নারী-পুরুষ বৈষম্য করে না পর্বত

  • জাকারিয়া মন্ডল, শ্রীলঙ্কা থেকে ফিরে
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

পুরুষ-নারী বৈষম্য করে না পর্বত। ছবি: বার্তা২৪.কম

পুরুষ-নারী বৈষম্য করে না পর্বত। ছবি: বার্তা২৪.কম

নারী-পুরুষ বৈষম্য করে না পর্বত। হয় তাকে জয় করো, নয় তো পরাজিত থাকো। —এ আপ্তবাক্যকে মূলসূত্র ধরেই শ্রীলঙ্কার প্রথম এভারেস্টজয়ী হিসেবে ইতিহাসে নিজের নাম পোক্ত করে নিয়েছেন জয়ন্তি কুরু-উতুমপালা। নারী হিসেবে তো বটেই, প্রথম শ্রীলঙ্কান হিসেবেও এই অনন্য গৌরব অর্জন করে নিয়েছেন তিনি। যে গৌরবে পুরুষরাও তার থেকে পিছিয়ে।

যদিও জয়ন্তি বলেন, ‘প্রথম হওয়া আমার স্বপ্ন ছিলো না। স্বপ্ন ছিলো এভারেস্ট চূড়ায় পা রাখবো।’

বিজ্ঞাপন

সম্প্রতি শ্রীলঙ্কান ট্যুরিজম প্রমোশন বোর্ডের আমন্ত্রণে শ্রীলঙ্কা সফরে যাওয়া বাংলাদেশ ট্রাভেল রাইটার্স এসোসিয়েশন প্রতিনিধিদলের মুখোমুখি হন এই এভারেস্টজয়ী। কলম্বোর ঐতিহ্যবাহী শিল্প, সাহিত্য ও ফ্যাশন কেন্দ্র বেয়ারফুট এর বাগানে বসে মেলে ধরেন মনের ঝাঁপি।

তিনি বলেন, ‘প্রকৃতি কখনও নারী-পুরুষ বৈষম্য করে না।’

বিজ্ঞাপন

বিশ্ব নারী দিবসের প্রাক্কালে জয়ন্তি জানান, কৌতূহলী কৈশোরেই এভারেস্ট জয়ের ইচ্ছা ডানা মেলেছিলো মনের ভেতর। পত্রিকা আর ম্যাগাজিনের পাতায় পর্বতারোণের খবর পড়তেন মনোযোগ দিয়ে। নারিকেল গাছে চড়া উপভোগ করতেন। পাহাড় বাইতে ছুটতেন। সবাই বলতো- চড়ো না। ওতো দস্যিপনা ভালো নয়।

ব্যতিক্রম কেবল বাবা। তিনি উৎসাহ দিতেন। ভাইয়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নারিকেল গাছে নিরাপদে চড়ে নিরাপদে নেমে আসার কৌশল বাবাই শিখিয়েছিলেন সেই শৈশবে।

তারপর অনেকদিন কেটে গেছে। ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতক হয়েছেন। ভারতে এডমুন্ড হিলারির সঙ্গে এভারেস্ট শীর্ষে পা রাখা তেনজিং নোরগে প্রতিষ্ঠিত হিমালয় মাউন্টেনিয়ারিং ইনস্টিটিউটে কোর্স করেছেন। রক ক্লাইম্বিং, আইস ক্লাইম্বিং শিখেছেন। উঁচু পর্বতে ওঠার টেকনিক্যাল জ্ঞান অর্জন করেছেন। উঁচুতে টিকে থাকার কৌশল রপ্ত করেছেন।

জয়ন্তি বলেন, সবসময় ‘এভারেস্ট জয় করতে চাইতাম। কিন্তু কখনও ভাবিনি, সেটা সম্ভব হবে।’ 

