মানুষ ভালোবাসে উভতল মানুষ
-
-
|

অলঙ্করণ: কাজী যুবাইর মাহমুদ
ঘন বরফের শাদা বরফি
যখন মানুষের মুখ আর শান্তি দিতে পারে না
সে কার কাছে মুখ খুঁজে পায়?
সময়ের কাছে গচ্ছিত থাকে কি সব
যা কিছু হারায়?
যেমন চাঁদের ধ্বনি জমতে থাকে অন্তরাল পূর্ণিমায়।
না হলে সে কেন ডেকে নিয়ে আসে উৎসব!
আলোর খোসার মতো,
খসে পড়তেই উচাটন লাগে।
বিকল লাগে দেহের কলরব।
মনে হয় মানুষ মূর্ছিত
ঘন বরফের শাদা বরফি।
চাই বা না চাই
আমাদের জংধরা তালা নতুন চাবি খুঁজছে
৬০-এর দশকের কবিতা ছুঁয়ে ঘুম আঁকছে।
অবিশ্বাস দিয়ে ঘেরা থাকি
অবিশ্বাস ভেঙে গেলে ঝলসে যেতে পারি।
সম্ভব না জেনেও বিশ্বাস রাখি
মূর্ত হয় না যা তা নিয়ে অমরাবতী।
আমরা শরীরের চেয়ে ভালোবেসেছিলাম শরীরী মোচড়
আর তপস্বীকে অবাধ চেয়েছিলাম গৌরাঙ্গ ঘরে
ওদিকে মোম কেবল একাই গলে না
তাতে অন্ধকারও পোড়ে।
উভতল মানুষ
মানুষের দ্বিবিধ মুখ
মুহূর্তে খসে যেতে পারে।
পরিবর্তনের খসড়া প্রথম কবে লেখা হয়েছিল
কেউ জানে না,
মানুষ জানে আরাধনার সময় উড়ে গিয়েছিল ধূপছায়া।
মানুষ, আরক্ত
সফেদ হাওয়ায়।
সবুজ ফলের ভেতর—
কামড়ের দাগসহ বীজ কাহন।
তুমি তার জন্য সমতল মুখ হয়ো না
সে তাকে দেখতে না পেলে বিকৃত
বিপন্ন হবে আরো।
মানুষ ভালোবাসে উভতল মানুষ।
বৃক্ষ পয়গম্বর
মৃত্যু দানা বাঁধছে
সুগ্রীব সংসারে
বাসনার থালা চকচক করছে, আকাশে
জ্যোৎস্না কাল।
মানুষ জ্যোৎস্নার প্রিয় মখমল রুমালে ঢেকে নেয় দেহ
ভালোবেসে প্রিয়
দেনমোহর মিটিয়ে।
ভেদ বিভেদের অভেদতলে
লুটিয়ে যায় ঘাসফুলে।
আমি মর্মের কাছে মরমরিয়ে দেখছি,
পিনাকপাণি
যেন কিছু দিতে গেলেই মিলিয়ে যাবে।
বলছে সে
প্রাচীন বৃক্ষকে কিছু দিতে হয় না,
সে জানে জলের রসদ।
মানুষ বৃক্ষের থেকে চেয়ে নিতে পারে
আরো কিছুক্ষণ পাশে বসবার আয়ু।
ব্যাপন
মানুষের চোখ সুন্দর খুঁজে পেলে আমি ত্রস্ত হই
মানুষের চোখ ভালোবাসাকে অন্ধ দেখতে ভালোবাসে।
সে থেকে
আমি মানুষকে দেখাই না, কবে সূর্য বেগুনি জামফল হয়ে
চন্দ্রে হয়েছিল উপগত।
সে থেকে
আমি আঙুল থেকে বৃষ্টির জল ঝরতে দিইনি
যেন তারা জানে ব্রহ্মার কাঁপন
যেন তারা জানে মানুষের ভয়াবহ ব্যাপন ।
সভ্যতা হচ্ছে ট্রয়ের ঘোড়া
আমি ফেরাতে পারি না উপহার
নিয়ে আসি, যত্নে পুষি
আমার ভালো লাগে, যা তুমি দাও
যেমন একটা পৃথিবী দিলে।
পৃথিবী ভরপুর থই থই বিষাদে
আমি বিষাদ ভুলতে নিয়ে আসছি ট্রয়ের ঘোড়া
আমার প্রাসাদ পুড়ে খাক হোক
তার আগে বাজিয়ে নিই হারমোনিয়াম
মৃত্যুর আগে পান করা ভালো বিশ্বস্ত বিষ।
মধ্যমার রক্তপ্রবাল
মুহূর্তে মিলিয়ে যাই
যেন হয়নি কিছুই
ভুলে যাই
মধ্যমায় ছিল রক্ত প্রবাল।
দেখে থাকি, চলে যাবার বিবিধ প্রকার
পেয়ে গেছি মুক্তি,
স্বরের বিপরীত স্বর
আয়না দেখায় না কিছুই
তুমি বলছো, সব বায়োপ্লাজমিক ছায়া
চতুর্থ মাত্রা
এ-সব সরে যাবার বিবিধ প্রকার।
রক্তপাতের দায়মুক্ত নয় ভালবাসা
ভালোবাসার বদৌলতে স্বৈরাচার হয়ে উঠি
ভুলে যাই পৌরাণিক প্রেম, পাখি কণ্ঠ
লক্ষণ রেখা অতিক্রম করে মুছে ফেলি ভাগ্যরেখা।
হাতের তালু সাদা হয়ে যায়।
ললাটে চুমুর দাগ না থাকলে
ক্রোধাগ্নিতে জ্বলতে থাকে
বিষুবীয় সূর্য।
তখন কোন গ্রহণে আচ্ছন্ন তুমি
চাঁদ-ঘরে বন্দী কীর্তনখোলা নদী ।
এ কলঙ্ক জলের, জ্যোৎস্নার না,
ভালোবাসার শ্রেষ্ঠ উপহার
প্যান্ডোরার বাক্স।
ট্রয়ের কাঠের ঘোড়া
ঢুকে যাচ্ছে অসতর্কে।
ক্ষয়ের ভিতর থেকে কে পারে জন্মাতে ‘আনন্দ’
ক্ষিপ্রতায় জাপটে ধরে প্রবল বাতাস
পড়িয়ে দিতে, নিক্বণে?
