নামতে নামতে, থামবে কোথায়?
-
-
|

আবরার ফাহাদ ও সিসিটিভি ফুটেজে মুমূর্ষু আবরারকে সিঁড়ি ঘরে নিতে দেখা যাচ্ছে হত্যাকারীদের (ডানে), ছবি: সংগৃহীত
আবরার ফাহাদ। একটি স্বপ্ন। এসএসসি আর এইচএসসিতে মেধার স্বাক্ষর রেখে অবতীর্ণ হয় ভর্তিযুদ্ধে। সেখানেও রাখে মেধার স্বাক্ষর। চান্স পায় ঢাকা মেডিকেল, কুয়েট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং বুয়েটে। গর্বে ভরে ওঠে বাবা-মা-ভাইসহ আত্মীয়স্বজন, বন্ধু, শুভাকাঙ্ক্ষীদের মন। তাকে নিয়ে স্বপ্নগুলো ডানা মেলে আকাশে। কিন্তু মেধাবী স্বপ্নের নামটি আজ দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়েছে। নামটি মনে হলেই ডুকরে কেঁদে উঠছে দেশবাসীর হৃদয়। আবরার যে নির্মমতার শিকার হয়েছে, তা শুনে শিউরে উঠছে সবাই।
আবরারকে পিটিয়ে মারা হয়েছে। কারা মেরেছে? কোনো ডাকাত, সন্ত্রাসী বা অচেনা দুর্বৃত্ত নয়, আবরারকে নির্মমভাবে হত্যা করেছে তারই প্রিয় বুয়েটের কিছু ছাত্র। তারা যে শুধু একই প্রতিষ্ঠানের ছাত্র তা-ই নয়, তারা একই হলের বাসিন্দাও। জেমি ও সাইফুলসহ ‘হত্যাকারীদের’ কেউ কেউ আবরারের সঙ্গে একই ব্যাচে লেখাপড়াও করে। ছাত্রদের প্রকাশ করা একটি সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যায়, ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতাকর্মী রাত ৮টা ১৩ মিনিটে আবরারকে ডেকে ২০১২ নম্বর কক্ষে নিয়ে যায়। ফুটেজে তাদের সঙ্গে স্বাভাবিকভাবেই হেঁটে যেতে দেখা যায় আবরারকে। হয়তো নিশ্চিন্তই ছিল আবরার। কারণ ওই কক্ষে অনেককেই যে ডেকে নিয়ে ‘শিক্ষা’ দিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়, সে কথা সে ভালো করেই জানে। যখন আবরার তাদের সঙ্গে যাচ্ছিল, নিশ্চয় কল্পনাও করতে পারেনি যে ব্যাচমেট আর ‘বড় ভাইয়েরা’ তাকে পেটাতে পেটাতে মেরেও ফেলতে পারে।
চেনাজানা ওই মানুষগুলোর সঙ্গে তো তার আগের কোনো শত্রুতা ছিল না, ছিল না কোনো দ্বন্দ্বও। বন্ধুত্ব না থাকলেও বৈরিতা তো ছিল না কখনও। দেখা হলে তো হাই-হ্যালো হতো। তাহলে? উত্তর নেই।
রাত সোয়া ৮টার দিকে যে তরতাজা তরুণ হেঁটে গেল, ব্যাচমেট আর বড় ভাইয়েরা তাকে এমন পেটানোই পেটাল যে রাত সোয়া ১টার দিকে তাকে ধরাধরি করে মুমূর্ষু অবস্থায় সিঁড়ি ঘরে ফেলে আসতে হলো।
খাবার আনতে গিয়ে এক ছাত্র যখন আবরারকে কাতরাতে দেখল, তখনও পেটুয়াদের একজন বলে উঠল, ‘ও (আবরার) নাটক করতেছে।’ কতটা নির্দয়! আহা কত না কষ্ট পেয়ে মরতে হলো আবরারকে।
শিক্ষকের মর্যাদা নাকি অনেক ওপরে? তাদের কাছে নাকি শিক্ষার্থীরা সন্তানের মতো? হল প্রোভস্ট না শিক্ষার্থীদের অভিভাবক? তাদের ভালোমন্দের দেখভালকারক? তাহলে তিনি এসে স্ট্রেচারে রাখা সন্তানকে নেড়ে চেড়ে দেখলেন, সত্যিই তার মৃত্যু হয়েছে। বুঝতে পারলেন, তারই এক সন্তানকে বখে যাওয়া অন্য সন্তানরা পিটিয়ে মেরে ফেলেছে। বুঝলাম, তিনি নিজেকে ওই স্ট্রেচারে দেখতে চান না বলেই তখন হয়তো মুখ খুলতে সাহস পাননি। কিন্তু মৃত্যুর খবর পেয়ে আবরারের মামা মোফাজ্জল হোসেন এসে যখন তার কাছে সিসিটিভি ফুটেজ দেখতে চাইলেন, তখন তিনি প্রথমে কেন রাজি হলেন না? তাহলে তিনিও কি বিষয়টি ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টায় সামিল ছিলেন? আবরার কি তার কেউ না? নাকি নিজের জানের মায়ায় তিনি এমনটি করেছেন? জানি না। হতে পারে, প্রোভোস্টসহ অন্যান্য শিক্ষকরা হত্যাকারীদের কাছ থেকে ভিডিও ফুটেজটি রক্ষা করতেই এমন কৌশল নিয়েছেন। কারণ, আমরা জানি, শিক্ষকরাও ছাত্র নামধারী ওইসব ক্যাডারদের কাছে জিম্মি। পুলিশ ঘটনার তদন্ত করছে। আশাকরি, তদন্তে সবকিছু খোলাসা হবে।
