গভীর সাগরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে অনিশ্চয়তা!
-
-
|

ছবি: সংগৃহীত
গভীর সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান দরপত্র জমা না পড়ার কারণ যতটা অর্থনৈতিক তার চেয়ে অনেকটা রাজনৈতিক বলে মনে করা হচ্ছে। সে কারণে নির্বাচিত সরকার না আসা পর্যন্ত অপার সম্ভাবনার গভীর সমুদ্র অধরাই থেকে যাচ্ছে বলে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে।
দেশীয় গ্যাস ফিল্ডগুলোর উৎপাদন যখন কমতির দিকে তখন স্বপ্ন দেখাচ্ছিল গভীর সমুদ্র। এ জন্য বহু ঢাক-ঢোল পিটিয়ে আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করা হয়। বিদেশি কোম্পানিগুলোর তৎপরতা চোখে পড়ার মতো হলেও শেষ পর্যন্ত কেউই দরপত্র জমা না দেওয়ায় বিষয়টি অনেকটাই অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।
৭টি বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান দরপত্র কিনলেও জমাদান থেকে বিরত থাকে। এর কারণ জানতে কমিটি গঠন করা হয়। সেই কমিটির রিপোর্টে বেশ কিছু বিষয় উঠে এসেছে। তবে কোম্পানিগুলোর দেশীয় এজেন্টরা বিষয়টিকে রাজনৈতিক বলেই মত দিয়েছেন।
কোম্পানিগুলো লিখিত প্রস্তাবে রাজনৈতিক বিষয়টি কৌশলে এড়িয়ে অন্যান্য সমস্যার কথা সামনে এনেছে। বাংলাদেশের গভীর সমুদ্র নিয়ে সবচেয়ে বেশি আগ্রহী ছিল মার্কিন কোম্পানি এক্সোন মবিল করপোরেশন। ব্লক ইজারা পেতে ২০২৩ সাল থেকে নানান দেন দরবার করেছিল কোম্পানিটি। প্রথম দিকে সাগরের সবগুলো ব্লক ইজারা নেওয়ার জন্য চিঠি দিয়েছিল।
ওই সময় মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, মডেল পিএসসির গতিধারা দেখে আমাদের সাগর নিয়ে আগ্রহ বাড়ছে বিদেশি কোম্পানিগুলোর। তারই ধারবাহিকতায় এক্সোন মবিল করপোরেশন বিশেষ আইনে সবগুলো ব্লক ইজারা পেতে আগ্রহ দেখায়। ওই সময়ে এক্সোন মবিলের প্রস্তাব নিয়ে কয়েক দফায় বৈঠক হলেও ফলাফল শুন্য থেকে যায়। ২০২৪ সালের মার্চে সাগরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনের জন্য উন্মুক্ত দরপত্র আহ্বান করলে দরপত্র গ্রহণ করে বহুজাতিক কোম্পানিটি। এক্সোন মবিলের পাশাপাশি আরও ৬টি কোম্পানি দরপত্র গ্রহণ করে।
নির্ধারিত সময়ের পূর্বেই কোম্পানিগুলোর অনুরোধে দরপত্র জমার সময় ৩ মাস সময় বাড়ালেও দরপত্র জমা থেকে বিরত থাকে। যে কারণে পরিত্যাক্ত ঘোষণা করা হয়েছে দরপত্র। দরপত্র জমা না হওয়ার কারণ অনুসন্ধান কমিটির চিঠির জবাবে এক্সোন মবিল মোটাদাগে ৩টি বিষয় সামনে এনেছে। প্রথমত কোম্পানিটি গ্যাসের দামকে যথাযথ মনে করেনি। তারা লিখেছে, মডেল পিএসসি প্রণয়নের কনসালটেন্ট প্রতিষ্ঠানের (উড ম্যাকেঞ্জি এশিয়া প্যাসিফিক) সুপারিশ করা গ্যাসের দাম বহাল রাখা হয় নি। উল্লেখ্য, কনসালটেন্ট প্রতিষ্ঠান উড ম্যাকাঞ্জি গ্যাসের দাম ১০ ডলারের কাছাকাছি রাখার সুপারিশ দিয়েছিল। আর চূড়ান্ত পিএসসিতে গ্যাসের দাম ব্রেন্ট ক্রডের ১০ শতাংশ দরের সমান। যা আগের পিএসসিতে যথাক্রমে অগভীর ও গভীর সমুদ্রে ৫.৬ ডলার ও ৭.২৫ ডলার স্থির দর ছিল।
