গৃহকর্মে নিয়োজিত দেশের প্রায় ৪০ লাখেরও বেশি গৃহশ্রমিকের অধিকার নিশ্চিত, ‘শ্রমিক’ হিসেবে স্বীকৃতি ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে দৌড়েছেন ২ হাজারেরও বেশি মানুষ। শনিবার ঢাকার হাতিরঝিলে অক্সফ্যাম ইন বাংলাদেশ আয়োজিত ‘অক্সফ্যাম রান’ এর মাধ্যমে গৃহশ্রমিকদের জন্য ন্যয্যতা নিশ্চিতের আহ্বান জানান অংশগ্রহণকারীরা। অন্যদিকে, গৃহকর্মীদের অধিকার নিশ্চিতের মাধ্যমে শহরগুলোতে ন্যায় ও অধিকার প্রতিষ্ঠা সম্ভব হবে বলে মন্তব্য করেন বক্তারা।
গ্লোবাল অ্যাফেয়ার্স কানাডার সহযোগিতায়, ‘সমতার লক্ষ্যে, চলো একসাথে’ স্লোগানকে সামনে রেখে গৃহকর্মীদের শ্রমিক হিসেবে ‘স্বীকৃতি’ ও শ্রম আইনে অন্তর্ভূক্তির লক্ষ্যে আয়োজনটি অনুষ্ঠিত হয়। ৭.৫ কিলোমিটারের এই দৌড়ে প্রায় ৪ শতাধিক গৃহকর্মীও অংশগ্রহণ করেন।
রানে পুরুষ বিভাগে হামিদুর রহমান প্রথম হন। আনিমুল হাসান দ্বিতীয় ও তৃতীয় অবস্থান করেন আবুল হাসনাত কবির। অন্যদিকে, নারীদের মধ্যে সুইটি আক্তার প্রথম হয়েছেন। তামান্না আফরিন মিতুল এবং তাসলিমা আক্তার যথাক্রমে দ্বিতীয় ও তৃতীয় হন। এর বাইরে আয়োজনে শিশুদের অংশগ্রহণও ছিল।
সমাপনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের (ডিএনসিসি) প্রশাসক মোহাম্মদ এজাজ। তিনি বলেন, ‘আমরা শহরগুলোতে সবচেয়ে বেশি নির্ভরশীল থাকি আমাদের গৃহকর্মীদের উপর। কিন্তু তারাই সবচেয়ে বেশি বৈষম্যের শিকার। ঘরে, সমাজে এবং সরকারি পর্যায়ে তাদেরকে আমাদের স্বীকৃতি নিশ্চিত করতে হবে। তাদের অধিকার ও প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে আমরা একটি ন্যায্যতার দেশ গড়তে পারবো।’
বিশেষ অতিথি শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব এ. এইচ. এম. শফিকুজ্জামান বলেন, ‘গৃহকর্মীদের গুরুত্ব অনুধাবন করে আমরা তাদেরকে আনুষ্ঠানিক খাতে নিয়ে আসার চেষ্টা করছি। তাহলে তাদের মজুরি, দক্ষতা ও অন্যান্য সুবিধাগুলোর অধিকার স্বীকৃতি পাবে। নিজেদের অধিকারের জন্য সরকার ও নিয়োগকর্তার সাথে দর কষতে পারবে। তখন আমরা তাদের জন্য ছুটিছাটা, মাতৃত্বকালীন ছুটি, অসুস্থতাজনিত ছুটি, শোভন কর্মক্ষেত্র ও মজুরির বিষয়গুলোও নিশ্চিত করতে পারবো।’
অক্সফ্যাম রানের মাধ্যমে গৃহশ্রমিকদের জন্য অক্সফ্যাম ২০১৫ সালের গৃহকর্মীদের সুরক্ষা ও কল্যাণ নীতির সঠিক বাস্তবায়ন, গৃহকর্মীদের জন্য সম্মানজনক কাজের আইএলও কনভেনশন ১৮৯—এর অনুমোদন এবং এই গুরুত্বপূর্ণ কর্মশক্তির রক্ষার জন্য শক্তিশালী পদক্ষেপ নিশ্চিতের বিষয়গুলো উঠে আসে।
অক্সফ্যাম ইন বাংলাদেশের এক্টিং কান্ট্রি ডিরেক্টর মাহমুদা সুলতানা বলেন, ‘অক্সফ্যাম দীর্ঘদিন ধরে গৃহশ্রমিকের অধিকার নিয়ে কাজ করছে এবং লক্ষ্যণীয় হলো তাদের অধিকার রক্ষায় কেবল নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে পরিবর্তনই যথেষ্ট নয়, যতদিন না আমাদের মানসিকতার পরিবর্তন হয়। গৃহশ্রমিককে ‘শ্রমিক’ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া শুধু নীতিনির্ধারক নন, আমাদেরও ভাবনা জরুরি।’
বাংলাদেশের গৃহশ্রমিকদের মূল অংশই নারী এবং তারা বিভিন্নভাবে বৈষম্যের শিকার। শোভন কর্মক্ষেত্র না থাকা, সাপ্তাহিক ছুটি না থাকা, নিয়োগপত্র না থাকা, সঠিক মজুরি না পাওয়া এবং জেন্ডারভিত্তিক নির্যাতনের মতো ঘটনা ঘটছে। যা সার্বিকভাবে মানবাধিকারের পরিপন্থী। অন্যদিকে, শ্রমিক হিসেবে স্বীকৃতি না থাকায় বিশাল এই শ্রমগোষ্ঠী সামাজিক ও শ্রমিক হিসেবে প্রাপ্য নানান সুযোগ— সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।
২০২২ সালে অক্সফ্যামের এক গবেষণায় উঠে আসে, ৯৩ শতাংশ গৃহশ্রমিক কর্মক্ষেত্রে হয়রানির শিকার হন, যার মধ্যে ৬৭ শতাংশ মানসিক নির্যাতন, ৬১ শতাংশ মৌখিক এবং ২১ শতাংশ শারীরিক নির্যাতনের শিকার হন। দেশের জিডিপিতে বড় অবদান থাকার সত্ত্বেও, গৃহকর্মীরা শ্রম আইনের সুরক্ষা থেকে বঞ্চিত, যার ফলে তারা শোষণ, হয়রানি এবং অপর্যাপ্ত মজুরির ঝুঁকিতে পড়ে। অক্সফ্যাম দেশের গৃহকর্মীদের শ্রমআইনে অন্তর্ভুক্তির লক্ষ্যে ২০২০ সালে সুনীতি প্রকল্পের মাধ্যমে কাজ করছে অক্সফ্যাম ইন বাংলাদেশ। ইতোমধ্যে দক্ষতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে এই পেশায় নিয়োজিত প্রায় ১৮ হাজার নারী গৃহকর্মীদের পেশাগত ও জীবন দক্ষতা উন্নয়নের মাধ্যমে সার্বিক জীবনমান উন্নয়নের লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে প্রকল্পটি।
উল্লেখ্য, অক্সফ্যাম রানে দৌড়ে অংশগ্রহণকারীদের পাশাপাশি বিভিন্ন সরকারি কর্মকর্তা, দূতাবাসের প্রতিনিধি, বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা, সুনীতি পার্টনার সংস্থা গণমাধ্যমসহ অন্যান্যরা অংশগ্রহণ করেন।