আজ অসংখ্য শিক্ষার্থী আবরারের হত্যার বিচার চাইছে। নিজেরা সংগঠিত হয়েছে। নিজেদের এবং সহপাঠীদের ওপর কথিত বড় ভাইদের র্যাগিং-নির্যাতনের বর্ণনা দিচ্ছে, প্রতিবাদ করছে। আহা! এই সাহসটা যদি তারা আগে দেখাতে পারত, তাহলে হয়তো আবরারকে মরতে হতো না। মানসিক-শারীরিক নির্যাতনের হাত থেকে বেঁচে যেত অনেকে। না জানি এমন কত নির্যাতনের খবর ভিডিও ফুটেজ না থাকায় আমাদের অগোচরেই রয়ে গেছে। আজ যদি ভিডিও ফুটেজ না থাকত বা আবরার যদি বেঁচে যেত, তাহলে হয়তো এ ঘটনাটিকেও অন্য খাতে প্রবাহিত করা হতো। হয়তো তখন শিরোনাম হতো-‘মাদক ও অস্ত্রসহ শিবির কর্মী আটক’। এদিক থেকে আবরারের ভাগ্য ভালোই বলা চলে। অপমান, অপবাদ থেকে বেঁচে গেছে আবরার।
নিজের ব্যাচমেট-জুনিয়রকে পেটাতে পেটাতে মেরে ফেলতে কি ছেলেগুলোর একটুও বুক কাঁপল না? তারা যে শুধু আবরারের ওপর জুলুম করেছে তা কিন্তু নয়, তারা নিজেদের ওপরও চরম জুলুম করেছে। ধ্বংস করে দিয়েছে নিজেদের ক্যারিয়ার, ভবিষ্যৎ। চুরমার করে দিয়েছে বাবা-মায়ের স্বপ্ন। তাদের স্বজনরা আর সমাজে মুখ দেখাতে পারছে না। আবরার হত্যায় অভিযুক্তদের বাড়িতেও আজ শুনশান নীরবতা, তাদের স্বজনরা কারো সঙ্গে কথা বলতে চাচ্ছে না।
শিবির, ছাত্রলীগ, ছাত্রদল…ক্ষমতার পালাবদলে কেউ রগ কাটবে, কেউ হাতুড়ি পেটা করবে, কেউ গলা কাটবে…। এক দল করলে আরেক দলের লোককে মারার অপসংস্কৃতি বছরের পর বছর ধরে চলে আসছে। বোকার দল! নির্বোধ ছাত্ররা হানাহানি করে প্রাণ দিচ্ছে, প্রাণ নিচ্ছে। তাদের কি চোখে পড়ে না যে বিভিন্ন দলের বেশির ভাগ রাজনীতিকরা একে অপরের ঘনিষ্ঠ আত্মীয়? দিনে মাঠে-ঘাটে বক্তৃতা দেওয়ার সময় যাদের গোষ্ঠী উদ্ধার করছে, রাতে তাদের সঙ্গেই করছে ডিনার। মাঝখান দিয়ে অবোধ ছাত্ররা মারা পড়ছে, খালি হচ্ছে মায়ের কোল। ছাত্রদের মধ্যে কেন এতো হিংস্রতা?
এই হানাহানি থেকে তারা আসলে কী পেল? সাময়িকভাবে হয়তো নিজেকে ক্ষমতাবান মনে হতে পারে। হলে বা ক্যাম্পাসে ‘বড় ভাই’ হয়ে থাকা যায়। কিন্তু সব ‘বড় ভাই’ কি জীবনে নেতা হতে পারে? ‘বড় ভাই’ ক্যারিয়ার কি তার জীবনের জন্য বড় কোনো অর্জনের সোপান? তার চেয়ে বড় অর্জন কি বুয়েটের মতো একটি স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী হওয়া নয়?
ছাত্ররাজনীতির নামে এসব বড় ভাইগিরি, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, ফাও খাওয়া, র্যাগিং, নির্যাতন, টর্চার সেল, টেন্ডারবাজি, হত্যা, খুন বন্ধ করতে হবে। না হলে সতীর্থদের হাতে খুন হবে আজ আবরার, কাল আরেকজন। আবরারের এভাবে চলে যাওয়ায় শুধু একটি প্রশ্নই আজ মনে ভেসে উঠছে বারবার- নামতে নামতে, তারা থামবে কোথায়?
শিমুল সুলতানা: আউটপুট এডিটর, বার্তাটোয়েন্টিফোর.কম