এক্সোন মবিল আরও দু’টি বিষয় সামনে এনেছে, এগুলো হচ্ছে গভীর সমুদ্র থেকে স্থলভাগে আনা পাইপলাইনের খরচ হিসেবে সঞ্চালন চার্জ না রাখা এবং ওয়ার্কার্স প্রফিট পার্টিসিপেশন ফান্ড (ডব্লিউপিপিএফ) নিয়ে আপত্তি। বিদ্যমান আইনে কোম্পানির মুনাফার ৫ শতাংশ ডব্লিউপিপিএফ এ হস্তান্তরের বিধান রয়েছে। যা নিয়ে মার্কিন কোম্পানি শেভরন বাংলাদেশের সঙ্গে টানাপোড়েন চলে আসছে।
দরপত্র কিনলেও জমা না দেওয়ার তালিকায় ছিল শেভরন বাংলাদেশও। তারা তাদের প্রস্তাবে ডব্লিউপিপিএফ নিয়ে আপত্তির কথা জানিয়েছে। অন্যদিকে চায়না ন্যাশনাল অফশোর অয়েল কর্পোরেশন (সিএনওওসি) তার জবাবে লিখেছে, পেট্রোবাংলা তাদের ডাটা বিক্রির জন্য যে প্যাকেজ মূল্য নির্ধারণ করেছিল, তার দর অনেক বেশি ছিল।
অনুসন্ধান কমিটি তার সুপারিশে অপর্যাপ্ত ডাটার কথা উল্লেখ করেছে বলে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ সূত্র বার্তা২৪.কমকে নিশ্চিত করেছে। রিপোর্টে বলা হয়েছে, সাগরে ১২ হাজার লাইন কিলোমিটার মাল্টিক্ল্যায়েন্ট সার্ভের ডাটা রয়েছে। অবশিষ্ট ২৩ হাজার কিলোমিটার ২ডি সার্ভের করা গেলে বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর কাছে আকর্ষণীয় হবে।
পেট্রোবাংলা সূত্র বলছে, মার্কিন কোম্পানি এক্সনমবিল ও শেভরন, মালয়েশিয়ার পেট্রোনাস, নরওয়ে ও ফ্রান্সের যৌথ কোম্পানি টিজিএস অ্যান্ড স্লামবার্জার, জাপানের ইনপেক্স করপোরেশন ও জোগম্যাক, চীনের সিনুক, সিঙ্গাপুরের ক্রিস এনার্জি এবং ভারতের ওএনজিসি আগ্রহ প্রকাশ করে বিভিন্ন সময় পেট্রোবাংলার সঙ্গে যোগাযোগ করেছে। এর মধ্যে সমুদ্রে বহুমাত্রিক জরিপের তথ্য কিনেছিল শেভরন, এক্সনমবিল, ইনপেক্স, সিনুক ও জোগোম্যাক।
সাগর সীমানা বিরোধ নিষ্পত্তির পর ১ লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গ কিলোমিটার সমুদ্র অঞ্চলের ওপর মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলাদেশের। দীর্ঘদিন পেরিয়ে গেলেও তার সুফল ঘরে তুলতে পারছে না বাংলাদেশ। গভীর সমুদ্রে ১৫টি এবং অগভীর সমুদ্রে ১১টি ব্লক বিদ্যমান। অগভীর সমুদ্রের দুটি ব্লকে অনুসন্ধান পরিচালনা করছে ভারতের কোম্পানি ওএনজিসি। এর আগে সর্বশেষ ২০১৬ সালে দরপত্র আহ্বান করা হয়েছিল। এরপর ২০১৯ সালে নতুন পিএসসি আপডেট করা হলেও দরপত্র ডাকা হয়নি।