এভারেস্ট জয় করতে চাইতাম। কিন্তু কখনও ভাবিনি, সেটা সম্ভব হবে।

তার স্বপ্নের অন্তরায় ছিলো সঙ্গী ও পৃষ্ঠপোষকতার অভাব। এরই ফাঁকে যু্ক্তরাজ্য থেকে জেনডার ডেভেলপমেন্ট বিষয়ে স্নাতকোত্তর শিক্ষা শেষ করেন তিনি। চাকরি নেন একটি নারী অধীকার সংস্থায়। শুরু হয় নিয়মিত অফিসের হ্যাপা। উইক এন্ড এলেই ছুটতেন রক ক্লাইম্বিংয়ে।

২০১২ খ্রিষ্টাব্দে একজন বন্ধু জোটে জয়ন্তির। তাকে নিয়ে জয় করেন শ্রীলংকার আইল্যান্ড পিক, আদম পিক। আরও বছর দুই পর শুরু হয় দেশের বাইরে অ্যাডভেঞ্চার। জয় করেন মাউন্ট কিলিমানজারো। তারপর পিরেনিজ পর্বতমালা।

কিন্তু এভারেস্ট অভিযানের সুযোগ মিলছিলো না। থাকা-খাওয়া, গাইড, অক্সিজেন ট্যাংক, পারমিট ফি-সব মিলিয়ে প্রায় ৬০ হাজার মার্কিন ডলারের ধাক্কা। অবশ্য, অনেক চেষ্টার পর তার ব্যবস্থাও হয়ে গেলো। তারপর মূল চ্যালেঞ্জ। এভারেস্ট অভিযান।

জয়ন্তি মনে করেন, ‘এজন্য রক ক্লাইম্বিংটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। কারণ দড়ির ব্যবহারটা খুব ভালোভাবে শেখা যায়।’

এভারেস্ট অভিযানের কথা স্মরণ করে জয়ন্তি বলেন, ‘আমার টিমে আমি ছিলাম সবচেয়ে ধীরগতির। আমরা খুব সাবধানে এগুচ্ছিলাম। মাইনাস ৩০ ডিগ্রি ঠাণ্ডা, তুষার ঝড়- সব প্রতিবন্ধকতা আমাদের কাছে হার মানছিলো। কিন্তু চূড়ার কিছু আগে আমার অগ্রবর্তীর অক্সিজেন শেষ হয়ে গেলো। আমার কাছে যেটুকু ছিলো সেটুকুও তখন বুঝেশুনে খরচ করতে হবে। কারণ, নামার সময়ও অক্সিজেন প্রয়োজন হবে। ডেথজোনে পৌঁছে আরও সতর্ক হলাম। একটা ভুল হলেই জীবনলীলা সাঙ্গ। কিন্তু শেষ অবধি আমি পারলাম। ২০১৬ খ্রিষ্টাব্দের ২১ জুন ভোর ৫টা ৩ মিনিটে পা রাখলাম এভারেস্টেরা চূড়ায়।’

সুযোগ পেলেই বেড়াতে বাংলাদেশে যাবো।

সেদিনের কথা স্মরণ করে জয়ন্তি বলেন, ‘পর্বতই তোমাকে বেছে নেবে। তুমি পর্বতকে বেছে নিতে পারো না। তাই পর্বতকে পবিত্র জ্ঞান করো। শ্রদ্ধা করো।’

বাংলাদেশের দুই নারী এভারেস্ট আরোহী নিশাত মজুমদার ও ওয়াজফিয়া নাজরিন সম্পর্কে বেশ ভালো ধারণা জয়ন্তির। পার্বত্য চট্টগ্রামের সৌন্দর্যের কথাও বেশ জানা আছে তার। বললেন, ‘সুযোগ পেলেই বেড়াতে বাংলাদেশে যাবো।’

লেখক: প্রধান বার্তা সম্পাদক, দৈনিক আমাদের বার্তা ও নির্বাহী সদস্য, বাংলাদেশ ট্রাভেল রাইটার্স এসোসিয়েশন।