রমজান শুধু একটি মাস নয়; এটি আত্মশুদ্ধি, সংযম ও রহমতের এক অপার সুযোগ। এই মাসের প্রতিটি দিন যেন এক অনন্য প্রতিশ্রুতি, সংযমের শৃঙ্খলে অভ্যস্ত হয়ে আত্মার পরিশুদ্ধি অর্জনের। তাই মুমিন-মুসলমানের উচিত রমজান পালন করা পরিশুদ্ধ হৃদয়ে, পরম নিষ্ঠায়, দয়া ও উদারতার আলোকচ্ছটায়।
এ মাসে তো ফরজ রোজাপালন করতেই হবে। সেই সঙ্গে নিয়মিত তারাবি আদায় করতে হবে। সাহাবি হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আবি কাইস (রা.) বলেন, উম্মুল মুমিনিন হজরত আয়েশা (রা.) বলেছেন, তুমি রাতের নামাজ (তারাবি) ছেড়ে দেবে না। কারণ হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) কখনো একে পরিত্যাগ করতেন না। তিনি (সা.) অসুস্থ হলে কিংবা অলসতাবোধ করলে বসে নামাজ আদায় করতেন। -সুনানে আবু দাউদ: ১৩০৭
এছাড়া এ মাসে আমরা যেসব আমলের মাধ্যমে কাটাতে পারি সেগুলো হলো-
দান-সদকা: হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী কারিম (সা.) বলেছেন, প্রতিদিন সকালে দুজন ফেরেশতা অবতরণ করেন। তাদের একজন বলেন, হে আল্লাহ! দাতাকে তার দানের উত্তম প্রতিদান দিন, আর অন্যজন বলেন, হে আল্লাহ! কৃপণকে ধ্বংস করে দিন। -সহিহ বোখারি: ১৪৪২
কোরআন তেলাওয়াত: হজরত আবু উমামা (রা.) বলেন, আমি হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে এ কথা বলতে শুনেছি যে তোমরা কোরআন মাজিদ পাঠ করো। কেননা কেয়ামতের দিন কোরআন তার পাঠকের জন্য সুপারিশকারী হিসেবে আগমন করবে। -সহিহ মুসলিম: ৮০৪
আত্মীয়তার সম্পর্ক অটুট রাখা: হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী (সা.) বলেছেন, প্রতিদানকারী আত্মীয়তার হক সংরক্ষণকারী নয়। বরং আত্মীয়তার হক সংরক্ষণকারী সেই ব্যক্তি, যে আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন হওয়ার পরও তা বজায় রাখে। -সহিহ বোখারি: ৫৯৯১
জামাতে নামাজ আদায়: হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা.) থেকে বর্ণিত, একদিন হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) নামাজ সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে বললেন, যে ব্যক্তি নামাজের প্রতি যত্নবান হবে, কেয়ামতের দিন তা হবে তার জন্য নুর ও সাক্ষী এবং কেয়ামতের দিন নাজাতের মাধ্যম। -সহিহ ইবনে হিব্বান: ১৪৬৭
উত্তম আচার-ব্যবহার: উম্মুল মুমিনিন হজরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে বলতে শুনেছি, নিশ্চয়ই মুমিন ব্যক্তি তার ভালো চরিত্রের মাধ্যমে (দিনের) রোজা পালনকারী ও (রাতের) তাহাজ্জুদ আদায়কারীর সমান মর্যাদা লাভ করতে পারে। -সুনানে আবু দাউদ: ৪৭৯৮
নিয়ত বিশুদ্ধ করা: হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি নেক কাজের ইচ্ছা করে অথচ সম্পাদন করেনি, তার জন্য একটি সওয়াব লেখা হয়। আর যে ইচ্ছা করার পর কার্যত সম্পাদন করে, অনন্তর তার ক্ষেত্রে ৭০০ গুণ পর্যন্ত সওয়াব লেখা হয়। পক্ষান্তরে যে কোনো মন্দ কাজের ইচ্ছা করে আর তা না করে, তার কোনো গুনাহ লেখা হয় না; আর তা করলে (একটি) গুনাহ লেখা হয়। -সহিহ বোখারি: ৬৪৯১