বহুজাতিক কোম্পানিগুলোকে আগ্রহী করে তোলার জন্য আকর্ষণীয় করা হয় পিএসসি (উৎপাদন ও বন্টন চুক্তি)। আগের পিএসসিতে গ্যাসের দর স্থির করা দেওয়া হলেও এবার ব্রেন্ট ক্রডের দরের সঙ্গে মিল করে দেওয়া হয়। প্রতি হাজার ঘনফুট গ্যাসের দাম ধরা হয়েছে ব্রেন্ট ক্রডের ১০ শতাংশ দরের সমান। দামের পাশাপাশি বাংলাদেশের শেয়ারের অনুপাতও নামিয়ে দেওয়া হয়েছে। মডেল পিএসসি-২০১৯ অনুযায়ী গ্যাসের উৎপাদন বৃদ্ধির সঙ্গে বাংলাদেশের অনুপাত বৃদ্ধি পেতে থাকবে। তারপরও কোন আগ্রহী প্রতিষ্ঠান না পাওয়াটা চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। সবচেয়ে উদ্বেগে বিষয় হচ্ছে বাংলাদেশ যতো বেশি বিলম্ব করছে ততবেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। কারণ বাংলাদেশের পাশের ব্লকগুলো থেকে দীর্ঘদিন ধরেই গ্যাস উত্তোলন করছে মিয়ানমার।
মডেল পিএসসি ২০০৮ প্রণয়ন কমিটির প্রধান মকবুল ই-এলাহী চৌধুরী বার্তা২৪.কমকে বলেন, অনেকে মনে করেছিলেন গ্যাসের দাম বাড়ালেই কোম্পানিগুলো দৌড়ে আসবে। সেই ভাবনা ভুল প্রমাণিত হয়েছে। কেনো জমা হয়নি সেটা তালাশ করার পাশাপাশি কেনো মাত্র ৭টি কোম্পানি দরপত্র কিনেছে সেটাও দেখা দরকার। পিএসসিতে কিছু ঘাটতি রয়ে গেছে, এখানে শর্ত দেওয়া হয়েছে দৈনিক ২০ হাজার ব্যারেল (তেলের সমান) গ্যাস উত্তোলন করে এমন কোম্পানি দরপত্র কিনতে পারবে। এখানেইতো অনেক কোম্পানি বাদ পড়ে গেছে। আমি মনে করি গভীর সমুদ্রের ক্ষেত্রে ১০ হাজার এবং অগভীর সমুদ্রের ক্ষেত্রে ৫ হাজার ব্যারেল হওয়া উচিত। তাহলে আরও অনেক বেশি কোম্পানি অংশ নিতে পারবে।
তিনি বলেন, আমরা যখন ২০০৮ সালে পিএসসি প্রণয়ন করি তখন ১৫ হাজার ব্যারেল শর্ত দিতে যাচ্ছিলাম। একটি বিদেশি কোম্পানি এসে আমাদের বললো ২৫ হাজার ব্যারেল শর্ত দেওয়ার জন্য। আমরা রাজি না হলেও মন্ত্রণালয় থেকে ২৫ হাজার করা হয়েছিল। আরেকটি অন্যতম কারণ হচ্ছে ডাটা প্যাকেজের দাম অনেক বেশি। কোন কোন প্যাকেজের দাম মিলিয়ন ডলারের মতো। অন্য দেশে এসব ডাটা ফ্রি দেয়। ১৯৭৪ সালে আমাদের দেশে এসব ডাটা উন্মুক্ত ছিলো, তখন অনেক বেশি কোম্পানি অংশ নিয়েছিলো।
বাপেক্সের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক আমজাদ হোসেন বার্তা২৪.কমকে বলেছেন, আমরা আসলে ডাটার ব্যবসা করবো, নাকি গ্যাস দরকার। সেটা আগে চিহ্নিত করা দরকার। ডাটার দাম এতো রাখার কোন যৌক্তিকতা দেখি না।
পেট্রোবাংলা তথ্য অনুযায়ী গ্যাসের অনুমোদিত লোড রয়েছে ৫ হাজার ৩৫৬ মিলিয়ন ঘনফুট, (দৈনিক) এর বিপরীতে চাহিদা ধারণা করা হয় ৩ হাজার ৮০০ থেকে ৪ হাজার মিলিয়ন ঘনফুট। চাহিদার বিপরীতে দৈনিক ২ হাজার ৮০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ দেওয়া হচ্ছে, আর ঘাটতি থেকে যাচ্ছে প্রায় ১ হাজার ২০০ মিলিয়নের মতো।
বেশি চিন্তার হচ্ছে প্রতিনিয়ত দেশীয় গ্যাস ফিল্ডের উৎপাদন কমে যাচ্ছে, অন্যদিকে বাড়ন্ত রয়েছে চাহিদা। এক সময় ২৮০০ মিলিয়ন উৎপাদন হলেও এখন ১৯৩০ মিলিয়নে নেমে এসেছে। এ জন্য তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে স্থবিরতাকে দায়ী করে থাকেন জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা। তারা তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে জোর দেওয়ার দাবি জানিয়ে আসছে কয়েক বছর ধরেই।