বাঙালি জাতিসত্তার আলোকস্তম্ভ একুশে। সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক অধিকারের ঐক্যবোধ এনেছিল একুশে। একাত্তর–উত্তর রাষ্ট্র গঠনের মৌলিক এবং অন্যতম অনুপ্রেরণা একুশে। ব্যক্তিগতভাবে এক আত্মিক সম্পর্ক রয়েছে আমার একুশের সঙ্গে। আমার পিতা একজন ভাষাসৈনিক। আমার পিতা ডা. এ.এ. মাজহারুল হক ১৯৫২ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজের একজন তরুণ ছাত্র। ভাষা আন্দোলনে রয়েছে তাঁর সরাসরি অংশগ্রহণের অবদান। কিশোরগঞ্জে বসবাসের দিনগুলোতে তিনি ভাষা আন্দোলনের স্মৃতি ও সংগ্রামকে বার বার তুলে ধরেন মানুষের কাছে। সমাজের পক্ষ থেকেও তাঁকে জানানো হয় সম্মান।
একাধিক সাক্ষাতকারে তিনি জানিয়েছেন ছাত্ররা যে এক রাতে তৈরি করেন প্রথম শহীদ মিনার, সেই প্রত্যক্ষ স্মৃতি। সাংবাদিক আশরাফুল ইসলাম (কিশোরগঞ্জ) তাঁর সঙ্গে আলাপের ভিত্তিতে জানান, ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারির মতো ২২শে ফেব্রুয়ারিও ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে অমর একটি দিন। এ দিনেই হোস্টেলের পার্শ্বে ঢাকা মেডিকেলের প্রাঙ্গণে প্রথম শহীদ মিনার নির্মাণের প্রাথমিক কাজটি সম্পন্ন হয়। সে দিন নির্মিত ‘শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ’টিই পরবর্তীকালের শহীদ মিনার।
আজকে যে শহীদ মিনার, সেটা শুরুতে নির্মিত হয়েছিল মাত্র এক রাত্রের মধ্যে। সেই স্মৃতিস্তম্ভ তৈরি হতে শুরু করে নির্মাণ পর্যন্ত সবটুকু কৃতিত্ব যারা সে সময়ের ঢাকা মেডিকেলের ছাত্র, তাদের। তাদের মধ্যে ছিলেন মাতৃভাষা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়ে বিভিন্ন কর্মসূচির সঙ্গে সঙ্গে শহীদদের স্মরণে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের ছাত্রদের নির্মিত প্রথম ইটের শহীদ মিনার তৈরিতে অংশ নেয়া ঢাকা মেডিকেল কলেজের আদিপর্বের ছাত্র ডা. এ.এ. মাজহারুল হক।
ডা. এ.এ. মাজহারুল হক মাতৃভূমির প্রায় প্রতিটি বিজয়-সংগ্রামেই, বিশেষ করে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন, ভাষা আন্দোলন এবং একাত্তরের মহান মুক্তিসংগ্রামে প্রত্যক্ষভাবে সক্রিয় অবদান রাখেন। ১৯৪৬-৪৭ সালে ছাত্রাবস্থায় ব্রিটিশ হটাও আন্দোলনে প্রবলভাবে যুক্ত থেকে তিনি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা প্রতিরোধে কাজ করেন। ভাষা আন্দোলনে সংক্ষিপ্ত কারাবাসসহ সরাসরি অংশগ্রহণ করেন। ১৯৭১ সালে তিনিই প্রথম মুক্তিকামী কিশোরগঞ্জবাসীকে স্বাধীনতার ঘোষণা অবহিত ও প্রচার করেন এবং তাঁর নেতৃত্বে নিজ বাসভবনেই আত্মসমর্পণের অনুষ্ঠান সম্পন্ন করেন রক্তপাতহীনভাবে কিশোরগঞ্জের পতন ঘটিয়ে সেখানে সর্বপ্রথম স্বাধীনতার পতাকা উড্ডীন করেন।