সব প্রেম লাগে এক
সব ঘ্রাণ লাগে এক
যদি কেউ, অন্য কেউ হয়ে
ছোটায় সাদা ঘোড়া।
আর তাকে ভুল করে ভেবে ফেলি কল্কি অবতার,
কী করে ফেরাব মুখ
বিশ্বাসের মন্ত্রে বুঁদ।
অথচ ‘কেউ নেই’, বলছে সবাই
যেন সব ভুল
ভুল করে শুনে ফেলা অন্য ঘরের প্রেমবার্তা।
যে ঘরে দীপ জ্বলেনি বহুদিন
যে ঘর বাঘের পায়ের ছাপ যত্নে পোষে।
সে ঘরে প্যান্ডোরার বাক্স নিয়ে
আসতেই পারে রূপের নাগর।
আমি হাসতে হাসতে পিয়ে যাই ভ্রান্তির রস।
যেন শতাব্দীর শেষ কৌতুকে
হাসছে মৃত্যুদণ্ডের দার্শনিক ।
যখন পুড়ছিল ট্রয়ের নায়ক।
পলাতক আর বিজিতেরা খেলতে জানে
ছিনিয়ে নিতে জানে রসপূর্তির বিজয় উল্লাস।
ওদিকে হেলেন-প্যারিসের কঙ্কাল হাসছে, কালো জার্নালে ।
রক্তপাতের দায়মুক্ত নয়, ভালোবাসা!
তাসের তিনটি নায়ক
প্রথম প্রেমিক বলেছিল
একসময় ভালোবাসাকে আর ভালোবাসা যায় না।
রুটির ওপর পিঁপড়ার ঘুমিয়ে থাকার মতো মন শান্তি চায়।
দ্বিতীয় প্রেমিককে বলেছিলাম
বিরহ কোকিলকে করে গায়ক, আর কাককে ধারক
বাসর হচ্ছে নিকুঞ্জ পাখির খেয়াল।
তৃতীয় প্রেমিকের চোখ তখন নাবিকের মানচিত্র
আমি তাকে জুয়ার আসর পেতে দিই।
যমদূতের হাতে হেমলক দেখে, উত্তেজনায়—
খুলে ফেলেছিল সে আলোয়ান
তার বুকে ক্রুশবিদ্ধ তৃতীয় চোখ।
অন্ধকারে কালো বেড়াল খুঁজতে ভালোবাসে
তাসের তিনটি নায়ক।
বিগত মুখের প্রতি
ঈর্ষা হয়
প্রতিটি মুখের তার বিগত মুখের প্রতি
যেন ছায়ায় লুট হয়ে গেছে দেহ
ক্ষয়ের ভিতর দিয়ে প্রতিনিয়ত—
যে নতুন,
যাকে গ্রহণ করা দায়
যা থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া দায়
সেরকম—অপারস্পরিক সন্ধিবিচ্ছেদে
বেঁকে যাচ্ছি ক্রমশ সময়ের দিকে।
মানুষ হঠাৎ বৃদ্ধ হয়ে যায় এভাবে—
যেন সে অপেক্ষায় ছিল যে নবীন হাতের
সে-ই তাকে বৃদ্ধ করে দিল আরো।
মরুভূমির বৃষ্টি চাই
এটুকু না বুঝে উষ্ণ বায়ুর মেঘগুলি
উড়ে গেল ভিন্ন ভূমির হাওয়ায়।
যৌথ জীবন
লোহাটা চুম্বকের সাথে থাকতে থাকতে চুম্বক হয়ে গেল আর চুম্বক আগুনের পাশে থাকতে থাকতে লোহা।
নক্ষত্রের যৌথ জীবনে একটি সুপারনোভা হয়ে গেলে, অন্যটি হয়ে যায় ব্লাকহোল ।
আমাদের সূর্য গেরুয়া সন্ন্যাসী।
গ্রহ আর উপগ্রহের বাইরে, তার কোনো যৌথ জীবন নেই।