সৈয়দ শামসুল হক: তিনি আছেন পরানের গহীন ভিতরে
সব্যসাচী কথাটার অর্থ হচ্ছে যার দুই হাতই সমানভাবে কাজ করে। আর সব্যসাচী লেখক মানে যিনি সাহিত্যের সকল শাখায় সফলভাবে বিচরণ করেন। এমন প্রতিভা খুব কম মানুষেরই থাকে। সৈয়দ শামসুল হক সেই বিরল ভাগ্যবান লেখকদের মাঝে অন্যতম একজন। মাত্র এগারো বছর বয়সেই তিনি ছড়া লেখার চেষ্টা করেছিলেন। গদ্যকার হিসেবেই তিনি বাংলাসাহিত্যে প্রথম আত্মপ্রকাশ করেন।
১৯৫১ সালে মাত্র ষোলো বছর বয়সে ‘অগত্যা’ নামে ম্যাগাজিনে তাঁর লেখা গল্প প্রথমবার প্রকাশিত হয়। ১৯৫৪ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম গল্পের বই ‘তাস’। যদিও গদ্যকার হিসেবেই সাহিত্যে তিনি আত্মপ্রকাশ করেছিলেন, পরবর্তীতে সাহিত্যের অন্যতম প্রধান শাখা কবিতাতেও তিনি বিশেষ স্বাক্ষর রেখেছেন। তিনি একাধারে ছিলেন কবি, গীতিকার, কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার, প্রাবন্ধিক, অনুবাদক, শিশুসাহিত্যিক। তবে এখানে আমরা তাঁর কাব্যভাবনা বিষয়েই বিশেষভাবে আলোচনা করবো।
সৈয়দ শামসুল হকের কবিতার বৈশিষ্ট্যে আমরা কখনো পেয়েছি অন্তর্মুখীস্বভাব আবার কখনো পেয়েছি বহির্মুখীস্বভাব। তিনি সকলরকম ছন্দেই কাব্যচর্চা করেছেন। কবিতায় তিনি বারবার নিজেকে ভেঙে নতুন করে গড়তে চেয়েছেন। এজন্যই হয়তো তাঁর প্রথম জীবনের কবিতায় আমরা তাকে তেমন আলাদাভাবে চিহ্নিত করতে পারি না। কারণ তিনি সেই সময়কার সমসাময়িক কবিদের রচনাশৈলীকেই অনুসরণ করেছিলেন। পরবর্তী জীবনেও তিনি বারবার নিজের রচনাশৈলীর পরিবর্তন ঘটিয়েছেন। কবিতায় তিনি কখনো গদ্যরীতি ব্যবহার করেছেন, আবার কখনো পয়ার, কখনো অক্ষরবৃত্তে অন্ত্যমিলের চর্চা করেছেন।
তাঁর প্রথম কবিতার বই ‘একদা এক রাজ্যে’ প্রকাশিত হয় ১৯৬১ সালে। তবে এতে তিনি নিজেকে তেমন উজ্জ্বলভাবে প্রকাশ করতে পারেননি। দীর্ঘকবিতা, কাব্যনাট্যে এবং আঞ্চলিক ভাষার সফল প্রয়োগের ক্ষেত্রে সৈয়দ শামসুল হক নিজের প্রজ্ঞা'র বিশেষ পরিচয় দিয়েছেন। ১৯৭০ সালে প্রকাশিত হয়েছিল তাঁর প্রথম দীর্ঘকবিতার বই ‘বৈশাখে রচিত পঙক্তিমালা’। এই রচনাটিতে আমরা তাঁর অন্তর্মুখীস্বভাবকে বারবার পাই। এখানে কয়েকটা পঙক্তি থেকে পাঠ করলে আমরা অন্তর্মুখীস্বভাব বা আত্মকেন্দ্রিকতার ব্যাপারটা সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পাবো।
“এমন বিশ্বাস ছিল শুধু কবিতায়,/ প্রথমে করব জয় সুরূপা, বিরূপা;
তারপর পরিবার, যারা রোজ বলে,/ ‘কবিতার সরোবরে ফোটে অনাহার,