দীর্ঘ ৭০ বছর তিনি কিশোরগঞ্জে নিরবিচ্ছিন্নভাবে চিকিৎসা-সমাজসেবা-রাজনীতির মহানব্রত পালনের মাধ্যমে মানুষের কল্যাণে নিরন্তর ভূমিকা রেখে ২০২৩ সালের ২১শে সেপ্টেম্বর তিনি পরলোকগমন করেন। কিশোরগঞ্জের সমাজ ও মানুষের কাছে তিনি কিংবদন্তীতুল্য চিকিৎসক ও ভাষাসৈনিকের মর্যাদায় আসীন।
ভাষা আন্দোলনে ডা. মাজহারুল হকের ব্যক্তিগত সংযোগ স্মৃতির ঘটনাটি ২০০৭ সালে জাতীয় প্রেস ক্লাব প্রকাশিত ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’ সংকলনে আলী হাবিব বিস্তারিত লিখেছেন: ‘‘ঢাকা মেডিকেলের ছাত্ররা এক রাতের মধ্যে এ প্রশংসনীয় কাজটি করেছিলেন।” ডা. মাজহারুল হকসহ মেডিকেলের শিক্ষার্থীদের সরাসরি ও প্রত্যক্ষ অংশ গ্রহণের সেসব কথা শহীদ মিনার নির্মাণের কাজে জড়িত অপর এক ছাত্র সাঈদ হায়দার তাঁর স্মৃতিকথায় লিখেছেন: “মেডিকেল কলেজের ছাত্ররা শহীদ মিনার তৈরির সিদ্ধান্ত নেয়। এটাকে স্বতঃস্ফূর্ত একটা পরিকল্পনা বলা চলে। বিকেল থেকে কাজ শুরু হয়। শেষ হয় ভোরে।”
জীবদ্দশায় ডা. মাজহারুল হক সাংবাদিক আশরাফুল ইসলামকে জানান: “আমরা এক প্রকার গেরিলার মত গোপনে নির্মাণ কাজ চালিয়ে ছিলাম। ইট, বালি, সিমেন্ট সংগ্রহ করেছিলাম। ঘোষণা দিয়ে ঘটা করে তা নির্মাণ করা হয় নি কৌশলগত কারণে। পূর্বাহ্নে জানতে পারলে পাকিস্তানপন্থীরা সেটা গড়তেই দিত না। আমরা নির্মাণ-সংক্রান্ত যোগার-যন্ত্র ও অন্যান্য আয়োজন নির্ধারণ করে পালাক্রমে স্বেচ্ছাশ্রমে কাজ চালিয়ে গভীর রোমাঞ্চ ও উত্তেজনায় দেখতে পেলাম যে, আমাদের কাঁচা হাতে শহীদদের রক্তদানের পবিত্র স্থানে মাথা উঁচু করা স্মৃতিস্তম্ভ দাঁড়িছে আছে। সেই দিনের উত্তেজনা আজও মনে আছে। শহীদ শফিউরের পিতাকে সঙ্গে নিয়ে আমাদের নির্মিত প্রথম শহীদ মিনার উদ্বোধন করেন দৈনিক আজাদ সম্পাদক আবুল কালাম শামসুদ্দীন সাহেব। পরপরই আমরা ফুল ও শ্রদ্ধার মালায় শহীদ মিনার ভরে তুললাম। সারা দিনই বিপুল ছাত্র-জনতা এভাবে শ্রদ্ধা নিবেদন করল। সেদিনই শেষ বিকালের দিকে সরকারের পক্ষ হতে শহীদ মিনারের উপর আক্রমণ চালানো হল। তছনছ করে দেওয়া হল স্মৃতি ও শ্রদ্ধার মিনার। পুলিশ অকস্মাৎ হামলা চালিয়ে আদি শহীদ মিনারটি সম্পূর্ণরূপে গুড়িয়ে নিশ্চিহ্ন করে দিল এবং আমাদের মেডিকেল হোস্টেলে আক্রমণ করল। জীবনে প্রথমবারের মত পুলিশী নির্যাতনের শিকার হলাম। আহত অবস্থায় আমাদেরকে থানায় নিয়ে গিয়ে শাসিয়ে দেওয়া হল। বিপুল সংখ্যক ছাত্রকে আটক করে রাখার মত স্থান হয়তো থানা-পুলিশের ছিল না। গণগ্রেফতার করে আন্দোলনকে আরও বেগবান করার পথে তারা অগ্রসর হল না। কয়েক ঘণ্টার আটকাবস্থা, জেরা ও খবরদারীর পর আমাদেরকে ছেড়ে দেওয়া হল। হলে ফিরে এসে দেখলাম উদ্বিগ্ন বন্ধু-বান্ধব অপেক্ষমাণ। আমাদেরকে অতি দ্রুত প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়া হল।”
