চব্বিশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর থেকেই আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া তরুণরা নতুন একটি দল গঠন করবেন-এই গুঞ্জন ছিল। অবশেষে গত শুক্রবার জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) নামে আত্মপ্রকাশ করেছে তরুণদের নতুন দল। তবে আত্মপ্রকাশের দিনেই দলটির শীর্ষ নেতাদের ‘দ্বিতীয় রিপাবলিক’ প্রতিষ্ঠার ঘোষণা নিয়ে রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে জোরাল প্রতিক্রিয়া এসেছে।
রোববার পত্রিকান্তরে প্রকাশিত প্রতিবেদনে ‘দ্বিতীয় রিপাবলিক’ নিয়ে মতদ্বৈধতা প্রকাশিত হয়েছে। নতুন দল এনসিপি’কে স্বাগত জানালেও তাদের রাজনৈতিক দর্শন ও মতাদর্শ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের।
তাঁরা বলছেন, রাজনীতিতে বহু মত ও পথের চর্চায় নতুন একটি দলের যুক্ত হওয়া অবশ্যই আনন্দের বিষয়। কিন্তু নতুন দলটির উত্থাপিত ‘সেকেন্ড রিপাবলিক’ এবং গণপরিষদ নির্বাচনসহ প্রশ্ন উঠেছে আরও নানা বিষয়ে। তাঁদের কর্মকাণ্ডে অভিজ্ঞতা ও প্রজ্ঞার অভাবও স্পষ্ট। আত্মপ্রকাশের পর থেকেই নানাবিধ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে দলটির হোঁচট খাওয়ার সম্ভাবনাও দেখছেন অনেকে।
শনিবার রাজধানীতে এক সভায় বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘আমি নতুন বন্ধুদের বলতে চাই, আমাদের বর্তমান রিপাবলিক কি অসুস্থ হয়ে গেছে?’ গণপরিষদ নির্বাচন ও সেকেন্ড রিপাবলিকের বিষয় সামনে নিয়ে আসার পেছনে রাষ্ট্রব্যবস্থাকে আরও দীর্ঘায়িত ও অগণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মধ্যে নিয়ে যাওয়ার ষড়যন্ত্র থাকতে পারে বলেও শঙ্কা বিএনপির এই নেতার।
নতুন দলের আত্মপ্রকাশ অনুষ্ঠানে বিএনপির প্রতিনিধি হিসেবে উপস্থিত থাকা দলটির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী শনিবার এক অনুষ্ঠানে রিজভী বলেন, ‘এনসিপির আত্মপ্রকাশ অনুষ্ঠানে সবাই ভালো ভালো কথা বলেছেন। কিন্তু রাষ্ট্র সম্পর্কে কোনো পলিটিক্যাল ফিলোসফি (রাজনৈতিক দর্শন) পাইনি।’
নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না নতুন দলের আত্মপ্রকাশ নিয়ে তাঁর পর্যবেক্ষণ তুলে ধরে গণমাধ্যমকে বলেছেন, নতুন করে কোনো কিছু গড়ে তোলা কষ্টসাধ্য। এটা করতে যে রকম অভিজ্ঞতা ও ধৈর্য দরকার; দলটি যাঁরা করেছেন, তাঁদের মধ্যে এটার কমতি লক্ষ করা গেছে।
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের যে ঘোষণাপত্র বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটি প্রকাশ করতে চেয়েছিল মূলতঃ সেটিই জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) লক্ষ্য বলে মনে করছেন অনেকে। শুক্রবার এনসিপির আত্মপ্রকাশ অনুষ্ঠানে দলটির আহবায়ক মো. নাহিদ ইসলাম বলেছেন, ‘আমাদের লক্ষ্য দেশে ‘সেকেন্ড রিপাবলিক’ প্রতিষ্ঠা করা।’
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের খসড়া ঘোষণাপত্রেও বলা হয়েছিল, ‘আমরা এই ঘোষণা প্রদান করলাম যে ১৯৭২ এবং ১/১১ কালের রাজনৈতিক বন্দোবস্তের পরিবর্তন ঘটানোর জন্য আমাদের একটি নতুন জনতন্ত্র (রিপাবলিক) প্রয়োজন, যা রাষ্ট্রে সকল ধরনের নিপীড়ন, শোষণ ও বৈষম্যের অবসান ঘটাবে এবং এ দেশের তরুণসমাজের প্রত্যাশাকে ধারণ করতে পারবে। আমরা এই অভিপ্রায় ব্যক্ত করিলাম যে এই ঘোষণাপত্রকে উপযুক্ত রাষ্ট্রীয় ও সাংবিধানিক স্বীকৃতি প্রদান করা হবে।
ফলে অনেকের প্রশ্ন, এনসিপি কিভাবে তাদের ‘সেকেন্ড রিপাবলিক’ প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্য পূরণ করবে? এ ছাড়া ‘সেকেন্ড রিপাবলিক’ বিষয়টি জনপরিসরে এখনো স্পষ্ট নয়। এ বিষয়ে নানা প্রশ্নের জবাব খুঁজছে অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলো।
