সব হারিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ‘আপোষহীন’ আফগান নারীরা!

  • সুতপা মজুমদার, নিউজরুম এডিটর, বার্তা ২৪.কম
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

সংগৃহীত

সংগৃহীত

চলাফেরা সীমিত, খুব কম বাইরে বের হন, বন্ধুদের সঙ্গে দেখাও একবারে কম তার, এমনকি একই জায়গায় থাকেন না এক থেকে দুই রাতের বেশি! যদি গাড়ির গতিবিধি চেক করে তাকে খুঁজে বের করা হয়; এ কারণে তার ব্যক্তিগত গাড়িটিও বেশিরভাগ সময় থাকে গ্যারেজে।

বলছি, আফগান নারী রাদা আকবর-এর কথা । একাধারে তিনি চিত্রশিল্পী, ফোটোগ্রাফার, নারী অধিকার কর্মী এবং অপ্রতিরোধ্য ।

বিজ্ঞাপন

সম্প্রতি রাদা আকবর তার বর্তমান যাপিত জীবন নিয়ে কথা বলেছেন বার্তা সংস্থা এফপি’র সঙ্গে। সংগ্রামী এই নারী রাদা আকবরের সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন এফপির করেসপন্ডেন্ট অ্যান চাওন।

জীবননাশের হুমকি পাওয়া রাদার এই সাক্ষাৎকারে ফুটে উঠেছে আফগান নারীদের বর্তমান জীবনের দৃশ্যপট। তালেবান শাসিত আফগানিস্থানে নারীদের বর্তমানে দিনগুলো কিভাবে কাটছে, যারা সমস্ত প্রতিকূলতার মধ্য দিয়েও নিজেদেরকে তুলে ধরছেন; তারা কিভাবে মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছেন- এটা জানানোর উদ্দেশ্য ছিল অ্যান চাওনের। এখানে রাদা যেনো আফগান নারীদের মূর্ত প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছেন। যার চরিত্রে শক্তিশালী ব্যক্তিত্ব, জোরালো, আপোষহীনতার উজ্জ্বল নিদর্শন পাওয়া যায়।

বিজ্ঞাপন
রাদা আকবর

সম্প্রতি আফগানিস্তানে তালেবান দখলের পর বদলাতে শুরু করেছে নারীদের জীবনের দৃশ্যপট। নারীদের উপর বিভিন্ন নিষেধাজ্ঞা আরোপ করার সাথে সাথে সমাজের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ জায়গা থেকে সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। শিল্প বা মুক্তমনাদের বিতারিত করা হচ্ছে দেশ থেকে, দেয়া হচ্ছে জীবন নাশের হুমকি। রাদাও এমনই একজন। রাদার সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করলে তিনি ফোন কলটি সিগনাল অ্যাপ এ ট্রান্সফার করতে বলেন। সিগনাল এন্ড-টু-এন্ড এনক্রিপশন দেয়া একটি সুরক্ষিত অ্যাপ যার ফলে ভয়েস রেকর্ডিং বা লোকেশন শনাক্ত করা সম্ভব হয় না। রাদার আগেও বেশ কয়েকজন গুণী ব্যক্তিদের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হয়েছিলো। তাঁদের অধিকাংশ ছিলেন দেশের বাইরে, কিন্তু কেউই ক্যামেরার সামনে আসতে চান নি।

প্রায় ৫ ঘণ্টা আলাপ এবং পরিচিতদের সুপারিশে রাদা সাক্ষাৎকার দিতে রাজি হন। রাদার ভাষ্যমতে, শহরগুলোতে যেখানে বিশেষ করে শিক্ষিত গুণীজন, সমাজ-সেবী, প্রতিবাদী, লেখক ও চিন্তাবিদ তারাই এদের মূল টার্গেট। দেখা যায় যে, সেপ্টেম্বর ২০২০ থেকে ২০২১ এর মধ্যে সাংবাদিক, বিচারক, আইনজীবী, মানবাধিকার কর্মী ও নারী অধিকার কর্মীদের ১৮০ জনকে টার্গেট করে গুলি করে হত্যা বা গাড়িতে বোমা বিস্ফোরণে হত্যা করা হয়েছে। যাদের টার্গেট করা হয় তাদের মধ্যে কেউ কেউ আফগান গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে খবর পান, তারা তখন হয়ত বেঁচে যান আত্মগোপন করে। বেশিরভাগই রাতে ফোন কলে, দরজায় রাখা চিরকুট থেকে বা কখনো কোন অচেনা ব্যক্তির অনুসরণের মাধ্যমে মৃত্যু হুমকি পান বা খুন হন। হুমকি বাস্তব হোক বা কাল্পনিক, প্রত্যেকবার এরকম আলামত পাওয়ার পর সবাই নিজের মতন করে বাঁচার চেষ্টা করেন। কেউ বাড়িতে আত্মগোপন করেন, কেউ জিমে বা বাইরে চলাফেরা বন্ধ করেন, অনেকেই ভয়ে লোকজনের সাথে মেলামেশা বন্ধ করেন।