ডা. মাজহারুল হক জানান, ঢাকা মেডিকেলে অধ্যয়নের সময় ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের মত জাতীয় রাজনীতির ঐতিহাসিক ঘটনাবলীর সরাসরি সম্মুখীন হন তিনি এবং ব্যক্তিগতভাবে নিজে ও তাঁর সহপাঠীগণ তাতে অংশ গ্রহণ করেন। তিনি ব্যারাক নামে পরিচিত মেডিকেল হোস্টেলে তখন থাকতেন। ইত্যবসরে রাজনীতিতে নানারূপ পরিবর্তন সাধিত হল। ভাষার জন্য লড়াইয়ের ক্ষেত্রও তৈরি হয়ে গেল।
ডা. মাজহারুল হকের ভাষায়, ফেব্রুয়ারির ২০ তারিখের দিকে ছাত্র আন্দোলন সুতীব্র হল। অনেকে গ্রেফতার বরণ করলেন। সরকার এক মাসের জন্য ১৪৪ ধারা বহাল করল। সভা-সমাবেশ-হরতাল নিষিদ্ধ করা হল। কিন্তু সবাই তখন সংগ্রামমুখর। বাংলার ছাত্র সমাজ তখন অকুতোভয়। কে তাদেরকে রুখবে! এমন সাধ্য কার!! রাত্রি বেলাতেই সিদ্ধান্ত জানা গেল যে, ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করা হবে। সমাবেশ হবে। মিছিল হবে। প্রতিবাদ-প্রতিরোধ চলবেই।
রাত্রি শেষে এলো ২১ ফেব্রুয়ারি। সেদিন সকাল হতেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও পার্শ্ববর্তী এলাকার পরিস্থিতি আপাত দৃষ্টিতে শান্তই ছিল। ২১ ফেব্রুয়ারি ছাত্ররা ৫জন ৫জন করে ১৪৪ ধারার ভেতরেও মেডিকেল হোস্টেল, যা ব্যারাক নামে পরিচিত ছিল, তার সম্মুখে সমবেত হতে লাগল। আজিমপুর ও সলিমুল্লাহ হলের দিক হতেও লোকজন আসতে লাগল। মধুর ক্যান্টিনের দিকেও ছাত্ররা সংগঠিত হল। অবিরাম ছাত্রস্রোত রুদ্ধ করতে প্রথমে পুলিশের পক্ষ হতে শুরু হয় লাঠিচার্জ। এর পর শুরু হল টিয়ার গ্যাস নিক্ষেপ। কিন্তু কোনওভাবেই বিক্ষোভ দমন করা সম্ভব হল না। বেলা যতই বাড়তে লাগল, ততই বিক্ষোভ তীব্রতর হতে লাগল; প্রতিবাদ-বিক্ষোভে জনসমাগমও হু হু করে বৃদ্ধি পেল। বিশ্ববিদ্যালয় মাঠ, মেডিকেল কলেজ গেইট প্রভৃতি এলাকায় ছাত্র-জনতার বিক্ষোভ সমাবেশ পুঞ্জিভুত হতে লাগল। ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সাথে সংহতি জানাতে হাসপাতালের ওয়ার্ড বয় হতে শুরু করে হল বয় পর্যন্ত এসে মিছিলে একাত্ম হল। এরই মধ্যে পুলিশের সঙ্গে তাঁদের সংঘর্ষ আরম্ভ হল।