ছেঁড়া চটি, শস্তা মদ, আসক্তি বেশ্যায়’;/ তারপর বাংলাদেশ এশিয়া আফ্রিকা;
ফর্মায় ফর্মায় ক্রমে বেড়ে উঠে হবে/ কবিতার সংকলন খদ্দরে বাঁধানো,
যে কোনো ঋতুতে যে কোনো উৎসবে/ পাটভাঙ্গা পাঞ্জাবীতে লম্বমান যুবা
পড়বে সে বই থেকে; বাংলার তারিখে/ আমার জন্মের দিন হবে লাল ছুটি।”
অসম্ভব স্বপ্নগ্রস্তের মতন তিনি নিজের স্বপ্নের কথা বলে গেছেন কবিতার এই অংশটুকুতে। কবিতার যেই সময়টাতে দীর্ঘকবিতার দিন প্রায় ফুরিয়ে এসেছে, ঠিক সেই সময়েই তিনি এরকম ২৪ পৃষ্ঠা দীর্ঘ কবিতাচর্চা করেছিলেন। যদিও রচনাশৈলীর দিক থেকে এবং ভাষাশৈলীর দিক থেকে এরকম সংযোজন নতুন কিছু ছিল না। তবে দীর্ঘকবিতার কথা ভাবলে বলতে হয়, তিনি নিজেকে ঠিক এই জায়গাটাতেই ভেঙে গড়েছেন।
লেখক আনিসুল হক তাঁর সম্পর্কে বলেছেন, “তিনি যদি অন্য সব বাদ দিয়ে দুটো বই লিখতেন ‘পরানের গহীন ভেতর’ এবং ‘বৈশাখে রচিত পঙক্তিমালা’ তাহলে এ দুটো বই তাকে অমর করে রাখত। তিনি যদি শুধু তার কাব্যনাট্যগুলো লিখতেন ‘নুরলদিনের সারাজীবন’ এবং ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’ তাহলেও আমরা চিরদিনের জন্য তাকে বাংলা সাহিত্যে স্মরণ করতে বাধ্য থাকতাম। তাঁর কবিতা-নাটক-কলাম সবটা মিলিয়ে যে ব্যক্তিত্বটি দাঁড়ায় তা তুলনারহিত।”
আনিসুল হক সাহেব তাঁর সম্পর্কে এদিক থেকে খুব বেশি বাড়িয়ে বলেননি। প্রচুর সংখ্যক লেখার মধ্য দিয়ে এবং নিজেকে বারবার ভেঙে-গড়ার মধ্য দিয়েই হয়তো তিনি তাঁর এই অনন্য সৃষ্টিকর্মগুলো রচনা করতে পেরেছিলেন। ‘পরানের গহীন ভিতর’- সৈয়দ শামসুল হকের জনপ্রিয় বইগুলোর একটি। বইটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৮০ সালে। এই বইটি ৩৩টি সনেটগুচ্ছ নিয়ে সাজানো। মানভাষা এবং আঞ্চলিক ভাষার সংমিশ্রণে লেখা কবিতাগুলো ভাষা-শৈলীতে অনন্য। যদিও কবিতার বিষয়বস্তু গ্রাম্য-সংসারী জীবনের প্রেম, হিংসা, মান-অভিমান এবং বাস্তবতার বিষয়ে- বলা যায় প্রায় একরকম আত্মমগ্নতারই কথা। তবে এই কবিতার বইয়ের বিশেষ ভাষা-শৈলী এবং গ্রামবাংলার মানুষের অনুভূতির বিন্যাসে লেখা কবিতাগুলো পাঠকের মনের মণিকোঠায় উজ্জ্বল জায়গা করে নিয়েছে। একইসাথে বাংলাসাহিত্যে এই বইটি একটি অনুপম সৃষ্টিকর্ম। বইটি থেকে আমরা একগুচ্ছ পঙক্তির পাঠ নিতে পারি।
“মানুষ এমন ভাবে বদলায়া যায়, ক্যান যায়?
পুন্নিমার চান হয় অমাবস্যা কিভাবে আবার?
সাধের পিনিস ক্যান রঙচটা রোদ্দুরে শুকায়?
সিন্দুরমতির মেলা হয় ক্যান বিরান পাথার?
