নজরুল-শরৎ সম্পর্ক
মহত্তম কবি কাজী নজরুল ইসলাম 'শরৎচন্দ্র' নামাঙ্কিত কবিতা ১৩৩৪ আশ্বিনের নওরোজে প্রকাশ করেন। পাদটীকায় বলা হয়: "স্বনামধন্য ঔপন্যাসিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ে দ্বিপঞ্চাশৎ বর্ষ জন্মোৎসব উপলক্ষে রচিত।" রচনার স্থান ও তারিখ: কৃষ্ণনগর, ২৯ ভাদ্র, ১৩৩৪। শরৎচন্দ্রের মৃত্যুর পর কবিতাটি ১৩৪৪ মাঘের বুলবুলে পুনর্মুদ্রিত হয়। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ১৪৫তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে আরও একবার ফিরে দেখা বাংলা সাহিত্যজগতের দুই খ্যাতনামা ব্যক্তিত্ব শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এবং কাজী নজরুল ইসলামের পারস্পরিক সম্পর্ককে। জীবদ্দশায় একাধিকবার তাঁদের সাক্ষাৎ হয়। তাঁদের মধ্যে যে পারস্পরিক শ্রদ্ধার সম্পর্ক ছিল, তা সত্যিই শিক্ষণীয়। সেরকমই কিছু ঘটনা:
১. ২৪শে জুলাই, ১৯২২ সালে কলেজ স্কোয়ারে বঙ্গীয় থিওসফিক্যাল সোসাইটির হলে সরস্বতী ইনস্টিটিউশন আয়োজিত এবং শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সত্যেন্দ্র- স্মৃতিসভায় কাজী নজরুল ইসলাম স্বরচিত শোক সঙ্গীত 'চলচঞ্চল বাণীর দুলাল এসেছিল পথ ভুলে' গেয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। স্মরণ সভায় শ্রদ্ধানিবেদন করে বক্তব্য দেন অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, প্রমথ চৌধুরী, চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ।
২. কাজী নজরুল ইসলামের একক সম্পাদনায় ২৬শে শ্রাবণ, ১৩২৯ (১১ই আগস্ট, ১৯২২) শুক্রবার সপ্তাহে দুবার প্রকাশের ঘোষণা দিয়ে অর্ধ-সাপ্তাহিক ধূমকেতু পত্রিকার আত্মপ্রকাশ হয়। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় শিবপুর থেকে ৯ই আগস্ট, ১৯২২ সালে ধূমকেতুর প্রকাশ উপলক্ষে নজরুলকে দেওয়া এক শুভেচ্ছা পত্রে লেখেন:
২৪শে শ্রাবণ
শিবপুর
পরম কল্যাণীয়বরেষু,
তোমার কাগজের দীর্ঘজীবন কামনা করিয়া তোমাকে একটিমাত্র আশীর্বাদ করি, যেন শত্রু মিত্র নির্ব্বিশেষে নির্ভয়ে সত্য কথা বলিতে পার। তারপরে ভগবান তোমার কাগজের ভার আপনি বহন করিবেন।
তোমাদের-
শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
৩. ১৭ই মে, ১৯২৩ সালে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় লীলারাণী গঙ্গোপাধ্যায়কে পত্রখানি লেখেন:
হুগলী জেলে আমাদের কবি কাজী নজরুল উপোস করিয়া মর-মর হইয়াছে। বেলা ১টার গাড়ীতে যাইতেছি, দেখি যদি দেখা করিতে দেয় ও দিলে আমার অনুরোধে যদি সে আবার খাইতে রাজী হয়। না হইলে আর কোন আশা দেখিনা। একজন সত্যকার কবি। রবিবাবু ছাড়া বোধহয় এখন কেহ আর এত বড় কবি নাই।... দাদা
৪. ১৭ই সেপ্টেম্বর, ১৯২৭ সালে শরৎচন্দ্রের ৫২তম জন্মজয়ন্তী উপলক্ষে আয়োজিত সভায় নজরুল অংশগ্রহণ করেন। তিনি স্বরচিত 'কোন শরতে পূর্নিমা চাঁদ আসিলে এ ধরাতল' গানটি পরিবেশন করে শরৎচন্দ্রের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেন।
