একটি সরল নির্বাচনী বিশ্লেষণ
-
-
|

ফরিদুল আলম, ছবি: বার্তা২৪.কম
বলা যায় বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে ব্যতিক্রমী একটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে রোববার। একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অথচ সরকারি দল মনোনীত প্রার্থীদের একচেটিয়া প্রচারের মধ্য দিয়ে শেষ হয়েছে নির্বাচনের আনুষ্ঠানিক প্রচার প্রচারণা।। এই প্রচারণা চলাকালীন সময়ে যে বিষয়টি সবচেয়ে বেশি সকলের দৃষ্টি কেড়েছে তা হচ্ছে মাঠের প্রচারে ব্যস্ত সময় ব্যয়ের চাইতে প্রধান বিরোধী পক্ষ ঐক্যফ্রন্টের নেতৃবর্গকে দফায় দফায় নির্বাচন কমিশনে গিয়ে নানা ধরণের অভিযোগ করতে, যার অনেকগুলোই ভিত্তিহীন বলে প্রমাণের পর সর্বশেষ ঐক্যফ্রন্টের শীর্ষ নেতা ড. কামাল হোসেনের সাথে প্রধান নির্বাচন কমিশনারের (সিইসি) অনভিপ্রেত বাদানুবাদ ঘটে।
নির্বাচনের কাজে প্রসাসনের নানা স্তরের কর্মকর্তা এবং পুলিশ বাহিনীর বিরুদ্ধে ড. কামাল হোসেনের অনাকাঙ্ক্ষিত শব্দচয়ন কেবল নির্বাচন কমিশন নয়, সকলকেই বিস্মিত করেছে। ড. কামাল হোসেনের মত ব্যক্তি যখন তার জীবনের এই পর্যায়ে এসে এমন হতাশাজনক মন্তব্য করেন তখন সরকারি দলের বিকল্প শক্তি হিসেবে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বের প্রতি মানুষের আস্থা আনতে কিছুটা ভাবনায় পড়তে হবে বৈকি।
ইতোমধ্যে মাঠে ময়দানের সর্বত্র একটি কথা ছড়িয়ে পড়েছে যে বিরোধী পক্ষের প্রার্থীদের নির্বাচনের মাঠে নামলেই হামলার শিকার হতে হচ্ছে, যা সাধারণ মানুষের মধ্যে কিছুটা বিভ্রান্তির সৃষ্টি করলেও বাস্তবিক অর্থে অপপ্রচার ভিন্ন কিছু নয়। আমি নিজে ব্যক্তিগতভাবে এই নির্বাচনী প্রচারের সময় ঢাকা, চট্টগ্রাম এবং ময়মনসিংহের বিভিন্ন স্থানে ঘুরে বেড়ালেও কোথাও এমনটা প্রত্যক্ষ করিনি যে সরকারি দল মনোনীত প্রার্থীদের বিরোধী পক্ষ বিশেষতঃ ঐক্যফ্রন্ট মনোনীত প্রার্থীরা তাদের প্রচারে কোনো বাঁধার সম্মুখিন হয়েছেন। আমি বরং এই নির্বাচনকে ঘিরে তাদের প্রচারকার্যের নজিরবিহীন নীরবতা দেখে বিস্মিত এবং একই সাথে হতাশ হয়েছি।
একটি জাতীয় নির্বাচনকে ঘিরে আমরা সবসময় যে উৎসবের আবহ দেখে অভ্যস্ত ছিলাম, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি বিএনপিসহ বেশ কিছু দলের নির্বাচন বর্জনের ফলে সেটি থেকে আমরা বঞ্চিত হয়েছিলাম। এবার যখন সকল দলের অংশগ্রহণ ঘটল, স্বাভাবিকভাবেই আমরা সেই উৎসবের আমেজটি আবার ফিরে পাব বলে প্রত্যাশা করেছিলাম। আমিই জানি না সত্যিকার অর্থে কোন কারণে ঐক্যফ্রন্টের প্রার্থীরা এমন অসহায়ভাবে আত্মসমর্পণ করল। তবে কিছুটা অনুমান করতে পেরেছি যে, নির্বাচনের সম্ভাব্য যে ফলাফলটা বর্তমানে আমাদের সকলের দৃষ্টির খুব কাছে সেটিকে নেতিবাচকভাবে উপস্থাপনের একটা প্রক্রিয়া খুব নীরবে চলছে। আর এর সাথে যুক্ত হয়েছে দেশি-বিদেশী কিছু সংবাদমাধ্যম এবং গবেষণা সংস্থা।