মানুষ এমন তয়, একবার পাইবার পর
নিতান্ত মাটির মনে হয় তার সোনার মোহর।।”
অধ্যাপক আনিসুজ্জামান সাহেব বিবিসি বাংলায় তাঁর সম্পর্কে বলেছেন, “আমাদের সাহিত্যিকদের মধ্যে সৈয়দ শামসুল হক ভাষার ব্যবহার নিয়ে যে লিখেছেন 'হৃৎকলমের টানে' বা 'কথা সামান্যই' এগুলো কিন্তু অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজ। তিনি একইসঙ্গে একজন সৃষ্টিশীল লেখক এবং ভাষার ব্যবহারে ছিলেন অত্যন্ত সচেতন।”
ভাষার ব্যবহারে সৈয়দ শামসুল হক যে ভীষণ সচেতন ছিলেন তা আমরা তাঁর সৃষ্টিকর্মের দিকে নজর দিলেই বুঝতে পারি। কেননা প্রথম জীবনে তিনি অন্যান্য সমসাময়িক লেখকদের মতন কলকাতার মানভাষা ব্যবহার করলেও, পরবর্তীতে তিনি ভাষার ব্যবহারে আরো সচেতন হয়ে উঠেছিলেন। যে কারণে আমরা ‘পরানের গহীন ভিতর’ কিংবা ‘নুরুলদীনের সারাজীবন’ এর মতন সৃষ্টিকর্ম তাঁর কাছ থেকে পেয়েছি।
যদিও কবিতা নিয়েই আমাদের আলোচনা তবুও কাব্যনাট্য নিয়ে কথা না বললে আসলে কথা অসম্পূর্ণই থেকে যাবে। আধুনিক যুগে যেখানে কবিতাও গদ্যের দিকেই প্রবাহিত হচ্ছে, সেখানে সৈয়দ শামসুল হক কাব্যনাট্যে মনোযোগী হয়েছিলেন। আর কাব্যনাট্য নাটক হলেও তো তা কাব্যেই লেখা। তাঁর প্রথম কাব্যনাট্য ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’ প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৭৬ সালে।
মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে লেখা এই কাব্যনাট্য'কে আমরা বৈচিত্র্য এবং বিন্যাসের দিক থেকে বাংলাসাহিত্যে অন্যতম সংযোজন বলতে পারি। আঞ্চলিক ভাষা-শৈলীতে এবং মৈমনসিংহ-গীতিকা'র ঢঙে লেখা এই কাব্যনাট্য মুক্তিযুদ্ধের রক্তাক্ত ইতিহাস ও মানব-মনের অন্তর্গত অনুভূতিকে স্পর্শ করেছে। পাঁচ অঙ্কে লেখা এই কাব্যনাট্যে গ্রামীণ ইতিহাস ফুটে উঠেছে।
মুক্তিযুদ্ধের বিভীষিকাকে ফুটিয়ে তুলতে তিনি আশ্রয় নিয়েছেন গ্রামীণ-মানুষ, মুক্তিযোদ্ধা এবং মাতবর চরিত্রে। গ্রামের মাতবর যে-কিনা পাকিস্তানিদের সাথেই হাত মিলিয়েছিল। যে মাতবর দেশের জন্য কালসাপ। যে মাতবর দেশের শত্রু। দেশের মানুষের শত্রু। এই কাব্যনাট্যের মধ্য দিয়ে আমরা সৈয়দ শামসুল হকের ইতিহাস-সচেতনতার দিকটি জানতে পারি। এই রচনাটিতে রাজাকারই কেন্দ্রীয় চরিত্র কিংবা অন্য অর্থে নায়কও বলতে পারি,যে মানুষ কিনা নিজের মেয়েকে নিজেই পাকিস্তানিদের হাতে তুলে দিতে চায়। এই দিক থেকে আমরা দেখতে পাই, একজন লোভী-সুবিধাবাদী-অসৎ মানুষের মনস্তাত্ত্বিক টানাপোড়েন। আর একইসাথে জানতে পারি যুদ্ধ বিজয়ের পর গ্রামের মানুষ ও মুক্তিযোদ্ধাদের মনস্তত্ব।
কাব্যনাট্য বিষয়ে আলোচনা করলে কোনোভাবেই আমরা ‘নুরলদীনের সারাজীবন’ কাব্যনাট্যকে বাদ রেখে আলোচনার সমাপ্তি ঘটাতে পারি না। ব্রিটিশ-বিরোধী আন্দোলন ফকির-বিদ্রোহের পটভূমিতে রচিত এই কাব্যনাট্য আমাদেরকে প্রায় ভুলতে যাওয়া ইতিহাসকে পুনরায় স্মরণ করিয়ে দেয়। এই বইটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৮২ সালে। এখানে কেন্দ্রীয় চরিত্র নুরুলদীন ফকির-আন্দোলনের একজন নেতা। আসলে নুরুলদীনকে আমরা অসাম্প্রদায়িক বিপ্লবের চেতনাও বলতে পারি। যে কিনা নতুন দিনের আশায় অত্যাচারীর বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে নিজের প্রাণ উৎসর্গ করেছে।
