‘সহমত’ একটি গভীর বিকারের লক্ষণ
-
-
|

কাজী মসিউর রহমান, ছবি: বার্তা২৪
ষোড়শ শতকের খ্যাতিমান দার্শনিক ইতিয়েন দ্য লা বোয়েতি তার ‘ডিসকোর্স অন ভল্যান্টারি সার্ভিচিউড’ গ্রন্থে লিখেছেন, “যদি তোমার সুঠাম হাত ব্যবহার করতে না দাও তবে একজন নিপীড়ক কী করে অগণিত মানুষকে অত্যাচার করতে সক্ষম হয়? তোমাদের পাগুলো সে ব্যবহার করার সুযোগ যদি না পায় তবে এত বিশাল ভৌগোলিক এলাকায় কীভাবে সে ত্রাসের আধিপত্য জারি রাখে?” কী অকাট্য যুক্তি! কী অন্তর্ভেদী জিজ্ঞাসা!
ইতিহাসে এ জিজ্ঞাসাগুলো বার বার উঠে আসে। বিশেষ করে ২১ শতকের বাংলাদেশে প্রশ্নগুলো ভীষণভাবে প্রাসঙ্গিক, যখন চারিদিকে ‘সহমত ভাই’ নামে এক নতুন প্রজাতির বিকাশ দৃশ্যমান। এরা যেন মোসাহেবির চতুর্থ প্রজন্ম। বিষয়টিকে যে গুরুত্বহীন ভাবা যাবে, তা কিন্তু নয়। তলিয়ে দেখা দরকার, এখনকার নাগরিকেরা কেন ক্রমাগত ‘সহমত ভাই’ প্রজন্মের অনুসারী হয়ে উঠছেন।
সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদকে অধিকাংশ রাজনৈতিক দল সদস্যদের কাছ থেকে প্রশ্নাতীত-আনুগত্য প্রতিষ্ঠার হাতিয়ার হিসেবে বিবেচনা করেন। অথচ, দলের যাবতীয় সিদ্ধান্ত সবাই মেনে নাও নিতে পারেন। সেটিই তো স্বাভাবিক। ওদিকে অধিকাংশের ঐকমত্যের কারণে ভিন্নমতপোষণকারী সদস্যরা এক ধরনের গণতান্ত্রিক বিচ্ছিন্নতার শিকার হন। শুধু বিচ্ছিন্নতাই নয়, সেই সাথে হারাতে পারেন রাষ্ট্রীয় ও রাজনৈতিক সুবিধা।
প্রকৃতপক্ষে রাজনৈতিক দল, গণমাধ্যম, শিক্ষা ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান মানুষের মতাদর্শিক পৃথিবী নির্মাণ করে। এসব প্রতিষ্ঠানের প্রায় সবখানে যদি ভিন্নমত নিরুৎসাহিত হয় তবে তা থেকে জন্ম নেয় ‘সহমত ভাই’। মানুষের মস্তিষ্কে প্রায় দু’শ বিলিয়ন নিউরন রয়েছে বলে বিজ্ঞানীরা এক রকম নিশ্চিত করেছেন। এই নিউরন-সমুদ্রের যে অংশগুলো শিশুর সামাজিকায়ন ও শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে উদ্দীপ্ত করা হবে, শিশুটি প্রকৃত প্রস্তাবে সে দিকেই বুদ্ধি নির্মাণের ঝোঁক তৈরি করতে সমর্থ হবে। অথচ, আজ পর্যন্ত কিন্ডারগার্টেন থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোথাও কি বৃহত্তর অর্থে ভিন্নমত অনুশীলনের পরিসর সৃষ্টি করা হয়েছে? হয়নি। প্রায়শই আমাদের শ্রেণিকক্ষগুলো যেন এক একটি সামন্ত-রাজের দরবার কক্ষে পরিণত হচ্ছে। সেখানকার সামগ্রিক আবহ শিক্ষার্থীদের তটস্থ না করে পারে না।