এমন অবস্থায় বেলা তিন ঘটিকার দিকে রাজপথে দাঁড়িয়েই ডা. মাজহারুল হক অতি নিকটেই পুলিশের বন্দুক হতে হঠাৎ গুলি বর্ষণের আওয়াজ শুনতে পান। প্রচণ্ড উত্তেজনা ও হৈ চৈ-এর মধ্যে আন্দোলনরত ছাত্রদেরকে সঙ্গে নিয়ে তিনি সন্নিকটে অবস্থিত মেডিকেল হোস্টেলে এসে আশ্রয় গ্রহণ করেন। বহুজন আহত হল। আহত ও নিহতদের ইমার্জেন্সিতে নেওয়া হল। তিনিসহ মেডিকেলের ছাত্ররা ইমার্জেন্সিতে ছুটে গিয়ে বহু আহতকে কাতরাতে দেখলেন। স্বাধীন দেশে পুলিশের নির্মম অত্যাচারের চিত্র যে এত ভয়াবহ হতে পারে, তা দেখে সবাই বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। হাসপাতালে গুলিবিদ্ধ আবুল বরকতকে দেখতে পেলেন তিনি। বরকতের তলপেটে গুলি লেগেছিল। মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ে ভাষা আন্দোলনের প্রথম শহীদ হিসাবে তিনি সকলের চোখের সামনে দিয়ে পরপারের পথে চির বিদায় নিলেন। শহীদ আবুল বরকতের পর গুলিবিদ্ধ হন রফিকুদ্দিন। তিনি ছিলেন মানিকগঞ্জের দেবেন্দ্র কলেজের ছাত্র। তাঁর পিতা ছিলেন বাদামতলীর কমার্শিয়াল আর্ট প্রেসের মালিক। ২১ ফেব্রুয়ারির আরেক শহীদ আবদুল জব্বার। তাঁর বাড়ি ময়মনসিংহে। বৃহত্তর ময়মনসিংহের কিশোরগঞ্জের কুলিয়ারচরে লক্ষ্মীপুরে ডা. মাজহারুল হকের গ্রামের বাড়ির সম্মুখ দিয়ে প্রবাহিত পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদের পশ্চিম পার্শ্বে গফরগাঁও থানার পাঁচুয়া গ্রামের এই ভাষা-শহীদ ঢাকা মেডিকেল কলেজের হাসপাতালে এক আত্মীয়-রোগী ভর্তি করতে এসেছিলেন। তিনি মেডিকেল কলেজ হোস্টেলেই নিজ এলাকার একজন ছাত্রের কক্ষে এসে উঠেছিলেন। গত কয়েকদিন যাবত তাঁকে কলেজ ক্যান্টিন ও হাসপাতালে দেখেছিলেন ডা. মাজহারুল হক। অদৃষ্টের ইঙ্গিতে তিনিও শহীদের তালিকায় নাম লিখালেন। তিনি চোখের সামনে রক্ত, মৃত্যু আর আহতদের আহাজারি দেখে ক্ষণকালের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেলেন বটে। কিন্তু সেই সুতীব্র আঘাত ও আক্রমণ তাঁদের মধ্যকার একটি ঘুমন্ত-ক্ষত-বিক্ষত বাঘকে জাগিয়ে দিল। বন্ধু-সহপাঠীদের মধ্যেও তিনি লক্ষ্য করলেন অভিন্ন ক্ষোভের লেলিহান অগ্নিশিখা প্রজ্বলিত হয়েছে।
ভাষা আন্দোলনের স্মৃতি তিনি জীবনভর লালন করেছেন। বাঙালি জাতির অধিকার ও সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছেন। একুশের চেতনাকে ছড়িয়ে দিয়েছেন পরবর্তী প্রজন্মে। এভাবেই একুশের সঙ্গে নির্মিত হয়েছে আমার নিবিড় আত্মিক সম্পর্ক। ভাষা, সংস্কৃতি, সমাজ ও শিক্ষা বিস্তারে তাঁর আদর্শে কিশোরগঞ্জে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে মাজহারুন-নূর ফাউন্ডেশন। আঞ্চলিক ইতিহাস, ঐতিহ্য, শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি নিয়ে কাজ করছে এই সংস্থা ভাষাসৈনিক ডা. এ. এ. মাজহারুল হকের স্মৃতিময় প্রেরণায়।
ড. মাহফুজ পারভেজ, ভাষাসৈনিকের জেষ্ঠ্যপুত্র। লেখক, শিক্ষাবিদ, গবেষক।