বিএনপির নেতা সালাহ উদ্দিন আহমদ শনিবার আরও বলেন, ‘সেকেন্ড রিপাবলিক কখন হয়? রিপাবলিক হচ্ছে, যেখানে নির্বাচিত প্রতিনিধিরা রাষ্ট্র পরিচালনা করবেন, তাঁদের একটা নমিন্যাল অথবা ইলেকটেড হেড দ্য স্টেট থাকবে। সেটা কি আমাদের নেই? গণপরিষদ কেন হবে? এর মধ্যে তো আরও একটি উদ্দেশ্য আছে।’
বিএনপির স্থায়ী কমিটির এই সদস্য বলেন, ‘যে সময়ে দেশে কোনো সংবিধান রচিত থাকে না, মানে একটা নতুন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা, তখন গণপরিষদের প্রয়োজন হয়। গণপরিষদের সদস্যরা সংবিধান প্রণয়ন করেন, যে সংবিধানের ভিত্তিতে পরে সংসদ নির্বাচন হয়। তিনি বলেন, ‘আমাদের এখানে গণপরিষদ নির্বাচনের জন্য আমরা কী নতুনভাবে একটা স্বাধীন রাষ্ট্র পেয়েছি? রাষ্ট্র তো স্বাধীন আছে। আমরা একটি স্বাধীন-সার্বভৌম গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র।’
জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) লক্ষ্য ‘সেকেন্ড রিপাবলিক’ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে তিন ধাপের (স্বল্প, মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদি) কর্মসূচি ঠিক করছে বলে জানিয়েছে দলটি। দলটির নেতারা বলছেন, এনসিপির টার্গেট ‘সেকেন্ড রিপাবলিক’ প্রতিষ্ঠা। এতে একাত্তরের সঙ্গে চব্বিশের অঙ্গীকার যুক্ত থাকবে। ’৭২-এর ‘প্রথম রিপাবলিক’ মুক্তিযুদ্ধের আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নের জন্য বলা হলেও ব্যর্থ হয়েছে, তার বিপরীতে চব্বিশের ‘সেকেন্ড রিপাবলিক’-এ স্বাধীনতা ও গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার কথা থাকছে। এতে একাত্তরের প্রকৃত চেতনা এবং চব্বিশের স্পিরিট সম্পৃক্ত হবে। সেক্ষেত্রে গণপরিষদ নির্বাচন দিয়ে গণতান্ত্রিক সংবিধান প্রণয়ন করে নতুন বাংলাদেশ গড়ার প্রসঙ্গ রয়েছে।
স্বল্প, মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদি কর্মসূচি বলতে দলটি কি বোঝাচ্ছে তাও স্পষ্ট করেছেন দলের নেতারা। তারা বলছেন, স্বল্পটা হবে নির্বাচনকেন্দ্রিক, মধ্যমটা নির্বাচনের পর সরকারে বা বিরোধী দলে গেলে বাস্তবায়নকেন্দ্রিক এবং দীর্ঘটা দলের আগামীর কর্মসূচি নিয়ে। এসব কর্মসূচিতে ঘোষণাপত্রের প্রতিফলন থাকবে।
সূত্র জানায়, দল গোছানোর পাশাপাশি ধারাবাহিকভাবে চলবে রাজনৈতিক ও সামাজিক কর্মকৌশল প্রণয়নের কাজ। বিশেষ করে জুলাই ঘোষণাপত্র দেওয়ার জোর উদ্যোগ নেওয়া হবে। ’৭২-এর সংবিধান বাতিল করে গণভোটের মাধ্যমে নতুন সংবিধান করা এবং রাষ্ট্র সংস্কারের গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাবগুলো নিয়ে ধাপে ধাপে এগোবে এনসিপি।
গণতন্ত্র মঞ্চের নেতা ও বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক গণমাধ্যমকে বলেছেন, ‘যেটুকু দেখেছি, তাদের (এনসিপি) আদর্শের জায়গাটা কী হবে, তা এখনো স্পষ্ট করা হয়নি। যে বাতাবরণে দলটি তৈরি করা হচ্ছে, তাতে হোঁচট খাওয়ার আশঙ্কা আছে। কারণ তাঁদের লোকজন এখনো সরকারে আছে এবং রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা তাঁদের পেছনে আছে। সেখান থেকে সরে এসে জনগণের আস্থা অর্জন করতে না পারলে কতটা কী করতে পারবে, সে প্রশ্ন থেকেই যায়।’
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেছেন, ‘মূল বিষয়টা হচ্ছে, তারা কী করতে চায়। সেকেন্ড রিপাবলিক নিয়ে তারা কথা বলছে, যা বোধগম্য নয়। কিন্তু এখন পর্যন্ত দেশ ও দেশের মানুষের স্বার্থে কিছু করার দৃষ্টিভঙ্গি দেখছি না।’