৫. ১৬ই সেপ্টেম্বর, ১৯২৮ সালে অ্যালবার্ট হলে প্রমথ চৌধুরীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে নিরুপমা দেবী রচিত উদ্বোধনী সংগীত 'তুমি যে মধুকর কমল বনে' পরিবেশন কালে দিলীপকুমার রায়, নলিনীকান্ত সরকার ও সাহানা দেবীর সঙ্গে নজরুল কন্ঠ দেন।
৬. ১২ই অক্টোবর, ১৯২৮ সালে সাপ্তাহিক সওগাতে প্রকিশিত। বিষয়: নজরুল-সম্বর্ধনা: গত ৯ই অক্টোবর, মঙ্গলবার সন্ধ্যায় মুসলিম ইনস্টিটিউট হলে খান বাহাদুর মৌলবী আসাদুজ্জামান এম.এ.বি-এল সাহেবের সভাপতিত্বে এক জনসভা হয়। বহু গণ্যমান্য ব্যক্তি সভায় উপস্থিত ছিলেন। সভায় এত লোকের সমাগম হইয়াছিল যে, সম্পূর্ণ হলে তিল ধারণের স্থান ছিলনা। উপরন্তু হলের সম্মুখস্থ ও পিছনের বারান্দাও জনতায় ভরিয়া গিয়াছিল। সমবেত মুসলিম তরুণের ঘন ঘন আনন্দ করতালিতে সভাস্থল সরগরম হইয়া উঠিয়াছিল। এই সভায় তরুণ মুসলিমের যে প্রাণের সাড়া পাওয়া গিয়াছে, তাহা অপূর্ব। বাংলার যুগপ্রবর্তক কবি নজরুল ইসলামকে সমগ্র বাংলার পক্ষ হইতে সম্বর্ধনা দিবার জন্য সভায় এক শক্তিশালী অভ্যর্থনা কমিটি গঠিত হইয়াছে। তাহাতে নিম্নলিখিত ভদ্র মহোদয়গণ কর্মকর্তা নির্বাচিত হইয়াছেন।
সভাপতি- এস. ওয়াজেদ আলী বি-এ (ক্যান্টাব), বার এট-ল, প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেট।
সহ-সভাপতি- শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, রায় শ্রী জলধর সেন বাহাদুর, এ.কে.ফজলুল হক, খান বাহাদুর মৌলবী আসাদুজ্জামান, দিলীপকুমার রায়, ডা. আর. আহমদ, সৈয়দ ইসমাইল হোসেন সিরাজী।
সম্পাদক- দীনেশরঞ্জন দাশ, সম্পাদক, কল্লোল; এম. নাসিরুদ্দীন, সম্পাদক, সওগাত।
সহ-সম্পাদক- সৈয়দ জালালুদ্দীন হাশেমী, প্রেমেন্দ্র মিত্র, মৌঃ আবুল মনসুর আহমদ, মৌঃ মোয়ায়েদ বখত চোধুরী, মৌঃ আয়নুল হক খাঁ।
কোষাধ্যক্ষ- এস. ওয়াজেদ আলী বি-এ (ক্যান্টাব), বার এট-ল, প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেট।
অভ্যর্থনা সমিতি অফিস- ১১নং ওয়েলেসলী স্ট্রীট, কলিকাতা।
৭. ২৪শে ডিসেম্বর, ১৯৩১ সালে নিউ থিয়েটার্সের প্রথম সবাক ছায়াছবি শরৎচন্দ্রের 'দেনা পাওনা' কলকাতার চিত্রা প্রেক্ষাগৃহে প্রথম মুক্তি পায়। প্রেমাঙ্কুর আতর্থী পরিচালিত এই ছায়াছবির মহরত অনুষ্ঠানে নজরুল উপস্থিত ছিলেন এবং মহরত অনুষ্ঠানে আবৃত্তি ও গানে অংশ নিয়েছিলেন।
৮. ১৭ই সেপ্টেম্বর, ১৯৩৭ সালে শরৎচন্দ্রের জন্মদিনে অল ইন্ডিয়া রেডিও তাঁকে সংবর্ধনা প্রদানের বিশাল আয়োজন করে। এ উপলক্ষে কলকাতা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত 'শরৎশর্বরী' অনুষ্ঠানে শরৎচন্দ্রের উপস্থিতিতে নজরুল স্বরচিত কবিতা আবৃত্তি করেন। শরৎচন্দ্রের জীবদ্দশায় এটিই ছিল তাঁর শেষ জন্মোৎসব।