১৭৭১ সালের ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহ হচ্ছে বাংলার মাটিতে প্রথম সংগঠিত বিপ্লবের নাম। যে বিপ্লবীদের ব্রিটিশরা দস্যু নামে অবিহিত করেছিল। ব্রিটিশরা ও জোতদারেরা যখন তীর্থে যাবার সময়েও সন্ন্যাসীদের কাছ থেকে কর আদায় করতে চেয়েছিল, জমিদারেরা যখন ঋণ দেবার নাম করে চড়া সুদে সাধারণ গ্রামীণ-চাষীদের জমি কেড়ে নিচ্ছিল, নীল-চাষে বাধ্য করছিল, ঠিক তখন ফকির-সন্ন্যাসীরা বিদ্রোহী হয়ে উঠেছিল।
এই কাব্যনাট্যে নুরুলদীনের প্রথম সংলাপই হচ্ছে, ‘জাগো বাহে-এ, কোনঠে সবা-য়’। মানে নুরুলদীন আপামর জনগণকে ঘুম থেকে জেগে উঠতে বলছে। বিপ্লবের চেতনায় জেগে উঠতে বলছে। সংগ্রামী হবার স্বপ্নের কথা বলছে। অত্যাচারী শাসকের বিরুদ্ধে দাঁড়াবার কথা বলছে। যে নুরুলদীন নবাব হতে চায় না, দেবতাও হতে চায় না। কেবল এবং কেবলমাত্র বিপ্লবীই হতে চায়। সে কেবল তার চেতনাকে ছড়িয়ে দিতে চায় সবার মাঝে।
নুরুলদীন ছাড়া এই কাব্যনাট্যে আছে লালকোরাস, নীলকোরাস, আম্বিয়া, আব্বাস এবং কয়েকটি ব্রিটিশচরিত্র। এখানে লালকোরাস আদতে বাঙলার আপামর শোষিত শ্রেণীর কণ্ঠস্বর। যারা বিপ্লবের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হতে চায়। নীলকোরাস হচ্ছে শোষকের কণ্ঠস্বর। যারা বিপ্লবকে দুমড়েমুচড়ে নিঃশেষ করে দিতে চায়। আব্বাস হচ্ছে নুরুলদীনের বন্ধু এবং একইসাথে সমাজের পিছুটানের রূপক প্রকাশ। এবং আম্বিয়া হচ্ছে নুরুলদীনের ভালোবাসার নাম। তাঁর স্ত্রী। তাঁর সংসার। যে সংসার সবসময় মানুষকে মায়ার বাঁধনে বেঁধে পিছুটানের সৃষ্টি করে। যাকে নুরুলদীন বিপ্লবের জন্য ত্যাগ করেছে। আঞ্চলিক ভাষার ব্যবহারে এবং পটভূমির গুরুত্বে এই রচনা বাংলাসাহিত্য একটা বিশেষ সংযোজন।
অনেকেই তো অনেক রকম কথা বলে থাকেন। অনেকে বলেন, সৈয়দ হক বারবার নানানভাবে প্রভাবিত ছিলেন। কখনো তিনি তাঁর সমসাময়িক লেখকদের পদাঙ্ক অনুসরণ করেছেন আবার কখনো বিশ্বসাহিত্যে প্রভাবিত হয়েছেন। কিন্তু প্রভাব ছাড়া তো কোনো লেখকই নিজেকে ফুটিয়ে তুলতে পারেন না। নিজেকে যে যতভাবে যতবার ভেঙে নতুন করে গড়ে তুলতে পারেন তিনিই তো হয়ে উঠেন শক্তিশালী লেখক। আর সৈয়দ শামসুল হক সেই কাজটাই করতে পেরেছেন। এবং বাংলাসাহিত্যে বাঙালির মধ্যবিত্ত আর নিম্নবিত্ত মনস্তত্বে তাঁর যা সংযোজন; সেজন্যই তিনি হয়তো বহুযুগ ধরে পাঠকের পরানের গহীন ভিতরে থেকে যাবেন।
এক নজরে জীবনপঞ্জি:
জন্ম: ২৭ ডিসেম্বর ১৯৩৫ সাল
জন্মস্থান: কুড়িগ্রাম, বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি, ব্রিটিশ ভারত।
মৃত্যু: ২৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৬ সাল
উল্লেখযোগ্য রচনাবলি: নিষিদ্ধ লোবান, খেলারাম খেলে যা, পরানের গহীন ভিতর, পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়, নুরুলদীনের সারাজীবন।
উল্লেখযোগ্য পুরস্কার: বাংলা একাডেমি(১৯৬৬), জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার (১৯৮২), একুশে পদক(১৯৮৪)।