কোভিড-১৯ ও প্রান্তিক মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি
-
-
|

ছবি: সংগৃহীত
দুদিন হলো ঢাকা থেকে গ্রামে চলে এসেছি। এখানে আসার পর থেকে তিনটি বিষয় লক্ষ্য করছি। এক, কোভিড-১৯ প্রতিরোধে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে আমাদের যে কয়েকটি করণীয় বা নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে তা এখনও প্রান্তিক মানুষের কাছে পৌঁছেনি। গ্রাম ও মফস্বলের সাধারণ মানুষগুলো এখনও গতানুগতিকভাবে চলাফেরা করছে। তারা নিজেকে আল্লাহর হাতে সপে দিয়ে বসে আছে। তাদের মতে, নিজের কোনো করণীয় নেই, আল্লাহ বাঁচালে কোনো নিয়ম না মেনেই বাঁচা যাবে।
দুই, কোভিড-১৯ নিয়ে এদের মধ্যে লোককাহিনীর মতো বিভিন্ন গল্প চালু হয়েছে। একেকজনের গল্পের সারমর্ম একেক রকম। কারও মতে, এটি রোগ নয়, ইহুদিদের প্রতি আল্লাহর গজব। কারও মতে, এটি কিয়ামতের আলামত। কারও মতে, এটি শুধুমাত্র সাবান, স্যানিটাইজার ও ওষুধ ব্যবসায়ীদের একটি ব্যবসার কৌশল। আবার কারও মতে নোভেল করোনাভাইরাস বা কোভিড-১৯ বলে কিছুই নেই। ঋতু পরিবর্তন হওয়ার কারণে মানুষ একটু-আধটু অসুস্থ হচ্ছে। বিদেশে সেটারই নাম দেওয়া হয়েছে নোভেল করোনাভাইরাস বা কোভিড-১৯।
এসব গল্প যারা প্রচার করে চলেছে তারা হলেন গ্রামে স্বল্পশিক্ষিত আত্মস্বীকৃত সচেতন নাগরিক। এদের একজন থেকে আরেকজন, তার থেকে আরও বহুজন-এভাবে ছড়িয়ে পড়ছে কথাগুলো। এসব গল্প প্রচারের মাধ্যমে আমাদের গ্রামাঞ্চলের একটি বিরাট অংশকে সচেতনতা ও সতর্কতার বাইরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, যা কিছুদিন পরেই সৃষ্টি করতে পারে ভয়ঙ্কর শক্তিশালী আতঙ্ক ও বিপর্যয়।
তিন, কোভিড-১৯ ভাইরাসে এখন পর্যন্ত মৃত্যুবরণ করা অধিকাংশ ব্যক্তিই ৭০ বছরের বেশি বয়সী। অর্থাৎ তারাই সর্বোচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছেন। কিন্তু এই রোগ সম্পর্কে সবচেয়ে কম জানেন তারাই। তাদের কাছে কোনো সংবাদ পৌঁছে না। পরিবেশগতভাবেই তাদের সংক্রমিত হওয়ার অজস্র সম্ভাবনার মধ্যে রয়েছেন। কোনোভাবে কেউ যদি একবার আক্রান্ত হয় তাহলে সেই এলাকায় এই রোগ নিয়ন্ত্রণ করা অসম্ভব হয়ে পড়বে।
এ তো গেলো গ্রামের অশিক্ষিত, আধাশিক্ষিত বা স্বল্পশিক্ষিত মানুষের কথা। শিক্ষিত প্রজন্মের মধ্যেও এ নিয়ে বিভ্রান্তি ও নোংরা রাজনীতির শেষ নেই। আমাদের শিক্ষিত প্রজন্মের একটি অংশ এই রোগকে নিয়ে ইন্টারনেটে মজা করে চলেছে। তারা এখনও বুঝে ওঠেনি যে, এটা মজা করার সময় নয়, নিজেকে ও চারপাশের মানুষকে বাঁচানোর সময় এটা। কয়েকদিন আগে ফেসবুকে একটা ট্রেন্ড চালু হয়েছিলো। সবাই স্বেচ্ছাসেবক হওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করে পোস্ট করা শুরু করেছিলো। ঠিক তার পরপরই বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন স্বেচ্ছাসেবক আহ্বান করলো। তারা জানালো যে, প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা ও আর্থিক সামর্থ্য থাকার পরও তারা স্বেচ্ছাসেবকের অভাবে কাজ করতে পারছেন না। এমন আহ্বানের পর তাদের খুব স্বাভাবিকভাবেই হাজার-হাজার কল পাওয়ার কথা ছিলো; কিন্তু পেয়েছে মাত্র কয়েকটি। অর্থাৎ এই কোভিড-১৯ ইস্যুকে আমাদের তরুণ প্রজন্ম অনেকটা নিজের ইমেজ বৃদ্ধির কৌশল হিসেবে নিয়েছে।
