক। ছেলে বিয়ে দিয়েছি। বর্তমানে এক ছেলে নিয়ে পুত্রবধু ও নাতনি নিয়ে বসবাস করছি।
কথা বলতে না পারলেও কিরামত আলী বলেন, ছোট থেকে আমি প্রতিবন্ধী, কথা বলতে ও শুনতে পারিনা। তাই কারো বোঝা না হয়ে সেসময় থেকেই কাঠের কাজ শিখেছি। অনেক ডিজাইনের কাজ শিখেছি, ফার্নিচারের সব ধরনের কাজ করেছি। আমার কাছে অনেকেই কাজ শিখে মিস্ত্রি হয়েছে। এখন বয়স হয়েছে আর কাজ করতে পারি না। তবুও মানুষের আগ্রহ আমাকে দিয়েই তাদের মনের মতো ফার্নিচার তৈরি করবে। তাই এখনো সহকর্মীদের সঙ্গে নিয়ে কাজ করি কোনরকমে।