আত্মশুদ্ধি: হজরত নোমান ইবনে বশির (রা.) বলেন, আমি হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে বলতে শুনেছি, জেনে রাখো, শরীরের মধ্যে একটি গোশতের টুকরা আছে, তা যখন ঠিক হয়ে যায়, গোটা শরীরই তখন ঠিক হয়ে যায়। আর তা যখন খারাপ হয়ে যায়, গোটা শরীরই তখন খারাপ হয়ে যায়। জেনে রাখো, সেই গোশতের টুকরাটি হলো কলব (অন্তর)। -সহিহ বোখারি: ৫২
খাঁটি তওবা করা: হজরত আবু মুসা (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী কারিম (সা.) বলেন, রাতে আল্লাহতায়ালা তার নিজ দয়ার হাত প্রসারিত করেন, যেন দিবসের অপরাধী তার নিকট তওবা করে; এমনিভাবে দিনে তিনি তার নিজ হাত প্রশস্ত করেন, যেন রাতের অপরাধী তার নিকট তওবা করে। এমনিভাবে দৈনন্দিন চলতে থাকবে পশ্চিম দিগন্ত থেকে সূর্য উদিত হওয়া পর্যন্ত। -সহিহ মুসলিম: ২৭৫৯
পরিবারের প্রতি সদয় হওয়া: উম্মুল মুমিনিন হজরত আয়েশা (রা.) বলেন, হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, যখন আল্লাহতায়ালা কোনো পরিবারে কল্যাণ দিতে চান, তখন তাদের মাঝে কোমলতা ও সৌজন্য দান করেন। -মুসনাদে আহমাদ: ২৪৪৭১
অন্যকে সহায়তা: হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, যে লোক কোনো মুমিনের দুনিয়া থেকে কোনো মুসিবত দূর করে দেবে, আল্লাহতায়ালা বিচার দিবসে তার থেকে মুসিবত সরিয়ে দেবেন। যে লোক কোনো দুঃস্থ লোকের অভাব দূর করবে, আল্লাহতায়ালা দুনিয়া ও আখেরাতে তার দুরবস্থা দূর করবেন। যে লোক কোনো মুসলিমের দোষত্রুটি লুকিয়ে রাখবে, আল্লাহতায়ালা দুনিয়া ও আখেরাতে তার দোষত্রুটি লুকিয়ে রাখবেন। বান্দা যতক্ষণ তার ভাইয়ের সহযোগিতায় আত্মনিয়োগ করে, আল্লাহ ততক্ষণ তার সহযোগিতা করতে থাকেন। -সহিহ মুসলিম: ২৬৯৯
হিংসা-বিদ্বেষ পরিত্যাগ: হজরত মুয়াজ বিন জাবাল (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী কারিম (সা.) বলেছেন, শাবান মাসের মধ্যরাতে আল্লাহতায়ালা সৃষ্টির প্রতি দৃষ্টিপাত করেন এবং সমগ্র সৃষ্টিকে ক্ষমা করে দেন, তবে তিনি মুশরিক ও বিদ্বেষ পোষণকারী ব্যক্তিকে ক্ষমা করেন না। -সহিহ ইবনে হিব্বান: ৫৬৬৫
অধিক নফল ইবাদত: হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, আল্লাহতায়ালা বলেন, যে ব্যক্তি আমার কোনো অলির সঙ্গে দুশমনি রাখবে, আমি তার সঙ্গে যুদ্ধ ঘোষণা করব। আমি যা কিছু আমার বান্দার ওপর ফরজ করেছি, তা দ্বারা কেউ আমার নৈকট্য লাভ করবে না। আমার বান্দা সর্বদা নফল ইবাদত দ্বারা আমার নৈকট্য লাভ করতে থাকবে। -সহিহ বোখারি: ৬৫০২
সময়ের প্রতি লক্ষ রাখা: হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, এমন দুটি নেয়ামত আছে, যাতে বেশির ভাগ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত। তা হচ্ছে, সুস্থতা আর অবসর। -সহিহ বোখারি: ৬৪১২
ক্রয়-বিক্রয়ে সহনশীল হওয়া: হজরত জাবির ইবনে আবদুল্লাহ (রা.) থেকে বর্ণিত, আল্লাহর রাসুল (সা.) বলেছেন, আল্লাহ এমন ব্যক্তির প্রতি রহমত বর্ষণ করেন, যে নম্রতার সঙ্গে ক্রয়-বিক্রয় করে এবং পাওনা ফিরিয়ে দেয়। -সহিহ বোখারি: ২০৭৬
ভালো কাজের প্রতিযোগিতা: উম্মুল মুমিনিন হজরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী কারিম (সা.) বলেছেন, নিশ্চয়ই আল্লাহতায়ালা তাদের ভালোবাসেন, যখন তোমাদের কেউ কোনো কাজ করে আর তা সুচারুভাবে সম্পন্ন করে। -মুসনাদে আবি ইয়ালা: ৪৩৮৬
আল্লাহতায়ালা প্রত্যেক মুসলমানকে উল্লিখিত বিষয়গুলো মান্য করে রমজান মাস কাটানোর তওফিক দান করুন। আমিন।