এবার নিজের একটি অভিজ্ঞতার কথা বলি। এলাকার মানুষের মধ্যে এমন অসচেতনতা দেখে ভাবলাম যে, আমাদের যেসব বন্ধুরা এখন আপাতত গ্রামে অবস্থান করছে তাদের নিয়ে কাজ শুরু করতে পারি। মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়ে অশিক্ষিত ও প্রবীণ ব্যক্তিদের আমরা বোঝাতে পারি, করণীয় সম্পর্কে সচেতন করতে পারি। কিছু ব্যক্তিকে সাবান-স্যানিটাইজার দেওয়ার জন্য উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানকে বললাম; তিনিও দিতে চাইলেন। এরপর প্রথম একজন বন্ধুকে প্রস্তাবটা দিলাম; যে নিজেও স্বেচ্ছাসেবক হতে চেয়ে পোস্ট করেছিলো। সে সরাসরি জানালো, তাকে নাকি বাসা থেকে কয়েকদিন বেরই হতে দেয়নি। অর্থাৎ সে কাজ করতে অস্বীকৃতি জানালো। অথচ তার লাস্ট কয়েকটা পোস্টে দেখলাম, সে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেওয়ার ছবি নিয়মিতই পোস্ট করেছে।
এটা হলো আমাদের তরুণ প্রজন্মের অবস্থা। এই প্রজন্ম নিয়ে আমরা কী করবো? এরা কি আমাদের দেশের অর্থপাচারকারী, ক্যাসিনো কারবারি ও ঘুষখোরদের চেয়ে কম ভয়ংকর? দেশের ক্রান্তিলগ্নেও এরা মানবিক হতে জানে না, এরা শুধু নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত। আমাদের অবস্থাটায় যদি এমন হয় তাহলে আমাদের সরকার ও প্রশাসনকে আমরা কেমন দেখবো? আমাদের দেশে সে সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে পুলিশ প্রয়োজন হয়, উপরন্তু একেকটি ট্রাজেডি থেকে একেকজন ভাইরাল হয়, কিংবদন্তী-সেলিব্রেটির জন্ম হয়।
এসব তো গেলো নিরাশার কথা। এতো সব নিরাশার মাঝে আশার বাণীও শোনা যায়। আর তা এই তরুণ প্রজন্মকে নিয়েই। একটা কথা সত্য যে, আমরা জাতি হিসেবে বেশ প্রযুক্তি নির্ভর হলেও আমাদের যথাযথ প্রযুক্তির যথেষ্ট অভাব রয়েছে। তাই আমরা কোভিড-১৯ প্রতিরোধে উন্নত দেশগুলোর মতো প্রযুক্তিনির্ভর ব্যবস্থা নিতে পারবো না। তবে আমাদের যথেষ্ট মানব সম্পদ রয়েছে। আমাদের সমস্যাগুলোও মানবসম্পদ দ্বারাই সমাধান উপযোগী।
আমাদের প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষের কাছে প্রযুক্তি পৌঁছাতে পারে না, কিন্তু ছেলে-মেয়েরা ঠিকই পৌঁছাতে পারে। দেশের সকল স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বর্তমানে গ্রামে অবস্থান করছে। এসব শিক্ষিত তরুণেরা নিজ নিজ এলাকায় কাজ করতে পারে; যা অনেকে অনেক জায়গায় ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে। প্রশাসন একইসঙ্গে সারা দেশের সকল জনপদে কাজ করতে পারে না, কারণ তাদের ততটা লোকবল নেই৷ এসব শিক্ষিত প্রজন্ম নিজেরা একেকটি টিম করে বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়ে কাজ করতে পারে। স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে আলাপ করে তাদেরও সহযোগিতা করতে পারে।
যেহেতু, বিপদ এসেছে তাই সম্মিলিতভাবে সবাই মিলেই এর মোকাবিলা করা প্রয়োজন। দেশের আনাচে-কানাচে প্রত্যেক জনপদে বর্তমানে শিক্ষিত ছেলেমেয়েরা অবস্থান করছে। তারা সবাই মিলে যদি সত্যিকার অর্থেই কাজ করতে নেমে যায় তাহলে কোভিড-১৯ প্রতিরোধে দেশে একটি বিপ্লবের সূচনা হবে। আর আমার বিশ্বাস, এ কাজে সরকারও আমাদের যথেষ্ট সহযোগিতা করবে।
শিক্ষার্থী, ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরি কলেজ, আই.ই.আর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়