অথচ, ভিন্নমত তো গণতন্ত্রকেই শক্তিশালী করে। গণতন্ত্রের আকাঙ্ক্ষায় বঙ্গবন্ধু, জাতীয় চার নেতাহসহ দেশপ্রেমিক ত্রিশ লাখ মানুষ জীবন দিয়েছেন। সম্ভ্রম হারিয়েছেন চার লাখেরও বেশি নারী মুক্তিযোদ্ধা। প্রায় অধিকাংশ রাজনৈতিক দলও স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন ওই গণতন্ত্রের জন্যই। আইনের শাসন, অবাধ সুষ্ঠু নির্বাচন, সকল নাগরিকের সমান অধিকার, সম্পদ ও ক্ষমতায় সমতাভিত্তিক অংশগ্রহণ, আধিপত্যবাদের অনুপস্থিতি, সমালোচনার অধিকার ইত্যাদিই তো আসল গণতন্ত্রের মূল উপকরণ। অন্যভাবে বললে, মুক্তিযুদ্ধের প্রধান চেতনা- সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায় বিচারই হলো গণতন্ত্রের বুনিয়াদ।
গত কয়েক দশকে বাংলাদেশে একটি নয়া মধ্যবিত্ত শ্রেণির বিকাশ ঘটেছে। এরা বৈষয়িক অর্জনের জন্য বেপরোয়া। এ মধ্যবিত্ত প্রধানত চাটুকারিতা আর তোষামোদে তুলনাহীন। আমাদের সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলো ‘গণতান্ত্রিক’ হয়ে উঠতে পারেনি। সন্তানেরা দেখছে- তাদের অনুস্মরণীয় বয়োজ্যেষ্ঠরা, এমনকি শিক্ষকরা প্রশ্নাতীত ‘সহমত ভাই’ হয়ে যাচ্ছেন দিনে দিনে। একি তারুণ্যের নিছক নীচতা, না-কি সমাজ ও সংস্কৃতির সামগ্রিক পরাজয়?
পরাজয় বলছি, কারণ দেশে অর্থনৈতিক উন্নয়ন হয়েছে বটে, কিন্তু সমাজটা তো উদার, মানবিক আর গণতান্ত্রিক হতে পারেনি। গণতন্ত্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক হলো ভিন্ন মতের অনুশীলন। সেই সক্রেটিস থেকে শুরু করে অমর্ত্য সেন পর্যন্ত আমরা দেখেছি যে, যৌক্তিক ও মানবিকভাবে ভিন্নমত চর্চার মধ্য দিয়ে একটি সমাজ প্রগতির পথ ধরে সামনের দিকে এগিয়ে যায়। সমাজে সহনশীলতা ও বহুত্ববাদী মুল্যবোধ বিকশিত হয়।
নেতানেত্রীরা যতই বলছেন দুর্নীতির বিরুদ্ধে শূন্য সহনশীলতা, পাল্লা দিয়ে ততই বাড়ছে লুণ্ঠন, দুর্নীতি, ধর্ষণ। তাই বলতে চাই, পুকুরের সবটুকু জল বিষাক্ত হলে বোয়াল, মাগুর বা মলা কোনো মাছই ভালো থাকতে পারে না। হয়তো ছোট মাছটা আগে মরে। পালা কিন্তু সবারই আসে একদিন। প্রায় সবাই ‘সহমত ভাই’ প্রজন্মে নাম লেখালে সমাজের বৃহত্তর রুগ্নতা, অন্যায্যতা ও প্রতিক্রিয়াশীলতা দীর্ঘ মেয়াদে কাউকে শান্তিতে থাকতে দেবে না। তাই ‘সহমত ভাই’ রোগের সমাধান হিসেবে আবার ইতিয়েন দ্য লা বোয়েতি’র কথাই উল্লেখ করতে চাই। তিনি বলেছেন, ‘‘যদি শীতল জল দিয়ে নিপীড়নের আগুন নেভাতে না পার, তবে দানবীয় সেই অগ্নিশিখায় অতিরিক্ত শুষ্ক জ্বালানি সঞ্চালন করা থেকে বিরত থাকো।"
কাজী মসিউর রহমান: শিক্ষক, ইংরেজি বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।