ঈদ উৎসবের মর্মমূলে সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতি

  • কবির য়াহমদ, অ্যাসিস্ট্যান্ট এডিটর, বার্তা২৪.কম
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ঈদ উৎসবের মর্মমূলে সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতি

ঈদ উৎসবের মর্মমূলে সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতি

দেশের আকাশে শাওয়ালের চাঁদ ওঠেছে। বৃহস্পতিবার ঈদুল ফিতর। মুসলমানদের দুই প্রধান ধর্মীয় উৎসবের অন্যতম দিন। ঈদুল ফিতর আসে সম্প্রীতির বন্ধনে আবদ্ধ করার বার্তা নিয়ে। ধনী-নির্ধন কেউ এই আনন্দ থেকে বঞ্চিত হয় না। লৌকিক ভেদাভেদ ভুলে সব মানুষ এক কাতারে সমবেত হয়, আলিঙ্গনে জড়ায় একে অন্যকে। এই দিনটি তাই সাম্যের, ভালোবাসার, সৌহার্দ্যের।

হিজরি বর্ষপঞ্জির নবম মাস ছিল রমজান। এই মাস সংযত আচরণের শিক্ষা দিয়েছিল, সংযম পালনের বার্তা দিয়েছিল; বার্তা দিয়েছিল কৃচ্ছ্রসাধনার। এ বার্তা যারা গ্রহণ করেছে ব্যক্তি হিসেবে তারা সফল। এই সাফল্যের পুরস্কার হয়ত দৃশ্যমান নয়, তবে সন্তুষ্টি অর্জন হৃদয়ের গভীরে প্রোথিত। আত্মিক বিশুদ্ধতা অর্জনের যে বার্তা সেটা অবিনাশী।

বিজ্ঞাপন

এবার দেশে ত্রিশ রমজান পালিত হয়েছে। ত্রিশের সন্ধ্যা শেষে পশ্চিমাকাশে দেখা মিলেছে বাঁকা যে চাঁদের সেটা আনন্দের উপলক্ষ এনে দিয়েছে দেশবাসীকে, ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের। কবি কাজী নজরুল ইসলামের বিখ্যাত সেই গান ভাসছে সন্ধ্যা থেকেই—‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ/ তুই আপনাকে আজ বিলিয়ে দে, শোন আসমানী তাগিদ।’ গানটিকে অনেকেই বলে থাকেন ‘ঈদের সর্বজনীন সংগীত’; যদিও তার আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি নেই, তবু এটা সত্যি সত্যিই ঈদের জাতীয় অথবা সর্বজনীন সংগীতই। সেই শিশুকাল থেকে আমরা শুনে আসছি। ৯৩ বছর আগে লিখিত কবি নজরুলের গানটি এখনো সকল বয়েসি মানুষের কাছে সমান ভাবে আদৃত। গানটা না শুনলে ঈদের ঘোষণার যেন পূর্ণতাই পায় না।

ঈদ উৎসব ধর্মীয় হলেও এর রয়েছে সর্বজনীন রূপ। এই উৎসব কেবল ইসলাম ধর্মাবলম্বীরাই পালন করে তা না। ঈদ উৎসবের ছুটি থেকে শুরু করে সকল কিছুর সঙ্গে রয়েছে সকল মানুষের যোগ। এখানে চাইলেও আমরা কাউকে আলাদা করতে পারি না। এই উৎসবে সামিল হয় অন্য ধর্মাবলম্বীরাও। উৎসবের নানা পর্যায়ে তারাও অংশ নেয়, আনন্দ ভাগাভাগি করে। উদারমনস্করা এটাকে সংকীর্ণ দৃষ্টিতে দেখে না, উৎসবকে সর্বজনীন রূপ দিতে নানাভাবে চেষ্টা করে থাকে। সৌহার্দ্য, সাম্য ও মিথস্ক্রিয়তার এই চর্চা একদিনের নয়। এটা আমাদের উত্তরাধিকারী ধারা। চাইলেও এখানে ফাটল ধরানো কঠিন। এখানে যে চেষ্টা হচ্ছে না, তা না; হচ্ছে, তবে দিনশেষে মানুষ উৎসবে একে অন্যকে জড়াচ্ছে। মিলনের ক্ষেত্র প্রসারে রাখছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা।

