অবিভক্ত বাংলার ঐতিহ্য বহন করছে কলকাতার কুমোরটুলি

  • স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তাটোয়েন্টিফোর.কম, কলকাতা
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

কলকাতার কুমোটুলির শিল্পীদের বানানো প্রতিমা

কলকাতার কুমোটুলির শিল্পীদের বানানো প্রতিমা

এখন ওদের নাওয়া-খাওয়ার সময় নেই। মাথায় এখন একটাই চিন্তা! যত তাড়াতাড়ি সম্ভব প্রতিমা নির্মাণের কাজ শেষ করতে হবে। আসলে ওরা কলকাতার কুমোরটুলির এক একজন প্রখ্যাত মৃৎশিল্পী। দুর্গাপূজা গৃহস্থর দোড়গোড়ায়। তাই ব্যস্ততা তুঙ্গে। উত্তর কলকাতার কুমোরটুলি মানেই সরু গলি, যার একপ্রান্তে ঢুকলে আর একপ্রান্তে গিয়ে পড়ে। রাস্তা জানা না থাকলে মাথা গুলোবেই। সেইসব গলির দুইদিকে সারিবদ্ধ ভাবে সাজানো রয়েছে অসংখ্য প্রতিমা। কালেন্ডার না মানা বৃষ্টি। প্যাঁচপ্যাঁচে কাদা। তারই মধ্যে চলছে কাজ। আনাগোনা পূজা উদ্যোক্তাদের। তারা দেখে নিচ্ছে বায়না করা প্রতিমা ঠিকঠাক হচ্ছে তো? দুর্গাপূজার সময় কুমোরটুলি মৃৎশিল্পের আঁতুড়ঘরের চিত্রটা মোটামুটি এরকমই।

অবিভক্ত বাংলায় কলকাতা ছিল এক গ্রামের স্বরূপ। কাঁচা রাস্তা, গরুর গাড়ি, মাটির দালান বাড়ি অর্থাৎ আজকের কলকাতার মত এত চাকচিক্য ছিল না। কলকাতা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন জব চার্নক। প্রতিষ্ঠিত হওয়ার কয়েকদিনের মধ্যে কলকাতায় গড়ে ওঠে ফোর্ট উইলিয়াম। ফোর্ট উইলিয়াম হওয়ার  ফলে নতুন মানুষদের জন্য নতুন বসতি স্থাপনের প্রয়োজন হয়ে পড়ল। সেই প্রয়োজন মেটানোর জন্যই ভাগীরথী নদীর পাড়ে গড়ে তোলা হলো সুতানুটি।

বিজ্ঞাপন

এই সুতানটিতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির নির্দেশে পেশা ভিত্তিক বিভিন্ন অঞ্চল গড়ে উঠল সেখানে। যেগুলির নাম আজও অক্ষত আছে। কলুটোলা, ছুতারপাড়া, আহিরীটোলা, কুমোরটুলি ইত্যাদি। পাশাপাশি এই কলকাতায় বাণিজ্যের অগ্রগতি ও প্রসারের ফলে জমিদার শ্রেণিরও আবির্ভাব হতে থাকল। কাজের আশায় বাংলার গ্রামগঞ্জ থেকে কলকাতায় ভিড় জমাতে থাকলেন নানা পেশার মানুষ।

বিজ্ঞাপন

আসতে শুরু করলো মুর্শিদাবাদ, কৃষ্ণনগর, নদিয়া থেকে মৃৎশিল্পেরা। তবে প্রথমদিকে কুমোরটুলিতে এরা অবশ্য প্রতিমা শিল্পের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না। নিত্যপ্রয়োজনীয় বিভিন্ন মৃৎপাত্র, মাটির পুতুল তৈরিতেই পটু ছিলেন তারা। এরপর ধীরে ধীরে দুর্গা প্রতিমা গড়তে শুরু করেন মৃৎশিল্পীরা। চাহিদা যত বাড়তে থাকে মৃৎশিল্পীদের বসতও গড়ে ওঠে কুমোরটুলিতে। দেশভাগের পর বাংলাদেশ থেকে রাখালচন্দ্র রুদ্রপাল, হরিবল্লভ, গোবিন্দ, নেপাল, মোহনবাঁশি, যোগেন্দ্র পাল, গোরাচাঁদ পাল অর্থাৎ পাল বংশধররা এলেন পশ্চিমবঙ্গে। আর ঐ সময় থেকেই প্রতিমা শিল্পে এক অনন্য পরিবর্তন ঘটে গেল। নিত্যনতুন ভাবনায় নির্মিত হতে শুরু করল প্রতিমা।

ভু-ভারতে সেরা প্রতিমা বানাতো এই কুমোরটুলি। হয়ত আজও! আর সে কারণেই এখনও প্রতি বছর দুর্গাপুজায় ইউরোপ-আমেরিকাসহ কয়েক হাজার প্রতিমা বিদেশে পাড়ি দেয়। বিদেশে পাড়ি দেবার ট্রেন্ড অবশ্য শুরু হয়েছিল আটের দশকের শেষের দিকে। সেই সময় শোলার তৈরি প্রতিমা পাড়ি দিত বিদেশে। এখন প্রায় ৯৩টি দেশে কুমোরটুলির প্রতিমা পাড়ি দেয়। প্রতিমা পাড়ি দেয় কলকাতার সেরা বনেদী পূজা থেকে শুরু করে বারোয়ারি পূজায়। যা নিঃসন্দেহে কুমোরটুলির জন্যে গর্বের।

বর্ষায় তেমন বৃষ্টি চোখে পড়েনি, কিন্তু এখন বৃষ্টি বেড়েছে। ফলে রাতের ঘুম গেছে শিল্পীদের। তাই সরু গলির দুইপাশে যেদিকেই তাকানো যায়, সেদিকেই প্লাস্টিকে মোড়া প্রতিমা লক্ষ্য করা যাবে। সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তন হয়েছে মানুষের চিন্তাধারা, রুচিবোধ গুলোও অনেকাংশে পরিবর্তিত হয়েছে।

মহালয়ার পর যখন উমা মণ্ডপ আলোকিত করতে পাড়ি দেয়। ঠিক তখনই কুমোরটুলিতে নেমে আসে অন্ধকার। তিল তিল করে সন্তানের মত যে হাত দিয়ে মৃৎশিল্পীরা প্রতিমা গড়ে। সেই হাত দিয়েই উমাকে তুলে দেয় গাড়িতে। সেই কষ্ট একজন শিল্পীই বোঝেন। আনন্দের মধ্যেই নেমে আসে বিষাদ। তবুও কুমোরটুলি মানেই বাঙালির আবেগ। জড়িয়ে আছে অবিভক্ত বাংলার ইতিহাস।