গত ২৭ ডিসেম্বর লন্ডন থেকে প্রকাশিত দ্য গার্ডিয়ানের বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে করা এক প্রতিবেদনের শুরুতে বর্তমান সরকারের কিছু সাফল্যের বর্ণনা করা হলেও এই প্রতিবেদনে মূলতঃ বিরোধী নেতাকর্মীদের দমন এবং ব্যাপক মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে সরকারকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। এদিকে দেশের দুটি গবেষা সংস্থা বাংলাদেশ এন্টারপ্রাইজ ইন্সটিউট এবং অধিকার বর্তমান সরকারের অর্থনৈতিক উন্নয়নে ধনী-দরিদ্র্যের মধ্যে প্রকট বৈষম্য এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়কে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছে, যা গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনের সাথে অনেকটা সামঞ্জ্যস্যপূর্ণ।
এই দু’টি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে বিশেষ কিছু না বলে শুধু এটাই বলব যে এদের পরিচালনার সাথে যারা সম্পর্কিত তাদের রাজনৈতিক মতাদর্শ ঘেটে দেখলেই বিষয়টি সকলের কাছে পরিষ্কার হয়ে যাবে। এদিকে নির্বাচনের ৪৮ ঘণ্টা আগ থেকে সকল ধরণের প্রচার-প্রচারণা বন্ধের বিষয়ে নির্দেশনা থাকলেও হঠাৎ করে নীরব থাকা বিরোধী প্রার্থীদের বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সরকারের চরিত্রহননের মাধ্যমে নিজেদের পক্ষ্যে প্রচার চালানোর যে অভিনব কৌশল দেখা যাচ্ছে এ ধরণের বিষয়গুলো পর্যবেক্ষণে এমনটা ধারনা করার সঙ্গত কারণ রয়েছে যে হয় ভোটারদের মধ্যে একধরণের ভীতি সৃষ্টি অথবা নানা ধরণের অপপ্রচারের মাধ্যমে নির্বাচনের পরিবেশকে নস্যাৎ করার সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা চলছে।
আমি ভেবে অবাক হচ্ছি যে, ২০১৪ সালে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন না করার যে খেসারত বিএনপিসহ কিছু রাজনৈতিক দলকে দিতে হয়েছিল, এবারের নির্বাচনে অংশগ্রহণের মাধ্যমে সেটা কিছুটা পুষিয়ে নেবার ইচ্ছা এবং সে ধরণের পর্যাপ্ত সুযোগ থাকলেও নির্বাচনী প্রক্রিয়ার শুরু থেকেই তারা এই নির্বাচনকে ঘিরে যেভাবে প্রতিনিয়ত তাদের নানা প্রকার নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় দিচ্ছে সে জায়গা থেকে দেখলে তারা সত্যিকার অর্থে নির্বাচনে অংশগ্রহণের ইচ্ছায় এতে সামিল হয়েছে বলে মনে হয়না। এখানে সন্দেহের যথেষ্ট কারণ রয়েছে যে তারা এই নির্বাচনে অংশ নিতে চাইছে একটাই উদ্দেশ্যে যে এর মাধ্যমে সরকারকে কীভাবে বিপদে ফেলা যায়।
সম্প্রতি ফাঁস হওয়া বিএনপির কিছু নেতার টেলিসংলাপ পর্যালোচনা করলে সেটা পরিষ্কারভাবে ফুটে উঠে। গতকাল ফাঁস হওয়া ব্যারিস্টার মওদুদ এবং বরকত উল্লাহ বুলুর মধ্যে টেলিসংলাপ থেকে যে বিষয়টি উঠে এসেছে তা হচ্ছে নির্বাচন নিয়ে দলটির মহাসচিব এবং ঐক্যফ্রন্ট নেতা ড. কামাল হোসেনের কী পরিকল্পনা রয়েছে সে বিষয়ে তারা সন্দিহান অথচ তারা দাবী করছেন যে এই নির্বাচনে অংশ নেওয়া তাদের আন্দোলন কর্মসূচির অংশ হিসেবে দলীয় ফোরামের সিদ্ধান্ত ছিল। আবার এই সংলাপের একটি অংশে এমনটাও ধারণা পাওয়া যায় যে ব্যারিস্টার মওদুদের সঙ্গে লন্ডনে আত্মগোপনে থাকা তারেক রহমানের যে আলাপ হয় সেখানে তারেক রহমান এই নির্বাচনে বিএনপির অংশ নেওয়ার পক্ষে ছিলেন না।