একজন রেডিও স্টেশনের তরুণ পরিচালকের কথা উল্লেখ করে রাদা বলেন, অফিসের পর বাড়িতে গিয়ে তিনি মৃত্যুভয়ে বাড়ি থেকে পালান, এখন ঘুরছেন রাস্তায় রাস্তায়।

তবে এই হত্যার দায়গুলো কোনভাবেই গ্রহণ করেনি তালেবান কর্তৃপক্ষ। তবে যারা এই মৃত্যু হুমকি পাচ্ছেন তাদেরকে ইসলামপন্থী যোদ্ধারা ক্ষমতা নেওয়ার আগে উচ্ছেদ করছে। আর যারা প্রতিদিন এই হত্যার পরিসংখ্যান বের করছেন তারা কোন জরিপ না করেই প্রকাশ করছে, তাদের তথ্য সঠিক না বলে জানায় তালেবানরা।

আফগান নারীরা

রাদা এবার একটু ইতস্তত হয়েই বলেন, এই মানসিক চাপের জন্য তার নিজস্ব ব্যবসা ছেড়ে প্রতিবেশী দেশে আশ্রয় নিতে হয়েছে। এরপরও ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে তার একটি প্রদর্শনীর কাজ শেষ করতে তাকে ফিরে আসতে হয়। আগের মতোই তিনি তার প্রদর্শনী অনলাইনে রাখেন। কারণ হলো অতিথিদের জন্য বিপদজ্জনক হতে পারে। রাদার সবচেয়ে ভালো বন্ধুদের একজন, ফাতিমা ২০২০ সালের জুনে খুন হন। তিনি স্বাধীন আফগানিস্তানের মানবাধিকার কমিশনে কর্মরত ছিলেন। গাড়ির নিচে বোমা রেখে তাকে তার ড্রাইভারসহ তাকে হত্যা করা হয়। তিনি বন্ধুদের কাছে নাতাশা নামেই পরিচিত ছিলেন এবং খুব ভালো নাচতেন। মাত্র ২৪ বছর বয়সেই তিনি একাধারে ৫টি ভাষায় কথা বলতে পারতেন এবং দুইটি স্নাতকোত্তর ডিগ্রি ছিল। বিদেশে পড়াশুনা শেষে সবে কাবুলে ফিরেছিলেন।

রাদা খুব কম সময়ের জন্য একবার ক্যামেরার সামনে আসেন। ঘরের মেঝেতে বিছানো তোষকে মুখ গুঁজে তিনি মার্কিনদের সাথে তালেবানের চুক্তিকে অবৈধ বলে তাদের ওপর ক্ষোভ প্রকাশ করেন। এ সময় তিনি তার পরিবারের কথাও বলেন। প্রতিবেদক অ্যান চাওন রাদা জীবনযাত্রার ধরন শুনে মর্মাহত হয়ে পড়েন। তিনি বলেন, পুরোটা সময় রাদার অসহায়ত্ব চোখে জল আসার মত ছিল। আমি আমার জীবনে প্রথমবারের মত কর্মক্ষেত্রে কেঁদেছিলাম। চারপাশে রাদার হতাশা বিরাজ করছিলো। যা কিনা আফগান নারীদের প্রতিরূপ। তুরস্ক তাকে ভিসা দিতে অস্বীকার জানিয়েছিল। সেই মুহূর্তে ফ্রান্স ছিলো শেষ আশা। কিন্তু দেশ ছাড়ার যাওয়ার আগে রাদা তার কাজগুলো সংরক্ষণ করতে চেয়েছিল।

সাক্ষাৎকারের শেষে রাদা বলেন, 'আজ আশা ধরে রাখা কঠিন। যে-কোন সময় শেষ হতে পারি এবং এটি শুধুমাত্র আমি নই, এ কথাটা আমরা সবাই অনুভব করি। কাল কি হতে চলেছে, আমি কি বেঁচে থাকব?'