বিজ্ঞাপন

সাংবিধানিক স্বীকৃতিতে পরাভূত হলেও নৈতিকভাবে আমরা ধর্মনিরপেক্ষ জাতিরাষ্ট্রের বাসিন্দা। এখানে তাই 'ধর্ম যার যার, উৎসব সবার'। ঈদ, পূজা-পার্বণ, নববর্ষ, বড়দিনসহ অন্য সকল ধর্মীয় ও জাতীয় দিবসগুলো সর্বজনীনভাবে উদযাপিত হয়। রাষ্ট্রও এর পৃষ্ঠপোষকতা করে থাকে। আমাদের রক্তে যে অসাম্প্রদায়িকতার চর্চা তা হুট করে ভাঙা অসম্ভব। তাই ধর্মের মোড়কে যত উৎসবই আসুক না কেন, জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সবাই সেই আনন্দে ভাসে, উৎসবে সামিল হয়। ঈদুল ফিতরও তেমনই এক উৎসব, যা মুসলমানদের প্রধান দুই ধর্মীয় উৎসবের অন্যতম হলেও এই উৎসবে সবাই অংশগ্রহণ করে, শুভেচ্ছা জানায়।

ঈদ আমাদেরকে স্মৃতিকাতর করে। জীবনের এই পর্যায়ে আমরা যারা বাবা-মা, আত্মীয়স্বজনকে হারিয়েছি, তাদের কাছে মা-বাবার স্মৃতি, স্বজনদের স্মৃতি উঁকি দেয় প্রবলভাবে। উৎসবের দিনে হাহাকার ভাসে। নিয়তির লিখন বলে আমরা সে বেদনা অনুভব করি ঠিক, আবার পরক্ষণে উৎসবের দিনকে অন্যের কাছে বেদনা-সিক্ত না করতে সেই হাহাকার বুকে চেপে রাখি। এ অন্য এক সংযম; বেদনা চাপা দেওয়ার শিক্ষা। আনন্দের বিপরীতে এই বেদনায় লীন হয় না, এমন লোক খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। তবে শেষ পর্যন্ত সবাই সংযত থাকে। সংযম পালনের মাসব্যাপী যে শিক্ষা তার প্রভাব হাতেনাতে দেখা মেলে উৎসবের দিনেই। এক মাসের শিক্ষা যে কতখানি প্রভাববিস্তারি এরচেয়ে বড় উদাহরণ আর কী হতে পারে!

ঈদে 'নাড়ির টানে' শহর ছাড়ে মানুষ। পরিবারপরিজন, আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে আনন্দ ভাগাভাগি করে। উৎসবে-আনন্দে 'দেশে' ফেরে লোকজন। গ্রামটাই যে মানুষের কাছে প্রকৃতই 'দেশ'; তা ঈদের সময়ে ভালোভাবেই টের পাওয়া যায়। ঢাকা ছাড়েন কোটি লোক। ঢাকার কথা আলাদাভাবে আসে, ওটা রাজধানী বলে। এরবাইরে প্রতি জেলা-উপজেলা সদর ছাড়েন লোকজন। যারা শহর ছাড়েন না, তারাও খোঁজখবর নেন স্বজনদের। মিলন আর সৌহার্দ্যের দেখা মেলে ঈদের সময়েই। দেশের ভেতর 'আরেক দেশের' অস্তিত্ব যেন মূর্ত হয়ে ওঠে ঈদের সময়ে। এই অস্তিত্ব বিভক্তির নয়, আনন্দের।

ঈদ উৎসবের মর্মমূলে রয়েছে সৌহার্দ্য-সম্প্রীতির বার্তা। তাই শেষ করি কবি নজরুলকে দিয়েই—‘যারা জীবন ভরে রাখছে রোজা, নিত্য উপবাসী/ সেই গরীব ইয়াতীম মিসকিনে দে যা কিছু মুফিদ/ ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ/ আপনাকে আজ বিলিয়ে দে শোন আসমানী তাগিদ।’ যারা অভাবগ্রস্ত, নিত্য উপবাসী, কিংবা গরিব অথবা এতিম তাদের প্রয়োজনীয় জিনিস দেওয়ার বার্তা আছে 'ঈদের সর্বজনীন সংগীতে'! নিজেকে অন্যের তরে বিলিয়ে দেওয়ার আসমানী এ তাগিদ গ্রহণে নিশ্চয় পূর্ণতা পায় ঈদের আনন্দ। নজরুলের কবিতা কিংবা গানে রয়েছে যার প্রকাশ, তার বিস্তৃত রূপের দেখা মেলে ঈদ উৎসবে।

সবাইকে ঈদ মুবারক!