আবার বিএনপির মধ্যে এই নির্বাচনে অংশ নেওয়া এবং না নেওয়ার বিষয়ে দু’টি মত ছিল বলে ধারণা পাওয়া যায় এমন আলাপ থেকে। এখানে স্বাভাবিকভাবেই একটি অংশ চাইছিল বেগম জিয়া এবং তারেক রহমানের নিয়ন্ত্রণ থেকে দলটিকে একটি গণতান্ত্রিক ধারায় বের করে আনা, যে লক্ষে ড. কামাল হোসেনকে সামনে নিয়ে আসা হয়েছে। আবার অপর অংশটি দলীয় বর্তমান নেতৃত্বের প্রতিই আস্থা রাখতে চাইছে। আর এই দুইয়ের সমন্বয়ের অভাব প্রকট পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে, যা টেলিসংলাপ থেকে ধারণা করা যায়।
কিছুদিন আগে বিএনপির অপর সিনিয়র নেতা ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেনের সাথে পাকিস্তানের আইএসআই এর একজন শীর্ষ নেতার মধ্যে কথোপকথনে ড. মোশাররফকে আইএসআই এর উদ্দেশ্যে অনুরোধের সুরে বলতে শোনা যায়, ‘আমরা খুব ঝামেলায় আছি, কিছু একটা করুন।’ এক পর্যায়ে বর্তমান সরকারকে চীনের মাধ্যমে চাপ প্রয়োগ করতে অনুরোধ করতে শোনা যায়।
এদিকে ঐক্যফ্রন্ট শীর্ষ নেতা ড. কামাল সংবাদ মাধ্যমে দাবী করছেন যে বিএনপি তদের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেছে এবং জামায়াতে ইসলামের ২২ জন প্রার্থী ঐক্যফ্রন্টের ব্যানারে ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করবেন জানলে তিনি ঐক্যফ্রন্টের সাথে থাকতেন না এবং সরকার গঠনে জামায়াতের প্রতিনিধিদের নেওয়া হলে তিনি ভবিষ্যতের সেই সরকারে থাকবেন না। এর মধ্য দিয়ে তিনি জাতির কাছে কি বার্তা দিতে চেয়েছেন তা স্পষ্ট না হলেও মনে করা যায় যে তিনি হয়ত ভাবছেন তার এই মন্তব্যে ভোটাররা সরল মনে ঐক্যফ্রন্ট মনোনীত প্রার্থীদের পক্ষে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করবেন।
আসলে ঐক্যফ্রন্ট কি চাইছে তা হয়ত তারা নিজেরাও জানেন না। নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ক্ষেত্রে এক পা এগিয়ে আবার দুই পা পিছিয়ে পড়ার মধ্য দিয়ে তারা যাই হাসিল করতে চাননা কেন এর মধ্য গভীর ষড়যন্ত্রের গন্ধ রয়েছে। তবে তাদের দুর্ভাগ্য যে তাদের সমস্ত কৃতকর্ম সহসাই ফাঁস হয়ে যাওয়ায় তারা আসলে ভীষণ বেকায়দায় রয়েছে।
এমন পরিস্থিতিতে সরকারকে পা ফেলতে হবে গভীর সতর্কতার সঙ্গে। আমরা ইতোমধ্যে খেয়াল করেছি যে, নির্বাচনের মাঠে বিএনপির আত্মঘাতী সিদ্ধান্তগুলোকে পুঁজি করে কিছু সরকারী সংস্থার সরকারের প্রতি অতি মনোযোগী হয়ে নির্বাচনের ফলাফল অর্জনের ক্ষেত্রে তাদের অবদানকে বড় করে দেখানোর প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে, যার কোনো প্রয়োজন নেই। এধরণের অযাচিত কর্মকাণ্ডের প্রশ্রয়দান একটি স্বচ্ছ ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত সরকারকে বিতর্কিত করে তুলতে পারে। একই সঙ্গে নির্বাচন কমিশন এবং সরকারের কাছে অনুরোধ থাকবে নির্বাচনী কর্মকাণ্ডে নিয়োজিত সকলের কাছে কেবল এই বার্তাই পৌঁছে যাক যে একটি সুষ্ঠু এবং গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য তাদের যা করণীয় তারা যেন কেবল সেটার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেন।
ফরিদুল আলম: সহযোগী অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।